আলীগড়ের বাদশাহ, কলকাতা নাইট রাইডার্সের হৃৎপিণ্ড কিংবা ৫ ছক্কায় পুরো বিশ্বকে বিস্ময়ে ভাসানোর নায়ক। ‘রিঙ্কু সিং’, নামটার পাশে এমন শিরোনাম যোগে কাব্যের মিশেলে বেশ কটা গল্প লেখা যায়।
আলীগড়ের অতি সাধারণ পরিবার থেকে বাইশ গজে আবর্তন, এরপর আইপিএলের মঞ্চে নিজেকে চেনানো। গল্পটা প্রায় সবারই জানা। তবে এবার তিনি ছুটলেন তাঁর স্বপ্নের পথেই। ভারতের জার্সি গায়ে পা রাখলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। আর যেখানে পা রাখলেন, সেখানেও যেন একটা জানান দিলেন, ‘দ্য কিং, রিঙ্কু সিং।’
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেকে ব্যাটের সুযোগ মেলেনি। তবে সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিংয়ে সুযোগ পেয়েই করলেন বাজিমাত।
না। আইপিএলকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো তেমন কিছু করেননি। ডাবলিনের মালাহাইডে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে পাঁচে নেমেছিলেন রিঙ্কু সিং। সেখান থেকে ২১ বলে ৩৮ রানের কার্যকরী একটি ইনিংস খেলেছিলেন এ ব্যাটার। যে ইনিংসের পথে ছিল ২ টি চার আর ৩ টি ছক্কার মার।
ভারতের ইনিংসে রিঙ্কু সিং সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেননি। এমনকি দ্বিতীয় সর্বোচ্চও না। সর্বোচ্চ ৫৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন রুতুরাজ গায়কড়। আর ৪০ রান করেছিলেন সাঞ্জু স্যামসন। তবে তারপরও ঐ ৩৮ রানের ইনিংসেই ম্যাচসেরার পুরস্কার ওঠে রিঙ্কু সিংয়ের হাতে।
কিভাবে? সেটা ভারতের দলীয় ইনিংসের সাথে তাঁর ইনিংসের গতির দিকে নজর দিলেই পরিস্কার হবে। ইনিংসের ১৬ তম ওভারে যখন গায়কড় আউট হয়ে ফিরে গেলেন, তখন ভারতের ইনিংসের গতিটা কিছু মন্থর হয়ে পড়ে। রিঙ্কুকে ঐ পরিস্থিতিতে ক্যালকুলেটিভ ইনিংসই খেলতে হতো। পরিস্থিতির চাওয়া অনুযায়ী রিঙ্কু সেটিই করেন। শিভাব দুবেকে নিয়ে গড়ে তোলেন ২৮ বলে ৫৫ রানের জুটি।
ভারতকে দারুণ সংগ্রহ এনে দেওয়ার পিছনেও রিঙ্কুর অবদান চোখে পড়ার মতো। ১৮ ওভার শেষে ভারতের সংগ্রহ ছিল ১৪২। সেখান থেকে ভারত ইনিংস শেষ করে ১৮৪ রানে। আর এর নেপথ্যে ছিলেন রিঙ্কু সিং। ১৯তম ওভারে বল করতে ব্যারি ম্যাকার্থির ঐ ৬ টি বলেই রিঙ্কু তোলেন ২২ রান। আর বাঁহাতি এ ব্যাটারের ব্যাটিং ঝড়ে মোমেন্টাম পুরোপুরি চলে যায় ভারতের দিকে। পরের ওভারে আরো ২০ রান তোলে রিঙ্কু-দুবে জুটি।
২১ বলে সেই ৩৮ রানের ছোট্ট ইনিংসেও তাই ম্যাচসেরার পুরস্কার ওঠে রিঙ্কুর হাতে। কারণ ম্যাচ পরিস্থিতিতে রিঙ্কুর ঐ ইনিংসই ভারতকে এগিয়ে দিয়েছিল। আর শেষের ঝড়ে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল আইরিশরা।
রিঙ্কু সিংয়ের জীবন পাল্টে গিয়েছে মূলত এ বছরের আইপিএলে গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে ম্যাচের পর থেকে। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে সেদিন কলকাতার সামনে লক্ষ্য ছিল শেষ ৫ বলে ২৮ রানের প্রায় ‘অসম্ভব’ সমীকরণ। কিন্তু সকলকে বিস্ময়ে ভাসিয়ে, টানা ৫ বলে ৫ ছক্কা হাঁকিয়ে কলকাতাকে জয় এনে দিয়েছিলেন রিঙ্কু সিং।
এরপর থেকেই রিঙ্কুর জীবন পাল্টে গিয়েছে। বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে বাঁহাতি এ ব্যাটার নিজেও সেটি স্বীকার করেছেন। ভারতের ক্রিকেট পাড়ায় আলোচিত ছিলেন প্রায় সিংহভাগ সময়েই। সেই ধারাবাহিকতায় এবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও দেখালেন নিজের ব্যাটিং কারিশমা।
ব্রাত্য থেকে জাত্য- বলে একটা ব্যাপার আছে। রিঙ্কু সিংয়ের পথযাত্রাটা ঠিক এমনই। সেই ২০১৭ সালে প্রথম বারের মতো আইপিএলের মঞ্চে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু গোটা আসরটাই সাইডবেঞ্চে কাটালেন এ ক্রিকেটার। পরের বছর ৮০ লাখ রূপিতে রিঙ্কুকে দলে ভেড়াল কলকাতা নাইট রাইডার্স। আগের চেয়ে ৪ গুণ দামে বিক্রি হলেন, কিন্তু নিজের ফর্মটা আর দেখাতে পারলেন কই!
