আরেক গ্রেটের সিডনি কাব্য

সিডনির গ্রেট ইনিংস বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ২৪১*।

শচীনের সেই দৃঢ়সংকল্পের ইনিংস, অধ্যাবসায়ের ইনিংস। তিনটা টেস্টে ব্যর্থ হয়ে চতুর্থ টেস্টে নিজেকে প্রমাণ করার ইনিংস। ১৭ বছর পর আবার ক্রিকেটবিশ্ব সে দৃঢ়সংকল্পটা দেখল। মাঠটা কিন্তু একই, ব্যাকগ্রাউন্ডটাও একই, লড়াইয়ের কারণগুলোও একই; পার্থক্য শুধু দলের। বলছি স্টিভ স্মিথের সেঞ্চুরিটা নিয়ে।

স্মিথ আর শচীনের ব্যাটিং স্টাইল দুই মেরুর। একজনের ব্যাটিং দ্রাবিড়ের মত পুরোপুরি কপিবুক স্টাইল কপিড না হলেও তার অনেক কাছাকাছি। আর একজন ক্রিকেট ব্যাকরণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খেলেন। কিন্তু টেকনিক আলাদা হলেও যে দুই ইনিংসের কথা বলছি সেটাতে এদের মাইন্ডসেট আর ইচ্ছাশক্তির পার্থক্য নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভবই।

যদি প্রশ্ন করা হয় এ যুগের সেরা ব্যাটসমান কে? অধিকাংশই বলবে ভিরাট কোহলি। যদি প্রশ্ন করা হয় এ যুগের সেরা টেস্ট ব্যাটসমান কে? এবার কিন্তু স্মিথের পাল্লা ভারি। অন্তত আইসিসি র‌্যাংকিং শেষ দশ বছর তাই-ই বলে।

যদি স্মিথের ক্যারিয়ার রেকর্ড দেখা হয় তাহলেই বোঝা যাবে কেন তিনি এ যুগের গ্রেটদের অন্তর্ভুক্ত। পেস-স্পিন দুটো খেলতেই সমানভাবে দক্ষ তিনি। আর রেকর্ডটাও তার পক্ষেই কথা বলে। সব দেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে গড় সবচেয়ে কম। কিন্তু এই ‘কম গড়’ কত শুনবেন? ৪০ এর কাছাকাছি। ৪০ গড় হলেই অনেককে ভাল বলা যায় সেখানে এ মানুষটার সর্বনিম্ন এটা।

ঘরের মাঠের তো কথাই নেই। উপমহাদেশের পিচগুলোতেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই খেলেন বলেই ভারতের মাটিতেও গড় ৫০-এর ওপর। বিশ্বাসযোগ্য না হলেও সত্য ১৩৬ ইনিংসে তার গড় ৬১.৩। বল টেম্পারিং কেলেংকারির পর যখন কামব্যাক করেন টেস্টে; তখন সবার মুখে তালা লাগিয়ে দেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে ২০১৯-এর অ্যাশেজে তার গড় ১১০.৫৭। ৭ ইনিংসে স্কোর ৭৭৪। স্কোরগুলো যথাক্রমে ১৪৪, ১৪২, ৯২, ২১১, ৮২, ৮০, ২৩। ইংল্যান্ডের সুংই করা উইকেটে ব্রড, ওকস আর আর্চারের আগুনঝরা বোলিংয়ের সামনে এত রান প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন। এটুকুই যথেষ্ট তাকে মর্ডান ডে গ্রেটদের তালিকায় ফেলতে।

তবে সেই স্বপ্নের অ্যাশেজের পর থেকেই সমস্যার শুরু। এরপর থেকে শুরু করে ভারতের বিপক্ষে সিডনি টেস্টে আসা আগ পর্যন্ত তার গড় ২৫ এর কাছাকাছি। বিশেষ করে যদি ভারত সিরিজের কথা বলি তাহলেই স্মিথের অ্যাশেজের পরের ফর্ম পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম ইনিংসের ১ রান করেই অশ্বিণের স্ট্রেট ডেলিভারি আউটসাইড এজ দিয়ে প্যাভিলিয়নে। দ্বিতীয় ইনিংসে বোলাররা একরকম ভারতকে ধুলোয় মিশিয়ে ম্যাচটা জিতে নিয়েছিল তাই স্মিথ ততটাও সমালোচিত হননি।

তারপর বক্সিং ডে টেস্ট। প্রথম ইনিংসে আবার স্মিথ আউট হলেন অশ্বিনের বলে কিন্তু এবার ইনসাইড এডজে শূন্য রানে। তারপর দ্বিতীয় ইনিংসে যখন অস্ট্রেলিয়া একটা বড় পার্টনারশিপ খুজছে তখন নেমে মাত্র ৮ রান করেই আউট বুমরাহর বলে ফিরে এলেন।

শুধু আউটই নয়, আউটের ধরণ ও বোঝায় ভারতীয় দল কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে স্মিথের ওপর। একটা স্পিনার সবসময় চায় কোনো এক এজে ব্যাটসমানকে ধোঁকা দিতে। কিন্তু যখন দু ইনিংসে ভিন্ন দুই এজে আউট হয়, তখন স্পষ্টতই বোঝা যায় ওই স্পিনারই প্রভাব খাটাচ্ছে।

