তারকাদের ভিড়ে অনন্য মহাতারকা

ক্রিকেটে একসময় স্পিন আক্রমণ অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছিল। আব্দুল কাদিরের পর লেগ স্পিনার আর কাউকে খুজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশিরভাগ অধিনায়কেরা পেস আক্রমণ দিয়েই কাজ চালাচ্ছিলেন। গতির বন্যতা কার্যকরী নি:সন্দেহে কিন্তু এর সাথে ঘূর্ণীর রহস্যও যে ম্যাচ জয়ে ভূমিকা রাখতে পারে সেটার বিশ্বাসটা ফেরত এনেছিলেন ওয়ার্নই।

১.

১৯৯৬ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। উপমহাদেশের পিচ সবসময়েই স্পিনারদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু তার পারফর্মেন্স তেমন আশাপ্রদ নয়। অথচ টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সবচেয়ে বেশি আলোচনা তাকে নিয়েই হচ্ছিল। সেমি ফাইনালের আগ পর্যন্ত ৫ ম্যাচে মাত্র ৮ উইকেট। এর মাঝে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে স্বস্তা ৪ উইকেট বাদ দিলে বাকি চার ম্যাচে ৪ ম্যাচে ৩৩.৭৫ গড়ে ৪ উইকেট বিশ্বমানের একজন স্পিনারের জন্য বড় আসরে ব্যর্থতারই পরিচায়ক। তুলনায় অনিল কুম্বলে যথেষ্ট সপ্রতিভ, ৫ ম্যাচে ১৪ উইকেট।

তবে ওয়ার্নের গায়ে একটা ট্যাগ লাগানো ছিল – ‘বড় ম্যাচের খেলোয়াড়’। নিজেকে ফিরে পাবার জন্য সম্ভবত অষ্ট্রেলিয়ার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনের দিনটাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

সেমির সেই ম্যাচটাতে শুরু থেকেই আগুন ঝরাচ্ছিলেন অ্যামব্রোস আর বিশপ। ০ রানে ১ম, ৭ রানে ২য়, ৮ রানে ৩য় আর এক পর্যায়ে ১৫ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যায় অষ্ট্রেলিয়ার। শেষ পর্যন্ত খুড়িয়ে খুড়িয়ে ২০৭ রান করতে পারে অষ্ট্রেলিয়া। ষষ্ঠ ওভারে ব্রাউনকে ফ্লিপারে আউট করে প্রথম ব্রেক থ্রু দেন ওয়ার্ন। গিবসন, জিমি অ্যাডামস আর বিশপ কে আউট করে ম্যাচ সেরা ওয়ার্ন।

ফাইনালে উঠতে পারবে না এমন ম্যাচে কম পুজি নিয়ে এমন অসাধারণ পারফর্মেন্স। তবে ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে বেদম মার খান। ধারণা করা হয় ডে নাইট ম্যাচে কুয়াশার কারণে বল গ্রিপ করতে সমস্যা হওয়ায় তার বোলিং খারাপ হয়েছিল। শুধুমাত্র এই কারণেই অষ্ট্রেলিয়ার কোচকে সেই টুর্নামেন্টের পর স্যাক করা হয় কারণ আগে লক্ষ করলে হয়ত রাতের বেলা প্র্যাকটিস টা করতে পারতো। তবে শ্রীলঙ্কা সেদিন যেমন ডাকুটে ফর্মে আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তাতে কোনো পরিকল্পনা তাদের দমাতে পারতো বলে মনে হয় না। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

১৯৯৬ এর কথা বাদ দেই, সেখানে তো তবুও ওয়ার্ন ফাইনাল হেরেছিলেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের কথাটা একটু দেখি। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ডের সাথে পরপর দুই ম্যাচ হেরে প্রায় বাতিলের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল অষ্ট্রেলিয়া। উইন্ডিজের সাথে মাষ্ট উইন ম্যাচে পান ১১ রানে ৩ উইকেট। মূল কাজটা অবশ্য ম্যাকগ্রা করেছিলেন (৫/১৪)। এরপরের ম্যাচ গুলোতে আবার ব্যর্থ।

ভারতের সাথে ৬ ওভারে ৪৯ রান দিয়ে কোন উইকেট পাননি আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫৫ রানে ১ উইকেট। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে স্টিভ ওয়াহ বললেন সেই ম্যাচের ট্রাম কার্ড ওয়াররন। কিন্তু ওয়ার্ন ৩৩ রানে ২ উইকেট পেলেও ম্যাচটা বাচালেন স্টিভই। কিন্তু ওয়ার্ন মনে হয় তার সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন মূল সময়ের জন্য।

