পরাজিত হওয়ার জন্য চ্যাম্পিয়নদের জন্ম হয় না। হয়তো তাঁদের ধ্বংস করা যায়, কিন্তু হারানো যায় না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে নিভৃত চরিত্র মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। যার যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে, তাঁর ব্যাটিং পজিশন নিয়েও তো নাড়াচাড়া কম হয়নি।
ওদিকে ইনজুরি যতবার তাসকিনকে ছিটকে দিয়েছে তিনি ততবার ফিরে এসেছেন। তবে দুজনই এবার একটু পিছনে হেঁটেছিলেন শেষবারের মত নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন বলে। স্বীকারের দিকে সিংহ ঠিক যেভাবে তেড়ে যায়। চ্যাম্পিয়নরা ঠিক যেভাবে ফিরে আসেন।
ঠিক ৫৮ বছর আগে নবম উইকেট জুটিতে ইংল্যান্ডের দুই ব্যাটসম্যান যোগ করেছিলেন ১৬৩ রান। তাঁদের আজ টপকে গেলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও তাসকিন আহমেদ। তারপর ছাড়িয়ে গেলেন জেপি ডুমিনি ও ডেইল স্টেইনের ১৮০ রানও। খুলনায় আবুল হাসানের সাথে রিয়াদের ১৮৪ রানের জুটিকেও রিয়াদ ছাড়িয়ে গেলেন এবার তাসকিনকে নিয়ে। নবম উইকেটে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি গড়লেন এই দুইজন।
২০১৯ সালের শেষ দিকে ভারতের সাথে দুই টেস্টে রিয়াদ ব্যর্থ হবার পরই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল হেড কোচ তাঁকে আর টেস্ট দলে চান না। পাকিস্তানের বিপক্ষে রান না পাওয়ায় বিশেষ করে হ্যাটট্রিক বলে নাসিম শাহকে উইকেট দিয়ে আসায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় রিয়াদের উপর দিয়ে। এবার হেড কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো নিজেই জানান বাংলাদেশ আর টেস্টকে রিয়াদকে ভাবছেনা। রিয়াদকে ফিরতে হলে নাকি আবার প্রমাণ করেই ফিরতে হবে।
এই বছর ফেব্রুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে রিয়াদকে আবার ফিরিয়ে আনার কথা শুনেছিলাম আমরা। তবে শেষ পর্যন্ত দলে ডাকা হয় সৌম্য সরকারকে। কেননা রিয়াদতো তখনো প্রমাণ করেননি কিছু। এবারো প্রাথমিক স্কোয়াডেই ছিলেন না রিয়াদ। শেষ মুহুর্তে হঠাতই ডেকে আনা হলো রিয়াদকে।
দেড় বছর পর টেস্ট ক্রিকেটে ফিরেই ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটি খেলে ফেললেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। নিজের আগের সর্বোচ্চ ১৪৬ রানকে টপকে খেললেন ১৫০ রানের হার না মানা এক ইনিংস। তাও আট নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নেমে।
রিয়াদ শেষ টেস্ট খেলেছিলেন গতবছরের শুরুতে পাকিস্তানের বিপক্ষে। এরপর করোনা ভাইরাসের কারণে অনেকটা সময় কোনো খেলাই মাঠে গড়ায়নি। ক্রিকেট আবার মাঠে ফিরলেও স্বাভাবিকভাবে টেস্টে সুযোগ পাননি রিয়াদ। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির কোনো ম্যাচও খেলেননি এই ব্যাটসম্যান। ঘরোয়া ক্রিকেট বলতে খেলেছেন শুধু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের সদ্য সমাপ্ত ঢাকা ডিভিশন প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ।
এখন কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোর কাছে আমার প্রশ্ন রিয়াদ টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করলেন কবে কিংবা কোথায়? নাকি ডিপিএলের পারফর্মেন্স দিয়েই টেস্ট দলে ফেরা যায়? যদি তাই হয় তবে টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করা মুনিম শাহরিয়ারকে টেস্ট দলে ডাকা হয়না কেনো কিংবা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রানের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়া তুষার ইমরানদের টি-টোয়েন্টি দলে ডাকা হয়না কেনো। এখন বলবেন সে আবার হয় নাকি। যদি না হয় তাহলে রিয়াদের বেলায় হলো কেন?
