২৩.৭৯ – সংখ্যাটা একজনের ব্যাটিং গড়। বেশ কয়েকটা হাসি-তামাশা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিরাট–এবি–ধোনির ৫০, শচীন–ভিভদের যথাক্রমে ৪৪ ও ৪৭ এর পাশে এটা কোন গড় হল?
যদি বলি ব্যাটসম্যান নয়, এটা অলরাউন্ডারের গড় তাতে হয়ত বেঞ্চমার্ক সামান্য নিচে নামবে কিন্তু কিছুতেই ৩০-এর নিচে নয়। লোকটা যে ব্যাট করতে পারে না সেটা মেনে নেওয়াই ভালো।
যদি বলি উনি একটা ১৭৫ রানের ইনিংস খেলে রেখেছেন সেক্ষেত্রে মোটামুটি সবাই হয়ত তাঁকে চিনে ফেলবেন। কিন্তু তাতেও হা হা রিয়াকশান কমার সম্ভাবনা নেই। ঐ একটি ইনিংস ভাঙিয়ে আর কতদিন চলবে? সামগ্রিক ক্যারিয়ারের হাল তো এই– ২৩.৭৯।
একটু দাঁড়ান। নেভিল কার্ডাস সাহেব স্কোরবোর্ডকে গাধা এমনি এমনি হয়ত বলে যান নি। অন্তত যদি না সেই স্কোরবোর্ডের সংখ্যার পেছনে কন্টেক্সট বোঝার চেষ্টা না করা হয়। সেই চেষ্টাই আজকে করব।
মোটামুটি ছয় বা সাত নাম্বারে ব্যাট করতে নামতেন কপিল। স্ট্যাটস হিসেবে পঞ্চাশ বা তার বেশি রানের ইনিংসের সংখ্যা মোট ১৫। এই ১৫ টি ম্যাচের মধ্যে ভারতের জয় আটটিতে, পরাজয় সাতটিতে।
এই ১৫ টি ইনিংসে কপিলের মোট রান ১০৩৭, স্ট্রাইক রেট ১২৮.১৮। না, দু চারটে আউটলায়ার পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে এই অস্বাভাবিক স্ট্রাইক রেট ছিল না কপিলের। ইন ফ্যাক্ট, মাত্র একটি ইনিংস ছাড়া বাকি ১৪টি ইনিংসেই তার স্ট্রাইক রেট ১০০-এর ওপর। যে একমাত্র ইনিংসে কপিল ধরে খেলেন সেটায় ভারত অল আউট হয় মাত্র ১৪০ রানে, কপিল ৬৮ বলে ৫০ করেন(স্ট্রাইক রেট ৭৩.৫৩)।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এরকম ধুম-ধারাক্কা করে ব্যাট চালাতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল তাকে? একটু ধীরে সুস্থে ব্যাট করলে শেষ অব্দি হয়ত দলেরই ভালো হত। কথাটা অনেকাংশে ঠিক হলেও পুরোপুরি নয়। হিসেব করে দেখলাম কপিল এই ম্যাচগুলিতে ব্যাট হাতে নামার সময় ভারতের গড় স্কোর ছিল ৪.২ উইকেটে ৯৪। এটাকে ৪ উইকেটে ৯০এ রাউন্ড অফ করলাম।
গড়ে প্রায় ২৭ ওভারে এই রান উঠেছিল। এর মধ্যে একবার ৯/৪ আছে (১৯৮৩, জিম্বাবওয়ে), একবার ৩১/৫ আছে (১৯৮৮, ওয়েস্ট ইন্ডিজ), ১৫/৪ আছে এবং ৪১/৫ আছে। ইন ফ্যাক্ট, দলের স্কোর ১৫০ পেরিয়ে গেছে এমন অবস্থায় নামার সৌভাগ্য কপিল মাত্র তিনটি ইনিংসে পেয়েছেন। এবং ম্যাচগুলিতে কপিল ছাড়া অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট ছিল ৬৭.৩১। এবং কপিলের এই ইনিংসগুলি সত্বেও ভারতের গড় রান ছিল ৫০ ওভারে ২২৬।
