বাংলাদেশি পেসারদের ‘সেকেন্ড ওয়েভ’

পেস বোলিং নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটেদের দীর্ঘদিনের আক্ষেপ বদলে গিয়ে এবার আশা দেখাচ্ছে।

গত দুটি ঘরোয়া টুর্নামেন্টে পেসারদের পারফর্ম্যান্স একটা বড়সড় মাইলফলকই বলা যায়। বিসিবি প্রেসিডেন্ট কাপের কথাই ধরা যাক। সেরা দশ জন উইকেট সংগ্রাহকের আটজনই ছিলেন পেসার। প্রেসিডেন্ট কাপের পর আয়োজিত হয় বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ। সেখানে পেসাররা প্রেসিডেন্ট কাপের চেয়েও উজ্জ্বল- সেরা দশজন উইকেটসংগ্রাহকের নয়জনই পেসার!

বাংলাদেশ বরাবরই ছিল স্পিনারদের দেশ। ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতে ছড়ি ঘোরাত স্পিনাররা। উইকেটসংগ্রাহকদের তালিকাতেও রাজ করত স্পিনাররাই। সেখানে শেষ কবে তালিকাতে পেসারদের এমন জয়জয়কার দেখা গেছে তা বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিখাদ সমর্থকও মনে করতে চাইলে কপাল কুঁচকে যাবে।

পেসারদের জন্যে পরিবেশ যে পক্ষে ছিল এমনটাও কিন্তু না। বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট গত চার বছর ধরে ঘরের মাঠে ম্যাচগুলোতে স্পিন আক্রমণ নিয়েই মাঠে নামত; পরিকল্পনাও সাজনো হত সেভাবেই। শুধু তাই না, গেল ওয়েস্ট  ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে দলে তো টোকেন হিসেবেও একজন পেসার নেয়নি বাংলাদেশ। এতে অবশ্য সুফল যেমন হয়েছে, তেমনই আফগানিস্তানের মত দেশের কাছে টেস্টে হারের মত দুঃসহ স্মৃতিও জমা হয়েছে।

এই যে হার আর বিদেশের মাটিতে অকার্যকর  পেস আক্রমণ নিয়ে জবাব দিতে না পারার যে চক্র, সেখান থেকে বাংলাদেশ দল এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। পরিকল্পনাতে তাঁরা কিছুটা বদল আনছে। এক্ষেত্রে কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর ভূমিকা অবশ্য বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি পেস আক্রমণের উন্নতিতে শুধু মনোযোগই দেননি, দেশের কিছু উইকেট রীতিমত বদলে দিয়ে পেস আক্রমণের উপযোগী করে তুলেছেন। এটার পুরো সফল পেতে অবশ্য বাংলাদেশকে একটা লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

সে হিসেবে পেসাররা এখন পারফর্ম করতে আরেকটু আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মাশরাফির অনুপস্থিতিতে দলে ঢোকার জন্যে একটা সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়ে যাচ্ছে পেসারদের মধ্যে। ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসন যেমনটা বললেন, ‘অনেক বছর ধরেই মাশরাফি অসাধারণ পারফর্ম করে আসছেন। তবে তাঁর অনুপস্থিতি এবার রুবেল, তাসকিন, আল-আমিন, মুস্তাফিজকে পেস বোলিংয়ে নতুন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করবে। আমি নিশ্চিত, মাশরাফির যে অভিজ্ঞতা সেটাকে কেউ প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। কিন্তু আমি এটাও নিশ্চিত বাকি পেসাররা তিন বছর পরে হওয়া ২০২৩ বিশ্বকাপে পেস বোলিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সুযোগ হিসেবেই দেখছে এটাকে।’

গিবসন আরো বলেছেন, ‘বাংলাদেশ স্পিনারদের দেশ। কিন্তু আমি দেখেছি, রুবেল আর তাসকিন ভালো বোলিং করে। আল-আমিনও নিজের উন্নতি করছে। মুস্তাফিজও ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্যে বল সুইং করানোর ডেলিভারি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইবাদত আর রাহী তো টেস্টে ভাল করছে। খালেদ আহমেদ তো সম্ভবত এখন দেশের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার। আর সাইফুদ্দিনও দেশের হয়ে অনেক ভাল করছে।’

গিবসন মনে করেন শেষ কয়েক মৌসুমে দেশে পেস বোলারদের উঠে আসার যে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ দেখা দিয়েছে সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের পেস বোলিংকে আরেকটু উপরে নিয়ে যাবে, ‘আমি হাসান মাহমুদকে নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। সে তরুণ হিসেবে অসাধারণ প্রতিভা। শরিফুলও লম্বা একজন বাঁহাতি পেসার। যে কিনা দেশকে (যুব) বিশ্বকাপ জিতিয়ে প্রেসিডেন্ট কাপেও বেশ ভাল করেছে। তাকে ভাবনায় রাখা হচ্ছে। সুমন খান আর মুকিদুলের ঘরোয়া পারফরম্যান্সও বেশ ভাল হচ্ছে।’