অথচ রিয়াদকে টেস্ট দল থেকে যখন বাদ দেয়া হয় তখন তাঁর দুইটা সিরিজ আগেও নিউজিল্যান্ডে তিনি ক্যারিয়ার সেরা ১৪৬ রানের ইনিংস খেলেন। এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেন তিনি। অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটে নিজের সেরা সময় পাড় করছিলেন এই ব্যাটসম্যান। তাহলে এত বছরের প্রমাণিত একজন ব্যাটসম্যানকে আপনি বাদ দেয়ার কথা ভাবলেন কী করে। তারপর আবার যদি রিয়াদের কাছে ফিরে আসবেন তাহলে তাঁকে আট নম্বরে খেলানো দুঃসাহস দেখান কী করে? শেষ কবে রিয়াদ আটে ব্যাট করেছিল সত্যি মনে পড়ে কী?
ওদিকে তাসকিনের ফিরে আসাটা রূপকথার মত। লম্বা সময় ইনজুরির কারণে ছিলেন জাতীয় দলের বাইরে। ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে ফিটনেসের প্রমাণ দিয়েও দলে জায়গা পাননি। সেদিন মিরপুরে অ্যাকাডেমি বিল্ডিংয়ের সামনে কান্না ভরা চোখে শুধু বলেছিলেন, ‘আমি ফিরে আসব।’
মার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই আবার জাতীয় দলে ফিরলেন তাসকিন। সেখানেই বোঝা যাচ্ছিল করোনার সময়টাকে ভালো ভাবেই কাজে লাগিয়েছেন কিংবা ফিরে আসার কথাটা মন থেকেই বলেছিলেন। তবে এর তীব্রতা বোঝা গেলো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে। পুরো টেস্টে নিজের গতি ধরে রেখে বোলিং করলেন নিখুঁত লাইন-লেন্থে।
গতকাল বাংলাদেশের যখন ৩০০ রানের আগেই অল আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তখন এসে ফিরে আসার সঙ্গী রিয়াদের সাথে হাল ধরলেন। আজ সবকিছু ভেঙে চুড়ে রিয়াদের সাথে গড়লেন ১৯১ রানের এই জুটি। খেললেন নিজের ক্যারিয়ার সেরা ৭৫ রানের ইনিংস। তবে এই ইনিংসে তাসকিনকে একবারো টিপিকাল টেলেন্ডারের মত ব্যাটিং করতে দেখিনি। কপিবুক কাভার ড্রাইভ খেলছেন কিংবা স্ট্যামের বল গুলোকে যেভাবে সলিড ডিফেন্স করেছেন মনে হচ্ছিল তাসকিন একজন নিখাদ ব্যাটসম্যান।
গত দুই বছর ফিটনেস নিয়ে যেই কাজ করেছেন কিংবা মানসিক স্বাস্থ নিয়ে যেই কাজ করেছেন সেই আত্মবিশ্বাস গুলো ফুটে উঠে তাসকিনের প্রতিটি শটে, প্রতিটি ডেলিভারিতে। ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলতে না পারার কান্না রূপ নেয় বাইশ গজের নাচে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের শততম টেস্ট খেলতে না পারার ব্যাথা রিয়াদ ফিরিয়ে দিয়েছেন ১৫০ রানে মহাকাব্যে। দুজনের মুখেই যেনো এক ভাষা, এক আহবান, চাইলেই ফিরে আসা যায়, চাইলেই আকাশটা ছোঁয়া যায়।
রেকর্ডও হয়েছে অবশ্যই। শেষ চার জুটিতে ৩৩৬ রান করেছে বাংলাদেশ, যা অবশ্যই টেস্টে বাংলাদেশের রেকর্ড। আগের সর্বোচ্চ ছিল ২১২, ২০১০ সালে হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ৬ উইকেটে ১৯৬ থেকে সেবার ৪০৮ অলআউট। সেখানেও বড় ভূমিকা ছিল রিয়াদের।। আটে নেমে তিনি করেছিলেন ১১৫, ছয়ে নেমে সাকিব ৮৭। এমনি এমনি রিয়াদকে স্বয়ং সুনীল গাভাস্কার ‘আট নম্বরে সেরা ব্যাটসম্যান’ বলেননি।