বাবা তখন থেকেই খুব অসুস্থ। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলে মাত্র এসেছেন অস্ট্রেলিয়া সফরে। এসেই শুনলেন বাবার মৃত্যুর সংবাদ। চাইলে তখনই সব ছেড়েছুড়ে দেশে ফিরে যেতে পারতেন মোহাম্মদ সিরাজ।
শেষবারের মত দেখতে পারতেন বাবাকে, সেই বাবা যিনি অটোরিকশা চালিয়ে সন্তানকে বড় করেছেন। নিজে না খেয়ে ফাস্ট বোলিংয়ে জুতো কিনে দিয়েছেন ছেলেকে, যার মধ্য দিয়ে কালক্রমে বড় পেসার হয়ে উঠেছেন সিরাজকে।
কিন্তু, সিরাজ দেশে ফেরেননি। ফিরিয়ে দিয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্টের দেওয়া প্রস্তাব। দেশে ফিরে গেলে কি করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবেন। বাবাই তো চেয়েছিলেন, ছেলে একদিন খেলবে ওই আকাশী জার্সি শরীরে চাপিয়ে।
বায়ো বাবল ভাঙলেন না সিরাজ। বুকে শোক চেপে ধরে অনুশীলন চালিয়ে গেলেন, মাঠে নামলেন, ওয়ানডে অভিষেক হল। তিনি জানতেন, বাবা ওপর থেকে ঠিক ঠিক সবই দেখছেন।
টেস্ট সিরিজে তাঁর থাকার কথা ছিল না। কিন্তু, এক গাদা ইনজুরির জের ধরে ভারত তো রীতিমত হাসপাতাল। সিরাজের তাই ঠাঁই হল টেস্ট দলে। ম্যাচও খেলে ফেললেন। সিডনি আর মেলবোর্নে খেললেন। সাত উইকেট পেলেন।
জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় বারবার চোখটা ভিজে উঠছিল। টেলিভিশন পর্দায় সেই দৃশ্য দেখেছে বিশ্ব। নির্ঘাত বাবার কথাই মনে পড়ছিল।
শুধুই কি শোক চেপে পারফর্ম করেছেন? না, তাঁকে এক বিন্দুও ছাড় দেয়নি অজি দর্শক। গ্যালারি থেকে এসেছে বিদ্রুপ, সিরাজকে শুনতে হয়েছে বর্ণবাদী মন্তব্য। সিরাজ চুপ থাকেননি, প্রতিবাদ করেছেন, বাধ্য করেছেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে (সিএ) ব্যবস্থা নিতে।
সিরাজ কাব্য এখানে শেষ হয়নি। আসলে তখনও আসল কাব্য শুরু হওয়া বাকি। তিনি আসলেন ব্রিসবেনে, অস্ট্রেলিয়ার দুর্গ গ্যাবা। যেখানে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট হারে না বললেই চলে। প্রথম ইনিংসে একটা উইকেট পেলেন, তবে পিছিয়ে গেলেন বাকি ফ্রন্টলাইন বোলারদের চেয়ে। ওয়াশিংটন সুন্দর, থাঙ্গারাসু নটরাজন আর শার্দুল ঠাকুররা তিনটা করে বাকি নয়টা উইকেট ভাগাভাগি করে নিলেন।
তবে, অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হতেই দেখা গেল সিরাজের আসল রূপ। তিনি একে একে ফেরালেন মার্নাস লাবুশেন, স্টিভেন স্মিথ, ম্যাথু ওয়েডকে। শেষে এসে ফেরালেন দুই টেল এন্ডার মিশেল স্টার্ক ও জশ হ্যাজেলউডকে।
ব্যাস, প্রথমবারের মত টেস্টে পাঁচ উইকেট পেলেন, ক্যারিয়ারের তৃতীয় ম্যাচে। গ্যাবায় এটা যেকোনো ভারতীয় পেসারের দ্বিতীয় সেরা বোলিং পারফরম্যান্স। ১৩ টি উইকেট নিয়ে তিনি এবারের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে ভারতের সেরা বোলার। ফলে, ইতিহাস থেকে তাঁকে মুছে ফেলার আর কোনো উপায় নেই।
গেল ৩২ বছরের ইতিহাসে এই গ্যাবায় ৩২ টি টেস্ট খেলেছে অস্ট্রেলিয়া। তার মধ্যে মাত্র তিনবার তারা দুই ইনিংসেই অলআউট হয়েছে। এর তৃতীয় ও এখন অবধি শেষ নজীরটা দেখা গেল এই ভারতের বিপক্ষে। সর্বশেষ এই দৃশ্য দেখা যায় ২০০৮-০৯ মৌসুমে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, এর আগেরটা ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এবার হন্তারক ভারত। আর তাতে সিরাজের অবদানটাই সবচেয়ে বেশি। ২০ টা উইকেটের মধ্যে ছয়টিই গেছে তাঁর ঝুলিতে।
এখানে ২০০৬ সালের একটা স্মৃতিচারণা না করলেই নয়।
বিরাট কোহলির বয়স তখন ১৮ বছর। রঞ্জি ট্রফির ম্যাচে কর্নাটকের বিপক্ষে ধুঁকছে দিল্লী। ১০৫ রানে নেই চার উইকেট। কোহলি ৪০ রানে অপরাজিত থেকে দিন শেষ করলেন। পরদিন ফলোঅন টপকাতে হবে – সেই চ্যালেঞ্জে যখন পরদিনের অপেক্ষা করছেন, তখন জানতে পারলেন ৫৪ বছরে বাবা স্ট্রোক করে মারা গেছেন। অতটুকু বয়সে কোহলি বাড়ি ফিরেননি, ফিরে গেছেন মাঠে। নব্বই রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেছেন।
ইনিংস শেষ করে ফেরার সময় আকাশে তাকিয়ে খুঁজেছেন বাবাকে।
এর ১৫ বছর পরের ঘটনা। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে পাঁচ উইকেট পেয়ে সেই কোহলির মতই আকাশে তাকালেন ২৬ বছর বয়সী এক তরুণ। তাঁর নাম সিরাজ, মোহাম্মদ সিরাজ। নামটা মনে রাখা দরকার। গ্যাবায় রোজ রোজ কোনো ভিনদেশি পাঁচ উইকেট পান না।
সিরাজ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার বাবা প্রায়ই বলে, আমার ছেলে দেশের নাম উজ্জল করবে।‘
সিরাজ, আপনি দেশের নাম আর বাবার নাম – দু’টোই উজ্জ্বল করেছেন!