ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ভারতীয় বিশ্বায়ন

বিগত মৌসুমগুলোতে আইসিসির এফটিপিতে আইপিএলের জন্য আলাদা সময় রাখা হয়েছে। অর্থের ঝনঝনানি তো আছেই, আইপিএল বিসিসিআইকে বিশ্বের সবচেয়ে অর্থশালী বোর্ডের পাশাপাশি এনে দিয়েছে ক্ষমতার সিংহাসন। ভারতীয় ক্রিকেট তাই এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর সাম্রাজ্য বাড়াতে কাজ শুরু করে দিয়েছে। 

নিকট ভবিষ্যতে ক্রিকেটও বোধহয় ফুটবলের পরিণতিই বরণ করতে যাচ্ছে। সারা বছর ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আর বছর অন্তর বিশ্বকাপ। গত কয়েক বছরে ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের উত্থানে আপাতদৃষ্টিতে এই হচ্ছে ক্রিকেটের ভবিষ্যত। ক্রিকেটের এই পরিবর্তনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারতীয় ফ্যাঞ্চাইজিরা সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আমিরাতের নতুন টি-টোয়েন্টি লিগের সবগুলো দলই কিনেছেন আইপিএলের ফ্যাঞ্চাইজিরা।  

সম্প্রতি জানা যায় ভারতীয় কোনো একটি ফ্যাঞ্চাইজি কেবল একটি দল নয়, পুরো ফ্যাঞ্চাইজি লিগের সবগুলো দলই কিনে ফেলতে চেয়েছিল। শেষ মূহুর্তে চুক্তিতে ভিত্তিমূল্যে একমত না হওয়ায় চুক্তিটি সম্পন্ন হয়নি, যদিও সেই ফ্যাঞ্চাইজিটি এখনো চুক্তি সম্পন্নের আশা ছাড়েনি। ক্রিকেটকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ভারতীয় ফ্যাঞ্চাইজি গ্রুপের এটাই প্রথম ধাপ। আরব আমিরাত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সবগুলো দলের পাশাপাশি ক্যারিবীয় টি-টোয়েন্টি লিগের তিনটি এবং আমেরিকার নতুন টি-টোয়েন্টি লিগের দলগুলোর মালিকানাতেও আছেন আছেন  ভারতীয় ফ্যাঞ্চাইজিরা।  

এসবের অর্থ কি দাঁড়ায়? বিশ্বের ফ্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে ভারতীয় মালিকানার এই আধিপত্য বিশ্বক্রিকেটে ভারতের আধিপত্যকেই নির্দেশ করে। বিগত মৌসুমগুলোতে আইসিসির এফটিপিতে আইপিএলের জন্য আলাদা সময় রাখা হয়েছে। অর্থের ঝনঝনানি তো আছেই, আইপিএল বিসিসিআইকে বিশ্বের সবচেয়ে অর্থশালী বোর্ডের পাশাপাশি এনে দিয়েছে ক্ষমতার সিংহাসন। ভারতীয় ক্রিকেট তাই এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর সাম্রাজ্য বাড়াতে কাজ শুরু করে দিয়েছে। 

ভারতীয় ফ্যাঞ্চাইজিগুলোকে বৈশ্বিকীকরণের প্রথম পথটা পথটা দেখিয়েছিল শাহরুখ খানের মালিকানাধীন কলকাতা নাইট রাইডার্স। ২০১৫ সালে তাঁরা কিনে নিয়েছিল সিপিএলের দল ত্রিনিদাদকে। ভারতীয় ফ্যাঞ্চাইজিগুলোর এক নতুন দিগন্তের দ্বার খুলে গিয়েছিল তাঁর ত্রিনিদাদ কেনার ফলে। আখেরে অবশ্য সিপিএল কতৃপক্ষেরই লাভ হয়েছে, শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছরে হুরহুর করে বেড়েছে সিপিএলের সমর্থকগোষ্ঠী। বেড়েছে টিভি সম্প্রচার, লভ্যাংশ বেড়েছে বহুগুণে।

