এখন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?
জো বাইডেন? নাহ। তার সামনে এখন অনেক চাপের কাজ। তিনি এতোটা সুখী বলে মনে হচ্ছে না।
তাহলে কী এলন মাস্ককে হটিয়ে আবার শীর্ষ ধনী হওয়া জেফ বোজেস? নাহ, তাও মনে হয় না। এতো টাকার মালিক কী আসলে সুখী হতে পারে!
তাহলে সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?
হ্যা, এখন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ রব লুইস। চিনতে পারছেন না? আসলে চেনার কোনো কারণ নেই। রব লুইস কোনো তারকা নন, কোনো রাজনীতিবিদ নন; এমনকি ধনী মানুষও নন। নিতান্ত খেটে খাওয়া এক ব্রিটিশ; যিনি ক্রিকেট ভালোবাসেন। এই লুইসের চেয়ে সুখী মানুষ এখন দুনিয়ায় আছে কি না সন্দেহ।
বুঝতে পারছি যে, একটু রাগ হচ্ছেন। রব লুইসের পরিচয়, কর্মকান্ড কিছুই না বলে তাকে কেবল সুখী মানুষ বলে গেলে চলবে!
রব লুইস হলেন এই গতকাল শেষ হওয়া গল টেস্ট দেখা একমাত্র নির্ভেজাল দর্শক। তিনি এই একটা টেস্টের খেলা দেখার জন্য গত দশ মাস ধরে অপেক্ষা করেছেন। শ্রীলঙ্কার পথেঘাটে থেকেছেন, রেস্টুরেন্ট-দোকানে কাজ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত খেলা দেখেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, ইংল্যান্ড দারুন একটা জয় পাওয়ার পর খোদ অধিনায়ক জো রুট তার সাথে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি এখন ইংল্যান্ডের সুপার ফ্যান।
লুইস হচ্ছেন সেই মানুষ, যাকে লক্ষ্য করে সেঞ্চুরি ও ডাবল সেঞ্চুরির পর ব্যাট উচু করেছিলেন জো রুট।
আচ্ছা, গোড়া থেকেই গল্পটা বলা যাক।
রব লুইস পেশায় একজন ওয়েব ডিজাইনার। কিন্তু তার জীবন ও জগত জুড়ে আছে ক্রিকেট। ইংল্যান্ড কোথাও সফরে গেলেও তিনি চেষ্টা করেন কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে সফরে যেতে। তেমনই গত মার্চে শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন আরও অনেকের সাথে।
সে সময় লম্বা সফরের মন নিয়ে শ্রীলঙ্কা এসেছিলো ইংল্যান্ড দল। বেশ কিছু ব্রিটিশ দর্শকের একজন হয়ে লুইসও এসেছিলেন এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে। কিন্তু একটা প্রস্তুতি ম্যাচের পরই ভেস্তে গেলো সেই সফর। দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো করোনা ভাইরাস। সফর বাতিল করে দেশে ফিরে গেলো ইংল্যান্ড দল।
লুইসের সঙ্গীরাও সব দেশে ফিরে গেলো। তারা বললো, আবার যখন দল আসবে, তখন আসবো আমারও। কিন্তু লুইসের তো এই বারবার কলম্বো-লন্ডন করার মতো টাকা পয়সা নেই। তিনি এখন গেলে আবার আসবেন কি করে?
লোকেরা বলছিলো, এই করোনা ভাইরাস মাস খানেকের ব্যাপার। তাই লুইস ঠিক করলেন, এই ক টা দিন যেমন করে হোক কলম্বোতে কাটিয়ে দেবেন। সেই শুরু হলো লুইসের লড়াই।
কয়েকটা দিন তো দূরে থাক, কয়েক মাসেও লুইসের অপেক্ষা আর শেষ হয় না। এদিকে লুইসের হাতের পাউন্ড সব শেষ হয়ে গেলো। লুইস ভবঘুরের মতো জীবন কাটাতে শুরু করলেন। তাতেও পেট তো শান্ত থাকে না। এবার তিনি এ জায়গায়, ও জায়গায়কাজ করা শুরু করলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে মজার ছিলো, একটা হোটেলে তিনি ডিস্ক জকি (ডিজে) হিসেবে কাজ করেছিলেন। নিজের নাম রেখেছিলেন-র্যিান্ডি ক্যাডিক।
নামটা চেনা চেনা লাগছে না? হ্যা, লুইসের প্রিয় বোলার অ্যান্ডি ক্যাডিকের থেকে ধার করা নাম!
দুনিয়ার সব অপেক্ষার শেষ হয়। লুইসেরও অপেক্ষার শেষ হলো। অবশেষে ইংল্যান্ড আবার সফরে এলো সেই শ্রীলঙ্কায়। লুইস ছুটলেন গলে। কিন্তু এবার আরেক সমস্যা। করোনা কালে জৈব সুরক্ষা বলয় বা বায়ো বাবলে খেলা হচ্ছে। এবার মাঠে তো ঢোকা যাবে না। তাহলে উপায়?
লুইস চড়ে বসলেন গল দূর্গের এক কোনায়। ওখান থেকে মাঠ দেখা যায়। ওখানে একটা ব্যানার টানিয়ে বসে খেলা দেখছিলেন। কিন্তু বেরসিক নিরাপত্তাকর্মীরা এটা সহ্য করলেন না। ইউনেস্কো হেরিটেজের ওপর এভাবে বসা যাবে না বলে লুইসকে তাড়িয়ে দিলেন তারা।
লুইস ভেঙে পড়লেন। আশেপাশের ক্যাফের টিভিতে খেলা দেখেন, গলের গেটে এসে উকি দেওয়ার চেষ্টা করেন। পাগলপারা অবস্থা। এই অবস্থায় তাকে আবিষ্কার করলেন এএফপির এক সংবাদিক। লুইস প্রায় কেঁদে ফেলে নিজের গল্প বলে বললেন, ‘আমার জীবনের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো।’
এই ভিডিও লুইসের সব স্বপ্ন ফিরিয়ে আনলো। এই ভিডিও চোখে পড়লো লন্ডনে ইসিবি কর্মকর্তাদের এবং গলে টিম ম্যানেজমেন্টের। ইসিবি ও টিম ম্যানেজমেন্ট আলোচনা করে লুইসকে ইসিবির একটা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দিলো। আর এই কার্ড নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে বসে খেলা দেখলেন।
লুইসের স্বপ্নপূরণের আরও বাকী ছিলো।
নির্জন গলে ড্রেসিংরুমের দিকে লক্ষ্য করে প্রথমে জো রুট সেঞ্চুরি উদযাপন করলেন। এরপর ঠিক মনে করে লুইসের দিকে ফিরে ব্যাট দেখালেন। এখানেই শেষ নয়। ম্যাচ শেষে রুট ফোনে লুইসের সাথে কথাও বলেছেন। গলে পরের টেস্টেও লুইস থাকছেন দলের পাশে।
এই অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে লুইসের। তিনি বলেন, ‘আমি কলম্বো শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং প্রার্থনা করেছি। আমি অনেকবার দেশে ফিরে যেবো ভেবেছি। কিন্তু এতোদূর এসে দলের খেলা না দেখেই ফিরে যাবো? অনেক কিছু করেছি এই দশ মাস ধরে। আশা ছাড়িনি। এবার আমার স্বপ্নপূরণ হয়েছে।’