আবার স্মিথকে নিয়ে একটা কথা প্রচলিত তাকে লেগ স্টাম্পে বোল্ড করা অসম্ভব। বহুবছর ধরে বহু বোলার এটা ট্রাই করেছে কিন্তু ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০ এর আগে কেউই সফলতা পাননি৷ আর এর কারণটাও স্পষ্ট। শাফল করে এসে যেভাবে অফ স্টাম্প কভার করেন বাকি দু স্টাম্প এ বল যাওয়ার আগেই বলের অফসাইডে থেকে লেগ এ ফ্লিক করতে পারেন এবং তার হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন। কিন্তু মেলবোর্নে বুমরাহ ঘটালেন অন্য ঘটনা। স্মিথকে লেগস্টাম্পে বোল্ড করে তাকে নিয়ে প্রচলিত ধারণায় আচড় ফেললেন।

এ সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচের কথা বলতে গেলে ‘৩৬ অলআউট’ বাদ দিয়ে সব ই ভারতের পকেটে ছিল। আর এর কারণ হচ্ছে অজি ব্যাটিং এর স্ট্রাগল। তাদের স্কোর ১৯১,৯০/২,১৯৫,২০১। এরকম ব্যাটিং ব্যর্থতার জন্য দলের সেরা ব্যাটসমানের ওরূপ পারফম্যান্সকে সবাইই দায়ী করবে।

বারবার ব্যার্থতা, ভারতীয় বোলারদের দাপুটে বোলিং, সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রল সবই ছিলো স্মিথের বিপক্ষে। কিন্তু স্মিথও ২০২১ শুরু করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে, যেমনটা শচীন করেছিলেন ২০০৪ সালে।

বারবার ব্যর্থতার করাল ছায়া পিছে নিয়ে যখন স্মিথ সিডনিতে নামলেন তখন নিজেকে প্রমাণ করার প্রতিজ্ঞা ছিল সাথে। ২০০৩ সালে মেলবোর্নে শচীনকে নতুন বলের সামনে গার্ড দিতে সৌরভের নেমে যাওয়া শচীনের ব্যাটসমানশিপে যতটা আঘাত এনেছিল, ২০২১ এ স্মিথকে বোল করার জন্য অশ্বিন যখন ল্যাবুশেনকে সহজ সিঙ্গেল করলেন স্মিথের ব্যাটসমানশিপেও ততটাই আঘাত এসেছিল।

তৃতীয় টেস্টেও স্মিথকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরানো আশা নিয়ে প্রায় একই রকম পরিকল্পনা দিয়ে শুরু করল ভারত। কিন্তু স্মিথ এবার এসেছিলেন অন্য লক্ষ্যে। স্মিথের উইকেটের মূল্য বুঝে স্মিথ ক্রিজে আসতেই সেরা দুই বোলার বুমরাহ-অশ্বিণকে দিয়ে শুরু করল ভারত। কিন্তু স্মিথ এবার শুরুতেই খেলা ঘুরিয়ে দিলেন। বুমরাহকে কভারের মধ্যে দিয়ে একটা আর সামনে একটা চার মেরে বোঝালেন কেন তিনি স্মিথ। মজার ব্যাপার হলো এর আগে এ সিরিজে স্মিথের এ সিরিজে কোনো বাউন্ডারি ছিলনা। এরপর আসল অশ্বিণ। অশ্বিণকেও ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে একটা চার দিয়ে স্বাগত জানালেন স্মিথ আর বুঝিয়ে দিলেন কেনো তিনি গ্রেট। অশ্বিণকে বেশিরভাগ সময়ই সামনে খেললেন যেন এজ না হয়। পেসারদের ও হালছাড়া করলেন।

প্রথম দু ম্যাচে অজি ব্যাটিং ব্যর্থতার ‘ভিলেন’ তাকে বললে ভুল হবেনা। আর সেখান থেকে এবার একপ্রান্ত আগলে রেখে এই সেঞ্চুরি৷ যোগ্য সহযোদ্ধা পেলে ১৩১-কে আরো বড় তিনি করতে পারতেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা স্মিথকে এ ইনিংসে একবারো অসুবিধায় পড়তে দেখা যায়নি। এক ল্যাবুশেন ছাড়া কেউই সংগ দিতে পারেনি। ১০৬-২ এ ক্রিজ এ এসে শেষ উইকেট হিসেবে ৩৩৮ এ আউট হলেন কিন্তু তাও আবার রান আউট। দলীয় ২১০ রানে ল্যাবুশেনের বিদায়ের পর শেষ উইকেট পর্যন্ত লড়ে গেছেন নিঃসঙ্গ লড়াকু হিসেবে।

স্মিথের ক্যারিয়ারের সব সেঞ্চুরির মধ্যে এ সেঞ্চুরিটা আলাদা জায়গায় থাকবে। যেমন শচীনের ২০০ ম্যাচ এর মধ্যে ২০০৪ এ সিডনির ম্যাচটা আলাদা জায়গায় থাকে। দুটো ইনিংস, দুটো ঘটনা, দুটোই ক্রিকেট ইতিহাসের রম্যরচনা৷ ড্রাইভ এড়িয়ে চলে শচীনের ২৪১* এবং স্ট্রেইট ব্যাট এ অশ্বিণকে ট্যাকেল করে স্মিথের ১৩১ দুটোই এক জায়গায় এক সূত্রে গাথা৷ শুধু দলটাই ভিন্ন।

দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, অদম্য ইচ্ছাশক্তি, করে দেখানোর মানসিকতা দুটো ইনিংসেই সমানভাবে ছিল। যারা নতুন ক্রিকেট জগতে পা রাখছেন বারবার এ দুটো ইনিংস দেখুন তাহলেই বোঝা যাবে গ্রেটরা কেন গ্রেট হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link