আইপিএলের প্রতি আসরেই উত্থান ঘটে নতুন তারকার। এবারের মৌসুমেই যেমন কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন তরুণ সুয়াশ শর্মা। সবে কৈশোর ছাড়ানো সুয়াশের ঘূর্ণিতে নাকাল হয়ে ফিরছেন নামীদামী ব্যাটসম্যানরা। অথচ এখনো পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই অভিষেক ঘটেনি সুয়াশের।
আইপিএল অভিষেকেই রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে তিন উইকেট শিকার করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। যেকোনো তরুণ ক্রিকেটারের জন্যই এ যেন স্বপ্নের অভিষেক। অথচ সংবাদ সম্মেলনে ভাবলেশহীন সুয়াশ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আর দশটা তরুণ ক্রিকেটারের চাইতে তিনি আলাদা।
তিনি বলেন, ‘উইকেটসংখ্যা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বরং আমি কতটা উন্নতি করছি, ভালো জায়গায় বল করতে পারছি কিনা সেটা দেখাটাই বেশি জরুরি। পাঁচ কিংবা সাত উইকেট পাওয়া নিয়ে আমি ভাবি না। এর চাইতে ভালো জায়গায় বল করে এক উইকেট পেলেও আমি সন্তুষ্ট থাকব।’
সেদিনই বুঝিয়ে বয়স কুঁড়ি না পেরোলেও চিন্তাভাবনায় যথেষ্ট পরিণত এই তরুণ। এরপর সময় যত এগিয়েছে সুয়াশের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে কলকাতা। সুনীল নারাইনের অফফর্ম টের পেতে দিচ্ছেন না মোটেই, বরং বরুণ চক্রবর্তীকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছেন চমৎকার এক জুটি।
এখনো পর্যন্ত ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে মাঠে নেমে প্রতি ম্যাচেই গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ছয় ম্যাচে নয় উইকেট শিকারের পাশাপাশি ইকোনমি রেটটাও যথেষ্ট ভালো, ৮.১৩! সর্বশেষ ম্যাচেও ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে চার ওভারে ৩০ রান দিয়ে শিকার করেছেন দুই উইকেট।
বিশ বছর বয়সী এই তরুণের উঠে আসা দিল্লীর স্থানীয় ক্রিকেট থেকে। শুরুতে ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও বয়সভিত্তিক পর্যায়েই বুঝে যান প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে ভিন্ন কিছু ভাবতে হবে তাঁকে। এরপর বিরাট কোহলির ছোটবেলার কোচ সুরেশ বাটরার কাছে শুরু করেন স্পিনার হবার সাধনা। রশিদ খানের মতো দ্রুত অ্যাকশনে গুগলি শিখতে শুরু করেন তিনি।
কিন্তু বাদ সাধে করোনা মহামারী, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমান সুরেশ বাটরা। শুরুতে খানিকটা বিপাকে পড়লেও দ্রুতই নিজেকে সামলে নেন সুয়াশ। দিল্লীর আরেক প্রখ্যাত কোচ রনধীর সিংয়ের সহযোগিতায় ভর্তি হন মাদ্রাস ক্লাবে। বীরেন্দর শেবাগ এই ক্লাব থেকে উঠে এলেও মূলত স্পিনারদের উঠে আসার স্বর্গভূমি এই ক্লাব। মাদ্রাস ক্লাব থেকেই উঠে এসেছেন যুজবেন্দ্র চাহাল, পবন নেগিরা মতো বোলাররা।
মাদ্রাস ক্লাবের হয়েই নিজেকে শাণিত করার মিশন শুরু করেন সুয়াশ। বলে গতি বাড়ানোর সাথে সাথে আরো ধারালো করেন গুগলি এবং লেগব্রেক। ফলে তাঁকে সামলানো আরো দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে ব্যাটসম্যানদের। এরপর দিল্লীর বয়সভিত্তিক দল পেড়িয়ে আইপিএলের ট্রায়ালে পৌঁছুতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।