সে আসরে ৪ ম্যাচে নিজের নামের পাশে মোটে যোগ করতে পারলেন ২৯ রান। পরের আসরেও একই চিত্র। ৩ ইনিংসে ৩৭ রান। টানা দুই আসরের ব্যর্থতায় পরের আসরে সুযোগ পেলেন মাত্র ১ টি ম্যাচে। এরপর আর সুযোগই পেলেন না। ২০২১ আইপিএলেও থাকলেন ব্রাত্য হয়ে।
কী মনে করে, ২০২২ আইপিএলে আবারো রিঙ্কুকে দলে ভেড়াল কলকাতা। অবশ্য আগের চেয়ে একটু কমমূল্যে, ৫৫ লাখ রূপিতে। তবে কলকাতার এই কমমূল্যে কেনা ক্রিকেটারই ২০২২ আইপিএলে কিছুটা সম্ভাবনার গল্প লিখলেন।
পুরো আসরে ১৭৮ রান করলেন। যার মধ্যে খেললেন দুটি চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস। খুব দারুণ কিছু না। তবে লখনৌর বিপক্ষে দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেলে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচটা কলকাতাকে বলতে গেলে একাই জিতিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এভিন লুইসের দুর্দান্ত এক ক্যাচে শেষ পর্যন্ত সেদিন জয় এনে দিতে পারেননি রিঙ্কু। তবে সম্ভাবনার একটা বীজ বপন করেছিলেন ঐ দিনেই। একটা ইঙ্গিত মিলেছিলে সেদিনই, এই ছেলের দারুণ সক্ষমতা আছে।
সেই সক্ষমতার পরিস্ফূরণ ঘটেছিল এবারের আসরে। ১৪ ম্যাচে ৫৯.২৫ গড়ে করেছেন ৪৭৪ রান। যেখানে তাঁর ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ছিল প্রায় দেড়শো (১৪৯.৫২)। তবে মুশকিলটা হলো টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে রিঙ্কুর এমন ব্যাটিং প্রতাপে অনেকেই ভেবে বসেন, রিঙ্কু বুঝি শুধু সংক্ষিপ্ত সংস্করণেরই। মোদ্দাকথা, মারকুটে ভঙ্গিমার কারণে তাঁকে স্লগার হিসেবেই ভাবা হয়।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলে উল্টো কথা। বাঁহাতি এ ব্যাটার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এখন পর্যন্ত ৩০০৭ রান করেছেন ৫৭.৮২ গড়ে! লিস্ট এ ক্রিকেটেও রীতিমত দুর্দান্ত রিঙ্কু। ৪৯.৮৩ গড়ে এখন পর্যন্ত নামের পাশে যোগ করেন ১৮৪৪ রান। যে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট দিয়ে রিঙ্কু এত আলোচিত, সেই সংস্করণেই বরং পরিসংখ্যানে কিছুটা পিছিয়ে তিনি। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ১৮০৬ রান করেছেন ৩০.৬১ গড়ে।
জীবনের হাজারটা রঙ দেখে আসা রিঙ্কু নিশ্চিতভাবেই সময়টা উপভোগ করছেন। তবে তিনি নিজেও বোধহয় চাইবেন না, তাঁর ক্যারিয়ারের অর্জনটা শুধু ‘পাঁচ ছক্কার মহানায়ক’ ট্যাগলাইনে আটকে থাকুক। কারণ সম্মুখ পানে তিনি ছুটতে জানেন। জানেন কিভাবে সমৃদ্ধির পথে এগোতে হয়। আলীগড়ের বাদশাহর নিশ্চয় সেদিকেই নজর থাকবে।
আলীগড় থেকে কেকেআর, এরপর সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যমণি হওয়া, এমন একটা সফলতার মসৃণ পথেই ছুঁটতে চাইবেন রিঙ্কু সিং। নিশ্চিতভাবেই সেটি শুধু রঙিন জার্সিতে নয়, সাদা জার্সিতে লাল বলের ক্রিকেটেও।