দুইবারের বিপিএল জয়ী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন যিনি কিনা শেষ বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের কোচ হিসেবে পেসারদের পারফর্ম্যান্স দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘পেস বোলিংয়ে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। প্রথম দুই ম্যাচে অবশ্য পিচ একটু সহায়ক ছিল, ব্যাটসম্যানেরাও ছন্দে ছিল না। এখানে পেসাররা প্রভাব রাখার সুযোগ পেয়েছে। শীতকালের শিশিরও এক্ষেত্রে একটা ভূমিকা রেখেছে।’

 

তবে বাস্তবতাও ধরিয়ে দিচ্ছেন সালাউদ্দিন, ‘তাসকিন প্রেসিডেন্ট কাপে ভাল করলেও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে তার পুনরাবৃত্তি করতে পারেনি। পেসাররা আরো চ্যালেঞ্জ অনুভব করবেন যখন ব্যাটসম্যানেরা ছন্দে ফিরে আসবেন। পেস বোলিংয়ে একটা উন্নতি অবশ্যই হয়েছে, তবে সেটার একটা পরিষ্কার চিত্র আমরা দেখতে পাব ফেব্রুয়ারি থেকে সবাই যখন নিয়মিতভাবে খেলা শুরু করবে।’

এখন অব্দি পেসারদের উন্নতি অসাধারণ। বাংলাদেশে মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হওয়ায় খেলাধূলা বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়টা অনেকেই কাজে লাগিয়েছে নিজের ফিটনেসের উন্নতির কাজে। যার উদাহরণ দিতে গেলে রুবেল আর তাসকিনকেই আগে খুঁজে পাওয়া যাবে।

ঘরোয়া শেষ আসরে জেমকন খুলনার কোচ মিজানুর রহমান বাবুল বলছিলেন, ‘খেলোয়াড়েরা এখন অনেক বেশি সচেতন আর পেশাদার।’ ঘরোয়া সার্কিটে নানা সময়ে তরুণদের নিয়ে কাজ করা এই কোচ বলেছেন, ‘তাঁরা এখন সব মিলিয়ে পেশাদার হওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা বুঝতে পেরেছে। জাতীয় দলের বাইরে থাকার সময়ও ফিটনেস ঠিক রাখার গুরুত্ব বুঝেছে তাঁরা। এই ব্যাপারটা এখন সাধারণ ট্রেন্ড হয়ে গেছে সবার জন্যে।’

তাসকিনের ফিটনেস তো এখন চোখে পড়ার মত। এটার জন্যে অবশ্য তিনি মাহবুব আলী জাকির সাথে কাজ করেছেন। পেস বোলিং এই কোচ ২০১৬ সালেও তাসকিনের অ্যাকশন শুধরানোর কাজে তাসকিনকে সাহায্য করেছিল। মাহবুব আলী জাকি ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে বলেছে, ‘আমি তাসকিনকে বলেছিলাম রুটিন আর ফিটনেসে উন্নতি করতে হবে। আমি চেষ্টা করেছিলাম, তাসকিনের পেশী আরো বাড়াতে। ওজন না পরিবর্তন করে এই কাজটা অবশ্য কঠিন ছিল, কিন্তু আমি মুশফিকের উদাহরণ দিয়েছিলাম।’

জাকি আরও বলেছেন, ‘তাকে যে শুধু লাইন লেংথ ঠিক রেখেই বল করতে হত তা নয়, বলে গতিও রাখতে হত। সেটা নিয়ে সে বোলিং-এর কিছু ড্রিলও করেছে। মাঝেমাঝে তো সে বাড়ির গ্যারেজেই এসব কাজ চালিয়ে যেত।’

তাসকিনের এই ফিটনেসের ফলও তিনি পেয়েছেন। অক্টোবরের প্রেসিডেন্ট কাপে তিনি দ্রুতগতির বল করেছেন। তবে সালাউদ্দিন বলছেন, বলের অ্যাকুরেসি তুলনামূলকভাবে তরুণদের মধ্যেই বেশি , ‘তরুণদের মধ্যে হাসান মাহমুদ, মুগ্ধ , শরিফুলের বোলিং অ্যাকুরেসি বেশ ভাল। তাঁরা জানে কোথায় তাঁদের বল করতে হবে। তাঁরা বল সুইং করাতে পারে, বলে অতিরিক্ত বাউন্স আদায় করতে পারে। এ ধরণের বোলাররাই আসলে সব ধরণের উইকেটে বল করার জন্যে কার্যকরী।’

