ফেইসবুক জনতাকে হিসেবে ধরছি না। ক্রিকেটারদের অনেকেরও এত গভীরে যাওয়া বা জানা থাকার কারণ খুব একটা নেই। তবে খুবই দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশে ক্রিকেট সাংবাদিকতায় যারা প্রফেশনালি কাজ করি, তাদের একটা বড় অংশ এখনও উইজেডন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাক ও উইজডেন ম্যাগাজিন বা উইজডেন ক্রিকেট মান্থলির সম্পর্ক জানি না।
যদি শুধু ‘উইজডেন’ বলা হয়, তাহলে বুঝতে হবে ‘উইজডেন অ্যালমানাক’, আদি ও অকৃত্রিম। যেটি ক্রিকেটের বাইবেল। সেই ১৮৬৪ সালে জন্ম।
‘উইজডেন ক্রিকেট মান্থলি’, একটা ম্যাগাজিন। আবারও বলছি, একটা ক্রিকেট ম্যাগাজিন। ১৯৭৯ সালে চালু হয়ে ২০০৩ পর্যন্ত চলেছে। এরপর ২০০৩ সালে ‘দ্য ক্রিকেটার’ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এটি একীভূত হয়ে নাম হয়েছে ‘দ্য উইজডেন ক্রিকেটার’। এরপর আবার দুই পক্ষ আলাদা হয়ে গেছে। এখন ‘দ্য ক্রিকেটার’ ম্যাগাজিন আলাদা। উইজডেন ক্রিকেট মান্থলি আবার ২০১৭ সাল থেকে চালু হয়েছে। অনলাইন-প্রিন্ট, দুটি ভার্সনই আছে।
উইজডেন গ্রুপের লাইসেন্স নিয়েই ম্যাগাজিনের নামের সঙ্গে উইজডেন রাখা হয়েছিল বটে। পরে উইজডেন শেয়ার কিনে এই ম্যাগাজিন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, এই তো।
কিন্তু অ্যালমানাক ও ম্যাগাজিন, দুটি আলাদা জিনিস। আলাদা স্বত্ত্বা। জন্ম আলাদা। পথচলা আলাদা। এডিটর আলাদা। ম্যাগাজিনটির উদ্দেশ্য বাণিজ্য, আর যে কোনো ম্যাগাজিনের মতোই। অ্যালমানাকেরও বাণিজ্য আছে অবশ্যই। সঙ্গে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ওজন, সমীহ, সম্মান।
আমরা প্রায়ই দুটিকে মিলিয়ে ফেলি। গুলিয়ে ফেলি। জগাখিচুগিড় বানিয়ে উপস্থাপন করি। ম্যাগাজিনকেই ‘ক্রিকেটের বাইবেল’ বলি হরহামেশা। সত্যিকারের বোধসম্পন্ন পাঠক, দর্শক, ক্রিকেট অনুসারীদের কাছে এটা আমাদের সম্পর্কে খুব ভালো বার্তা দেয় না।
__________________
‘উইজডেন ক্রিকেট মান্থলি’ ম্যাগাজিন তাঁদের এবারের সংখ্যায় বিশেষ ফিচার করেছে। ক্রিকেট সাইট ক্রিকভিজের সঙ্গে মিলে বেশি ‘ইম্প্যাক্টফুল’ ক্রিকেটার বের করেছে। ব্যাপারটা খারাপ নয়। এমনিতে ইমপ্যাক্টের ব্যাপার আমরা জানি, দেখি। তারা সুনির্দিষ্ট কিছু ক্রাইটেরিয়া ঠিক করেছে প্রথাগত ভাবনার বাইরে। সেই ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী বের করেছে, কার পারফরম্যান্স কতটা প্রভাববিস্তারী।
ক্রাইটেরিয়ার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে ক্রিকভিজের অ্যানালিস্ট ফ্রেডি ওয়াইল্ডের কথায়, ‘The traditional batting and bowling averages are good measures of a player’s influence in cricket, but devoid of context and independent of situation, they are not perfect – which is why we’ve created CricViz Match Impact. Our match impact model is a measure of how much better or worse a player has performed compared to the expected performance of an average player appearing in the same position in the same match.’