কলকাতার এই স্ট্র্যাটেজি থেকেই শিক্ষা নিয়েছে বাকি ফ্যাঞ্চাইজিগুলো। তারা বুঝতে পেরেছে ভারতের বাইরেও ক্রিকেটের বড় বাজার আছে। তাদের এই প্রচেষ্টা আরও গতিশীল হয় যখন বিজয় মালিয়া, প্রীতি জিনতা, ওয়াদিয়া মোহিত বর্মণ তিনজনে মিলে সিপিএলের একটি দল কেনার চেষ্টা করেন। এছাড়া ২০১৭ সালে ছয় দল নিয়ে একবার ফ্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনের চেষ্টা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড। যদিও সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, সেবারেও তিনটি দলের মালিকানা জিতেছিল ভারতীয় ফ্যাঞ্চাইজিরা। 

এবারের আইপিএলের মেগা অকশনে প্রতিটি দল প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বিশ্বসেরা সব ক্রিকেটারদের দলে টেনেছে । বেড়েছে টিভি সম্প্রচার, স্টার স্পোর্টস আর ভিয়াকমের সাথে বিলিয়ন ডলারের নতুন চুক্তি সেরেছে বিসিসিআই। ছয় বিলিয়ন ডলারের এই চুক্তিতে লাভবান হয়েছে ফ্যাঞ্চাইজিগুলোও। আগামী মৌসুমগুলোতে কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন ডলার লাভের সম্ভাবনা দেখছে তারা। ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন দল লখ-নৌ সুপার জায়ান্টসের কর্ণধার সঞ্জিব গোয়েংকার কথাই ধরা যাক। 

প্রায় ৭০৯০ কোটি রুপি দিয়ে মালিকানা কিনেছেন, আগামী দশ বছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন করে ফি দিতে হবে বিসিসিআইকে। এর মানে হলো এই সময়টাতে তাঁর লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এরপরও গোয়েংকা থেমে থাকেননি, দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি লিগে কিনে নিয়েছেন ডারবান সুপার জায়ান্টসের মালিকানা। গোয়েংকার মতো ঝানু ব্যবসায়ীর এত এত বিনিয়োগ ইংগিত দেয় আগামী ক্রিকেট হতে যাচ্ছে ফ্যাঞ্চাইজির। 

আইপিএলের শুরুর দিকে ধারণা করা হত দলগুলোর আর্থিক লাভবানের চাইতে গ্ল্যামারের দিকেই বেশি আগ্রহ ছিল মালিকদের। সবাই ভেবেছিল আইপিএল হচ্ছে বলিউড তারকাদের আড্ডাখানা, যেখানে তারা স্টেডিয়ামে এসে নিজেদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাবে। কিন্তু এক যুগ পর এসে তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। লভ্যাংশের দিক থেকে আইপিএলের ধারেকাছে কোনো ফ্যাঞ্চাইজি লিগ নেই এবং ফ্যাঞ্চাইজি মালিকরাও স্বীকার করে নিয়েছেন বিদেশের লিগগুলোর বিনিয়োগ থেকে আগামী পাঁচ-ছয় বছরে লাভের সম্ভাবনা দেখেন না তারা। এই সময়টাতে তাদের ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৩০ থেকে ৭৫ কোটি রুপিতে। তবে আইপিএলের ফ্যাঞ্চাইজিদের এতে খুব একটা সমস্যা হবে না, নিজেদের দলগুলো থেকে পাওয়া লভ্যাংশ দিয়ে তারা খুব সহজেই এই সাময়িক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। 

চেন্নাই সুপার কিংসের সিইও কাশী বিশ্বনাথনের মতে, ‘টি-টোয়েন্টিই বিশ্ব ক্রিকেটের ভবিষ্যত হচ্ছে না। আমরা কোনোভাবেই নিজেদের বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। অন্যথায় আমরা নিজেদের আইপিএলেই সীমাবদ্ধ রাখতাম।’

তাদের এই আত্নবিশ্বাসের পেছনে কাজ করেছে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর। মুকেশ আম্বানি, এন শ্রীনিবাসন, শাহরুখ খান, সঞ্জীব গোয়েংকারা বিশ্বাস করেন অদূর ভবিষ্যতেই ভারতীয় ক্রিকেটাররা বাইরের লিগে খেলার অনুমতি পাবেন। বিসিসিআই বিষয়টিকে আগে উড়িয়ে দিলেও বর্তমানে বেশ গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করছে। ফ্যাঞ্চাইজি মালিকারা আশা করছে তারা বিসিসিআইয়ের গর্ভনিং কাউন্সিলকে বিষয়টা বুঝাতে পারবে। অন্তত যেন অবসর নেয়া ক্রিকেটাররা বাইরের টি-টোয়েন্টি লিগে খেলার সুযোগ পায়।