তবে কলকাতা নাইট রাইডার্স এবং মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দুই দলের ট্রায়াল থেকেই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসলেও সুয়াশ জানতেন নিলামে বদলে যেতে পারে অনেক কিছু। সেই কারণেই কিনা পরিশ্রমে কমতি রাখেননি, ট্রায়াল শেষেই ছুটেছেন ক্লাবে। কিন্তু ডিসেম্বরের সেই নিলামের টেবিলে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেনি, সুয়াশকে ২০ লাখ রুপির বিনিময়ে দলে ভেড়ায় কলকাতা। বাবা এবং কোচের মৃত্যুর পর প্রথমবারের মতো যেন মুখে হাসি ফোটে এই তরুণের।
কিন্তু আইপিএলে দল পাওয়া মানেই তো আর একাদশে সুযোগ নিশ্চিত নয়। বিশেষ করে আপনি যখন দলের তৃতীয় পছন্দের স্পিনার, তখন গোটা মৌসুমটা বেঞ্চে কাটানোর সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে মাঠে নেমে ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে ম্যাচ জেতানোর পর সুয়াশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সুয়াশ বলেন, ‘আমি এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু যখন বোলিং মার্কে গেলাম, সেই সময়টাতে অনেক নার্ভাস লাগছিল। আমি এই অনুভূতিটাকে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আইপিএলে অভিষেক ঘটছে জানার পর উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বোলিং শুরু করার সময় অনেক নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘তবে আমি আগেই প্রথম বলটা কিভাবে করবো সে নিয়ে অনেক কল্পনা করেছিলাম। নিজের প্রথম বল থেকেই সব সময় সেরা বলটা করার চেষ্টা করেছি।’
অভিষেক ম্যাচেই হয়তো সুয়াশ একদম নিজের সেরা বোলিং করতে পারেননি কিন্তু পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলেন। উইকেট থেকে টার্ন আদায় করে নিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বরুণ চক্রবর্তী এবং সুনীল নারাইন যেখানে নির্ভর করেন নিজেদের বোলিং বৈচিত্র্যের উপর, সেখানে সুয়াশের অস্ত্র নিখুঁত ফ্লাইট এবং টার্ন।
প্রথম ওভারেই মাইকেল ব্রেসওয়েলের কাছে ছক্কা হজম করলেও দ্রুতই ফিরে আসেন এই তরুণ। একে একে সাজঘরে ফেরান অনুজ রাওয়াত, দীনেশ কার্তিক এবং কর্ণ শর্মাকে। পরের ম্যাচগুলোতেও থামেনি সুয়াশ ম্যাজিক, তিনি পারফর্ম করে গেছেন নিয়মিত। যেসব ম্যাচে হাসেনি সুয়াশের বল, সেসব ম্যাচে পরাজিতের দলেই থাকতে হয়েছে কলকাতাকে। সর্বশেষ ম্যাচেও তাঁর বোলিংয়ের সুবাদেই টানা চার ম্যাচ পর হারের বৃত্ত থেকে বেরিয়েছে কলকাতা।
তাঁর বোলিং মুগ্ধ করেছে কলকাতার কোচ চন্দ্রকান্ত পন্ডিতকেও। তিনি বলেন, ‘সে অনভিজ্ঞ হলেও নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছে। এছাড়া অনুশীলনেও সে নিজের লড়াকু মনোভাবের ছাপ রেখেছে।’
এবারের টুর্নামেন্টে সুয়াশের বোলিংয়ে মূলত চার ধরনের ডেলিভারি দেখা গেছে – গুগলি, লেগব্রেক, ব্যাকস্পিন এবং ফ্লাইট। কিন্তু সুয়াশ জানেন টিকে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত তীরে যোগ করতে হবে নতুন তূণ। সেই কারণেই কিনা নতুন ডেলিভারি নিয়ে কাজ করছেন এই তরুণ। তবে জানিয়েছেন একমাত্র শতভাগ প্রস্তুত হয়েই ম্যাচে প্রয়োগ করবেন তিনি।
সুয়াশের শুরুটা হয়েছে দুর্দান্ত। এখন দেখার বিষয় কতদিন নিজের রহস্য ধরে রাখতে পারেন ব্যাটসম্যানদের সামনে।