মূল ব্যাপার হলো, একই ম্যাচে একই পজিশনের ক্রিকেটারদের তুলনা। ম্যাগাজিন কিনলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
যাই হোক, এটা তাদের একটা ফিচার আইটেম। কোনো অ্যাওয়ার্ড নয়। ক্রিকেট সাইটগুলো স্ট্যাট বেইজড নানারকম ফিচার স্টোরি করে। ক্রিকইনফো যেমন এখন প্রথাগত স্ট্যাটের পাশাপাশি ‘স্মার্ট স্ট্যাট’ বের করেছে। তাদের বা অন্য ক্রিকেট সাইটগুলোর অ্যানালিস্ট-স্ট্যাটিসটিশিয়ানরা বা অনেক সময় গেস্ট অ্যানালিস্টরা প্রথাগত স্ট্যাটের বাইরে নিজেদের কিছু ভাবনা বা ইন্টারেস্টিং কিছু ক্রাইটেরিয়া ধরে চমৎকার স্টোরি করে।
উইজডেন মান্থলি ও ক্রিকভিজের এই আয়োজনও নিশ্চয়ই ভালো কিছু। তাদের ক্রাইটেরিয়ায় ইম্প্যাক্টফুল ক্রিকেটার বের করা হলো, তারা কেতাবি নাম দিয়েছেন, ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার’। সাকিব সেখনে ওয়ানডেতে দ্বিতীয়, দারুণ ব্যাপার!
সাকিব বাংলাদেশের সবসময়ের সেরা ক্রিকেটার হয়ে গেছেন আরও ৬-৭ বছর আগেই। দীর্ঘসময় ছিলেন অলরাউন্ডারদের র্যাংকিংয়ের শীর্ষে। বছরের পর বছর অসাধারণ পারফরম্যান্স। নিঃসন্দেহে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। তার পরও বিশ্ব ক্রিকেটে প্রাপ্য কৃতিত্ব পেয়েছেন কমই। গত বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর থেকে মোটামুটি পেতে শুরু করেছেন। উইজডেন মান্থলি একটা আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন, তাদের এই ফিচার আইটেম দেখে বাইরের অনেক ক্রিকেট অনুসারী বুঝবেন সাকিবের গুরুত্ব। তার ইম্প্যাক্ট কতটা, আমরা জানি। উইজেডন মান্থলি দেখে বাইরের অনেকে হয়তো জানবে, ব্যাটে-বলে তাঁর অবদান।
যথেষ্টই ভালো ব্যাপার। কিন্তু সংবাদমাধ্যম হিসেবে আমরা সেটা কিভাবে উপস্থাপন করছি? এটা কি কোনো অ্যাওয়ার্ড? কিংবা প্রথাগত কোনো স্বীকৃতি? সেরা বাছাই করা? মোটেও নয়!
ক্রিকভিজের সেই অ্যানালিস্টের কথা শুনি এক্ষেত্রেও, ‘It is important to stress that the findings of this model are not illustrative of who the ‘best’ player is; rather, they are a measure of which players have influenced the matches they have played in most significantly.’
তাদের মডেলে বা এই ক্রাইটেরিয়ায় ওয়ানডেতে সাকিবের ওপরে আছেন বা ‘ফার্স্ট’ হয়েছেন ফ্রেডি ফ্লিন্টফ। অলরাউন্ডারদের ইম্প্যাক্ট বেশি থাকবেই। ফ্রেডি ভালো হিটার ছিলেন, ওয়ানডেতে ডেথ বোলিংয়ে কয়েক বছর দুর্দান্ত ছিলেন। কিন্তু সেরার কথা যদি বলি, গত ২০ বছরে সেরা ২০ ওয়ানডে ক্রিকেটারের মধ্যে ফ্রেডি থাকবেন? মনে হয় না। এই স্টোরি কেবল, স্ট্যাটিসটিকসের কিছু ক্রাইটেরিয়ায় কার ইম্প্যাক্ট বেশি।
সাকিবের ইম্প্যাক্ট আমাদের কি নতুন করে জানতে হলো? বাইরের অনেকে জানতে পারবে ম্যাগাজিন থেকে, এটা ভালো ব্যাপার। কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব যে উচ্চতায় উঠেছেন, তার যে বিশালত্ব, একটা ম্যাগাজিনের ফিচার আইটেম তার তুলনায় নিতান্তই নগন্য। এখানে উইজডেন মান্থলিকে ধন্যবাদ দেওয়ারও কিছু নেই। এটা তাদের ভোট নয়, বিবেচনা নয়, জুরিদের মত নয়, পারফরম্যান্সগুলো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলার পর সাকিবের পারফরম্যান্সই সাকিবকে দুইয়ে রেখেছে।
যাহোক, ফেসবুক জনতা বা ক্রিকেটাররাও সংবাদমাধ্যমের অনেক কিছু বোঝার কথা নয়। কিন্তু আমাদের সংবাদমাধ্যমকে তো এসব বুঝতে হবে উপস্থাপনার সময়!
অবশ্য এটা যার যার অফিসের ব্যাপার, যার যার পলিসি। সব অফিস নিজেদের মতোই চলবে। লোকের যেটা ইচ্ছা, বেছে নেবে। এটাই স্বাভাবিক। আমার কেবল ছোট্ট আক্ষেপ, যেটা আগেই বলেছি, বোধসম্পন্ন ক্রিকেট অনুসারী যারা, তাদের কাছে খুব ভালো বার্তা যায় না আমাদের এই পেশা নিয়ে।
– ফেসবুক থেকে