একই অ্যানালাইসিস তার প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খানের বেলায় করে দেখলাম। নিজের সর্বাধিক ১৫ ইনিংসে মোট ১০৩৯ রান করেছেন ইমরান, স্ট্রাইক রেট ৮২.৯২। এই ইনিংসগুলিতে ইমরান ছাড়া অন্যান্য পাক ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট ছিল ৭৯.২৩। অর্থাৎ ইমরানের সেরা ফর্মেও অন্যদের সঙ্গে তার স্ট্রাইক রেটের খুব বেশি তফাৎ ছিল না।
১৫টির মধ্যে দুটি ইনিংসে ইমরানের স্ট্রাইক রেট ১০০ ছাড়িয়েছে। কপিলের চেয়ে ইমরান বেশ কিছুটা আগে নামার সুযোগ পেতেন। ২২ ওভারে তিন উইকেটে ৭৫ – এই থাকত ইমরান নামার সময় পাকিস্তানের গড় স্কোর। এবং এই ম্যাচগুলিতে পাকিস্তানের গড় স্কোর ছিল ৫০ ওভারে ২৪৪ – ভারতের চেয়ে ১৮ রান বেশি।
জানি না, ওপরের সংখ্যাগুলির তাৎপর্য সঠিকভাবে বোঝাতে পারলাম কিনা। কপিল যখন ব্যাট করতে নামতেন তখন ভারতের অবস্থা দুই দিক দিয়েই চিন্তাজনক। এক, কম রানের মধ্যে বেশ কয়েকটি উইকেট পড়ে গেছে।
দুই, স্কোরিং রেট ৩-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে এবং সঙ্গে বা পরে স্কোরিং রেট বাড়ানোর মতো আর কেউ নেই। ফলস্বরুপ দেখা যাচ্ছে অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেও কপিলের ভারত ইমরানের পাকিস্তানের চেয়ে ইনিংস প্রতি ১৮ রান কম করছেন।
এর সঙ্গে যোগ করুন পাকিস্তানের শক্তিশালী বোলিং তাহলেই বুঝতে অসুবিধে হবে না কেন ইমরানের পারফর্মেন্স ১৫ বারের মধ্যে ১২ বার পাকিস্তানকে জয় এনে দিতে পেরেছিল যেখানে কপিলের ভারতের সাফল্য মাত্র ৮টি ম্যাচে।
কপিল চাইলে ধীরে সুস্থে ৮০র স্ট্রাইক রেটে (তবুও সেটা অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের চেয়ে অনেকটা বেশিই হত) নট আউট থেকে অনায়াসেই নিজের গড় বেশ কিছুটা বাড়িয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি প্রায় সবকটি ক্ষেত্রেই প্রতি-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আর তারই ফল ২৩.৭৯ (৯৫.০৭ স্ট্রাইক রেটে)। এবার আপনাদের ২৫ বলে ২৪ রানের ইনিংস বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না ৪৫ বলে ৩৩ রানের সেটা চিন্তা করে দেখুন (দুজনের গড় এবং স্ট্রাইক রেট ধরলে এই সংখ্যাই পাওয়া যাচ্ছে)।
প্রশ্ন উঠবে মাত্র ১৫ ইনিংস কেন? এই এনালিসিস তো সবগুলি ইনিংস ধরে করা উচিত। ঠিকই। তবে ওতে সময় এবং পরিশ্রম দুইই অনেকটা বেশি লাগবে। তবু এতেও মোটামুটি ধারনা পাওয়া যাবে।
তার চেয়েও বড় কথা, এখানে শুধু কপিল বা ইমরানের ব্যাটিং নয়, এখানে ভারত এবং পাকিস্তানের দলগত শক্তির পার্থক্য সম্বন্ধেও কিছুটা ধারনা করা যাচ্ছে। এবং এটাও বোঝা যাচ্ছে যে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দলগত শক্তির বিকল্প হতে পারে না।