মহেন্দ্র সিং ধোনির কথাই ধরা যাক, তিনি যদি দক্ষিণ আফ্রিকার লিগে চেন্নাইয়ের ফ্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলেন তাহলে খুব সহজেই ভারতীয় দর্শকের মাঝেও আলোচনা ছড়াবে। ফলশ্রুতিতে বাড়বে টিভি সম্প্রচার সত্ত্ব ,লাভবান হবে ফ্যাঞ্চাইজি। দলগুলো এই নিশ্চিত মুনাফা কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইছে না। ফ্যাঞ্চাইজিরা শুরুতে কেবল ব্র্যান্ড ভ্যালু কিংবা সমর্থগোষ্ঠী বাড়ানোর দিকে নজর দিলেও বর্তমানে চাইছে নির্দিষ্ট কিছু ক্রিকেটারদের দীর্ঘমেয়াদের জন্য দলে ভেড়াতে। যাতে করে সেই ক্রিকেটারের ভক্তরাও নির্দিষ্ট দলের খেলা দেখেন।

ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো অবশ্য ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের এই উত্থানে মোটেই আশ্চর্য হয়নি। ট্রেন্ট বোল্টের হঠাৎ অবসর কিংবা টি- টোয়েন্টি লিগের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার অস্ট্রেলিয়া সফর বাতিল একটি জিনিসকেই নির্দেশ করে। দুটো ঘটনাতেই পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে আইপিএলের ফ্যাঞ্চাইজিগুলো। বোল্ট অবসর নেয়ার পরপরই স্বাক্ষর করেন দুবাই টি- টোয়েন্টি লিগে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ফ্যাঞ্চাইজি দলের সাথে। এটা কেবল শুরু, অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো বেশ কয়েকজন তারকা ক্রিকেটার কেন্দ্রীয় চুক্তি ছেড়ে ফ্যাঞ্চাইজি দলগুলোতে নাম লেখাবেন।  

এর প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোর উপরেও, ক্রিকেট বোর্ডগুলোও হয়তো ঝুঁকে পড়বে টি- টোয়েন্টি লিগ আয়োজনের দিকেই। বিগত বছরগুলোতে এই সমস্যা মহামারী আকার ধারণ করবে এমন ইংগিত থাকলেও আইসিসি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। খোলা চোখে সব দোষ ভারতের হলেও ব্যাপারটা এতটাও সহজ নয়। কারণ ভারতের ক্রিকেটের বেশিরভাগ অর্থের জোগানদাতা বিদেশি কোম্পানিগুলোই। 

স্টার স্পোর্টস আর ভায়াকম মিলে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নিয়েছে আইপিএলের সম্প্রচার সত্ত্ব আর দুটো কোম্পানিই বিদেশি মালিকানাধীন। স্টার স্পোর্টসের মালিকানা গ্রুপ আমেরিকান মিডিয়া গ্রুপ ডিজনি অন্যদিকে ভায়াকমের ৪০ শতাংশের শেয়ারের মালিক কাতারি এক ধনকুবের। তবে এটা সত্য ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকরাই ক্রিকেট বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি। পুঁজিবাদী এই সমাজে অর্থ কোনো সীমানা মানে না, কেবলই লভ্যাংশ দেখায়। 

দিনশেষে আইপিএলের দলগুলোর এই বিনিয়োগে লভ্যাংশের শতভাগ নিশ্চয়তা নেই। ইতোমধ্যেই গুঞ্জন উঠেছে ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় সিপিএল দল তুলে নেবে এক ফ্যাঞ্চাইজি। আগামী দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এক হওয়া কয়েকজন ব্যবসায়ীই নির্ধারণ করবেন আগামী দিনে ক্রিকেটের ভবিষ্যত। আপাতত বর্তমানে আইপিএলের ফলে ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের গণ জোয়ারে ক্রিকেট ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...