তবে সালাউদ্দিন বলেছেন এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, লম্বা সময় ধরে খেলার মত একজন ফাস্ট বোলারের খোঁজে আছেন তিনি- অন্তত টেস্ট ক্রিকেটে, ‘এই তরুণদের আরও গতি লাগবে। আরো  বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং করা, টেস্ট ম্যাচে জোরের ওপর বল করা এমন কাউকে লাগবে স্কোয়াডে।’

পেস বোলারদের উন্নতিতে ঘরোয়া ম্যাচে প্রচুর বোলিং করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচগুলিতে পেসাররা অনেক সময় কোটা পূরণ করতে পারেন না। পেস বোলিং কোচ হিসেবে এক বছর পূরণ করতে যাওয়া গিবসনের আতশী কাচের নিচে তা এড়ায়নি, ‘আমরা তো ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলেছি। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের প্রস্তুতির ব্যাপারটা আলাদা। তার জন্যে পেসারদের আলাদাভাবে প্রস্তুত হতে হবে, সারাদিন মাঠে থেকে বোলিং করতে হবে। এরপর এই চাপ নিয়ে পরদিন মাঠে নেমে প্রথম দিনের পুনরাবৃত্তি করার জন্যে শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের ফাস্ট বোলিং কার্যক্রমটা এখন চলমান আছে। তবে বোর্ড আর নির্বাচকদের আমি একটা বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছি- সাদা পোশাকে কার্যকরী পেসার পেতে হলে, বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে, পেসারদের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচেই প্রচুর বল করতে হবে। আমি নির্বাচকদের সাথে কথা বলেছি। তাঁদের বলেছি, পেসারদের একটা কার্যকরী গ্রুপ পেতে চাইলে  পেসাররা যেন দিনে ১৫-২০ ওভার বোলিং করার অভ্যাস করে। এখন পেসাররা দিনে ১০-১২ ওভার বল করে। তাঁদের আরো উন্নতি করতে হবে।’

তবে জাকি বলেছেন উঠে আসা পেসারদের মধ্যে অনেকেই তরুণ। সিনিয়রদের পাশাপাশি পারফর্ম করার জন্যে তাঁদের লম্বা সময় ফিটনেস ধরে রাখতে হবে, ‘এটা নিশ্চিত করা জরুরী যে দলের মূল পেসাররা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আগামী পাঁচ থেকে দশ পারফর্ম করার মত নিজেদের ফিট রাখছে কিনা। আমরা অবশ্যই সিনিয়র পেসারদের মধ্যে এই উন্নতিটা দেখতে চাই। তাঁরা এখনও বুড়িয়ে যাননি। এই বোলাররা দলকে আরো পাঁচ বছর সার্ভিস দিতে পারবে।আর তাছাড়াও পেসারদের ওপর অধিনায়কদের আস্থা থাকে। তাই উইকেট লাগুক কিংবা রান আটকাতে হোক, বল হাতে তুলে দিলেই পেসারদের ওপর আশা থাকে তাঁরা তাঁদের স্কিল দিয়ে অ্যাকুরেট বোলিং করবে।’

বোঝাই যাচ্ছে, দেশের ক্রিকেটে পেসারদের উঠে আসার এক ঢেউ শুরু হয়েছে। তবে এমন ঢেউ গত দুই দশকেও দেখা গেছে। এটা এখন নিশ্চিত হতে হবে, গত ঘটনাগুলোর মত এবারও এই ঢেউটা থেমে যাবেনা। এটা তো ভুলে যাওয়া যাবেনা, মাশরাফিই কিভাবে তাঁর নেতৃত্বে একটা পেস আক্রমণ দাঁড় করিয়েছিলেন যেটা কিনা ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে সাফল্য পাওয়ার মূল কারণ ছিল।

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ঐ পেস আক্রমণ দিয়েই আমরা বছরজুড়ে হেভিওয়েট দলগুলোকে হারিয়েছি। পেসারদের ঐ নবজারগরণ অবশ্য খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি। দল আবার পূর্ব পরিকল্পনাতে ফিরে আসে আর টেস্ট ম্যাচে প্রথম দিন থেকেই র‍্যাংক টার্নারে খেলতে শুরু করে। কিন্তু, ঘরের মাঠে টেস্টে পেসারদের ওপর আস্থা রাখলে তাঁরা বিদেশের মাটিতে পারফর্ম করতে আরেকটু আত্মবিশ্বাস পেত, যেখানে বাংলাদেশী পেসারদের বেহাল দশা।

তাই এবারের বিপ্লবটা আগের বারের মত থেমে না গেলেই নতুন কিছুর আশা দেখাই যায়!

-ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link