পোলক আর ডোনাল্ডের তোপে পড়ে সেমিতে আবারও অষ্ট্রেলিয়া ২১৩ রানে অল আউট। সেই বিশ্বকাপের আফ্রিকার মতো দলের জন্য এটা মামুলি টার্গেটই বলা চলে। ১২ ওভারে কোন উইকেট না হারিয়ে ৪৮ রান করে পথেই ছিল আফ্রিকা। কিন্তু এবারেও ব্রেক থ্রু দিলেন ওয়ার্ন। দারুণ খেলতে থাকা গিবসকে ( ৩৬ বলে ৩০ রান) বোল্ড করলেন বড় টার্নে। পরের ওভারে ফিরিয়ে দিলেন কার্স্টেনকে।

ক্রনিয়েকেও ফেরত পাঠালেন দুই বল পরেই। ৪৮ রানে ০ উইকেট থেকে ৫৩ রানে ৩ উইকেট, তিনটিই ওয়ার্নের। এরপর আবার ফিরে আসলেন যখন পোলক আর ক্যলিস আরেকটা বড় জুটি গড়ে ফেলেছিল। ক্যালিসকে ফিরিয়ে সেই জুটি ভাঙলেন। ম্যাচে পেলেন ৪ উইকেট ২৯ রানে। ফাইনালে এবার আর কোন ভুল নয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে পেলেন ৪ উইকেট। প্রথমম সাত ম্যাচে ১০ উইকেটের ব্যর্থতা ঢেকে গেল শেষ ক্রুশিয়াল ৩ ম্যাচের ১০ উইকেট। সেমিফাইনাল আর ফাইনালের ম্যাচ সেরা।

স্টার অনেকেই হয়, তবে সুপার স্টার ওয়ার্নের মতো গুটি কয়েকজনই।

২.

তবে শুধু বোলার হিসেবে নয়, ওয়ার্ন ছিলেন ক্রিকেটের জন্য বর্ণময় একটা চরিত্র। তার চারিত্রিক স্থিরতা খুবই কম ছিল। এজন্য ক্যারিয়ারে কিছু উদ্ভট কাজও করেছেন। কিন্তু গ্রেট হওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড থেকে ছাড়ও পেয়ে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০০৩ বিশ্বকাপে আর এই ছাড়টা পেলেন না। সেই বিশ্বকাপে ডোপ টেষ্টে বাদ পড়ে ২ বছরের নিষেধাজ্ঞায় পড়লেন। বয়স তখন ৩৪।

সবাই তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন, সেটা অস্বাভাবিকও ছিল না। ২ বছর ক্রিকেট থেকে বাইরে থাকার পর ৩৬ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ান দলে ফিরে আসাটা কিছুটা আকাশ কুসুম কল্পনার মতোই। তবে তিনি যে ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ান টিম ম্যানেজম্যান্টেরও তার উপর আস্থা ছিল। এই কারণে ম্যাকগিলের মতো বোলার দূর্দান্ত পারফর্ম করার পরেও নিষেদ্ধাজ্ঞা শেষ হবার পরে দলে ডাক পেলেন তিনি।

তবে যে দলের বিপক্ষে ফেরত আসলেন সেটা একটু ভয়ের কারণ ছিল। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অতীত রেকর্ড খুব ভালো ছিল না। ৮ ম্যাচে ৩০.৬৯ গড়ে মাত্র ২৩ উইকেট। এর মাঝে শ্রীলঙ্কার মাঠে ৫ ম্যাচে মাত্র ১১ উইকেট। এতদিন পর এই রকম প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কি করতে পারবেন সেটা নিয়ে সবাই একটু চিন্তার মাঝেই ছিলেন।

কিন্তু ওয়ার্ন যে চ্যাম্পিয়ন ঘরণার। প্রথম ম্যাচেই পেলেন ১০ উইকেট, দুই ইনিংসেই ৫ টি করে। পরের টেষ্টে আবার ১০ উইকেট, এখানেও প্রতি ইনিংসে ৫ টি করে। সব শেষ টেষ্টে পেলেন ৬ উইকেট।

পুরো সিরিজে ২০.০৩ গড়ে ২৬ উইকেট, ক্রিকেট ইতিহাসে এই বয়সে এসে এত ভালো প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস আর আছে কিনা সেটা খুজে দেখতে হবে।

৩৬ বয়সে প্রত্যাবর্তন করার পর মাত্র ৩৮ টি ম্যাচে ২৪.৭৫ গড়ে ২১৭ উইকেট। অনেক ক্রিকেটার তো এই রকম ক্যারিয়ার থাকলেও খুশি থাকেন।

৩.

লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেও দূর্দান্ত ছিলেন। একটাই আক্ষেপ যে ক্যারিয়ারে কোন সেঞ্চুরী পাওয়া হয় নি। টেষ্টে ১২ টি ফিফটি থাকলেও সর্বোচ্চ টেষ্ট স্কোর ৯৯ রানের। তবে এটা নিয়েও একটা রেকর্ডের অধিকারী তিনি। সেঞ্চুরিহীন ব্যাটসম্যানদের মাঝে সবচেয়ে বেশী টেস্ট রান তার।

ক্রিকেটে ব্যাটিং বোলিং এর পর বাকি থাকে অধিনায়কত্ব। অনেকে হয়তো জানে না যে স্টিভ ওয়াহর পরবর্তী অধিনায়ক ওয়ার্নেরই হওয়ার কথা ছিল। এমনকি ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপের আগে স্টিভকে বাদ দিয়ে ওয়ার্নকেই অধিনায়ক হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছিল। বিশ্বকাপ শুরুর আগের সিরিজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে ২-২ এ টেষ্ট সিরিজ ড্র করে।

আবার ওয়ানডে সিরিজেও ৩-৩ এ ড্র হয়। খর্বশক্তির উইন্ডিজের সাথে এই ড্রটা হারের সমতূল্যই ছিল । বিপরীতে এর আগের টুর্নামেন্টেই ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে বেশ কিছু নৈপূন্য দেখিয়ে দলকে চ্যাম্পিয়ন করান ওয়ার্ন। ছিলেন। এরপরেও শেন ওয়ার্ন তার প্রাপ্য সুযোগটা পাননি ক্রিকেট বহির্ভূত কারণে। দলের অধিনায়ক হওয়ার জন্য যে চারিত্রিক স্থিরতার প্রয়োজন ওয়ার্নের মাঝে সেটির অভাব ছিল। তবে জাতীয় দলের হয়ে না পারলেও পরবর্তীতে আইপিএলে ওয়ার্নের কিছুটা নমুনা দেখা গিয়েছে।

ওয়ার্নের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা ছিল সহ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরাটা বের করে নেওয়া। আইপিএলের প্রথম মৌসুমে ফেভারিট না হয়েও সাধারণ মানের দলকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। পরের সিজন গুলোতেও যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স করেছিল।

৪.

ক্রিকেটে একসময় স্পিন আক্রমণ অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছিল। আব্দুল কাদিরের পর লেগ স্পিনার আর কাউকে খুজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশিরভাগ অধিনায়কেরা পেস আক্রমন দিয়েই কাজ চালাচ্ছিলেন। গতির বন্যতা কার্যকরী নিঃসন্দেহে কিন্তু এর সাথে ঘূর্ণীর রহস্যও যে ম্যাচ জয়ে ভূমিকা রাখতে পারে সেটার বিশ্বাসটা ফেরত এনেছিলেন ওয়ার্নই।

ম্যাচ প্রতি উইকেট কিংবা পরিসংখ্যানে অনেকটাই মুরালিধরণের চেয়ে পেছনে থাকলেও ম্যাচ উইনার হিসেবে সবাই ওয়ার্নকেই এগিয়ে রাখে। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে মাত্র ১ উইকেট পেলেও পরবর্তীতে ‘শতাব্দীর সেরা বল’ দিয়ে মাইক গ্যাটিং কে আউট করে লাইম লাইটে আসা শুরু, শেষ পর্যন্ত টেষ্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হিসেবে অবসর। ক্যারিয়ারটা বর্ণময়ই ছিল।

উইজডেন দ্বারা নির্বাচিত গত শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন ওয়ার্ন। বাকি চারজন হলেন – ব্র্যাডম্যান, সোবার্স, জ্যাক হবস, ভিভ রিচার্ডস। বুঝে নিন তিনি কত বড় কিংবদন্তি!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...