দেবতার দস্তানা

অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে গেলে উপমহাদেশীয় ব্যাটসম্যানরা যখন ফার্স্ট সেশনে ব্যাট হাতে নামতেন একটা কথা পিছন থেকে খুব শোনা যেত – ‘লিভ ইট টু গ্যালি’!

অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে গেলে উপমহাদেশীয় ব্যাটসম্যানরা যখন ফার্স্ট সেশনে ব্যাট হাতে নামতেন একটা কথা পিছন থেকে খুব শোনা যেত – ‘লিভ ইট টু গ্যালি’!

একবার এক বিখ্যাত উপমহাদেশীয় ব্যাটসম্যান ফার্স্ট সেশনে নামার পর এমন কিছু শুনে পিছন ঘুরে তাকালেন একবার৷ সেকেন্ড আর থার্ড স্লিপে দাঁড়িয়ে পন্টিং আর মার্টিন, গালি ফাঁকা। তাহলে? গালিতে কাকে কী ছাড়ার কথা বলছে ওরা?

ব্যাপারটা বুঝতে পারা গিয়েছিল অনেক পরে। পন্টিং হাসতে হাসতে বলেছিলেন স্টিভ ওয়াহ বা আমি যখনই ফার্স্ট সেশনে খেলা হতো একটা স্লিপ কম রাখলেই মিড অফ থেকে অন্য কেউ কিছু বললে প্রত্যেকবার চেঁচিয়ে বলতাম- ‘লিভ ইট টু গ্যালি!’ – গিলিকে অজি উচ্চারণে অনেকেই গালি ভেবে ভুল করতেন।

আসলে নতুন বলে নড়াচড়া বেশি হওয়ায় সকালে স্লিপ রাখা ছাড়া দ্বিতীয় কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না কোনো অধিনায়কের। কিন্তু যদি গ্লাভস হাতে দাঁড়ান স্বয়ং গিলক্রিস্ট?

ফার্স্ট স্লিপের অনেকটা কভার করার জন্য তাঁর চেয়েও নিরাপদ দুটো গ্লাভস যদি থাকে?

১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল। দীর্ঘ বারো বছর অস্ট্রেলিয় ক্রিকেট নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে সবার আগে উঠে এসেছে ওয়াহের নাম, তারপর পন্টিং। বোলিং নিয়ে কথা হলে তো লাইমলাইট একেবারে টেনে নিয়ে গেছেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরসম ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা-লি।

অথচ এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের একচালা থেকে রাজপ্রাসাদ হয়ে ওঠার সবচেয়ে চওড়া যে মার্গ, যার ওপর অনায়াসে হেঁটে গেছে ব্যাগি গ্রিন সভ্যতা, যার দুপাশে গোলাপ হয়ে ফুটেছে একটার পর একটা ট্রফি- সেই পথ নিয়ে সেভাবে আলোচনা হল কই?

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে দুটো জিনিস না থাকলে গোঁড়া সমর্থকরা তাকে প্রাথমিকভাবে পাত্তা দিতে চান না। এক, অর্থোডক্স ব্যাটিং টেকনিক আর দুই আগ্রাসী ও হিংস্র মানসিকতা। একবার স্টিভ স্মিথের কোচ বলেছিলেন গ্রেগ চ্যাপেলের দেশে স্মিথের ব্যাটিং-এর এই অদ্ভুত টেকনিক নিয়ে যে ও বেঁচে রইল এও এক আশ্চর্যের বিষয় কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্যের হল গিলিক্রিস্ট হলেন সেই যক্ষপুরীর বিশুপাগল যে অস্ট্রেলীয় স্লেজিং-এর ওপর দাঁড়িয়ে একযুগ ধরে ভালোবাসা বিছিয়ে দিয়েছেন গালিচায়।

নিঃশব্দে গিলি ঝাঁপিয়েছেন সবুজের কাছে, উঠে দাঁড়িয়েছেন ক্রিকেটের গন্ধ মেখে, মাটি ছুঁতে দেন নি নিজের ভালোবাসাকে,আগলে রেখেছেন নিরাপদ দস্তানায়। উইকেটকিপিং করার সময় তাঁর পাশে বরাবর থাকতেন পন্টিং, উদ্ধত চিকলেট যেভাবে স্লেজ করে শেষ করে দিত সামনের মানুষটিকে, গিলি সেই কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কেবল হাসতেন।তিনি জানেন একটা আচমকা ভুলেই ছিটকে আসবে সুযোগ, তার গ্লাভস সেই সুযোগ কুড়িয়ে নেবে নিশ্চিন্তে- স্লেজিং যার কাছে নিছকই বিলাসিতা!

শান্ত, হালকা একটা হাসি, আর সবুজের ওপর দাঁড়িয়ে অজি ক্রিকেটের সবচেয়ে চওড়া কাঁধ যেখান থেকে শুরু হচ্ছে মেলবোর্ণের বৃত্ত, যার দস্তানায় এসে মিলে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত স্টেডিয়ামের গর্জন।

রেকর্ডবুকের কাছে ফিরে গেলে গিলিক্রিস্ট সেখানে দাঁড়িয়ে হাসছেন নিজের খেয়ালে। ৪১৬ টা টেস্ট ডিসমিসাল,টেস্টে ব্যাটিং গড় ৪৭, স্ট্যাট গিলিকে শিরস্ত্রাণ দিয়েছে কিন্তু তারও ওপরে গিলি অজান্তেই অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণযুগের সবচেয়ে ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন। ৯৬ টি টেস্ট খেলেছেন গিলি, জয় পেয়েছেন ৭৩ টি টেস্টে, হেরেছেন ১১ টি। আরও আশ্চর্যের বিষয় নিজের কেরিয়ারে মাত্র দুটি টেস্ট সিরিজে গিলি নিজের ফর্মে ব্যাটিং করতে পারেননি, ২০০০-০১ ভারত সফর আর ২০০৫ ইংল্যান্ড সফর- দুটিতেই হেরে যায় অস্ট্রেলিয়া!

উইসডেন বলছে অস্ট্রেলিয়া দলে গিলির উপস্থিতি ৭৬ শতাংশ ম্যাচ জিতিয়েছে ব্র‍্যাডম্যানের দেশকে, আর শুধু টেস্ট নয়, গিলি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেললেন তিনটি বিশ্বকাপ, তিনটিতে চ্যাম্পিয়নরা হল যথাক্রমে- অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া!

ডাগ আউট থেকে ছটফট করতে করতে বেরিয়েছেন গিলক্রিস্ট, তাঁকে ধাওয়া করেছে সাফল্য, ২০০৩ বিশ্বকাপ বা তার পরবর্তী সময়ে কুমার সঙ্গক্কারাকে তাঁর সাথে তুলনা করা হত, তা ভুল নয়। সঙ্গার মতো ব্যাটসম্যানও যে বিরল প্রতিভা কিন্তু সত্যিই কি পৃথিবীতে যেদিন ক্রিকেটের ইতিহাস লেখা হবে সেদিন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান কিংবা ব্যাটসম্যান-উইকেটকিপার নামক কোনো অধ্যায়ের পাতা উল্টোবে একটা প্রজন্ম সেখানে গিলক্রিস্টের ওপর আর কাউকে রাখা সম্ভব?

তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনালে রান করলেন যথাক্রমে ৫৪, ৫৭, ১৪৯। ২০০৩ সালে পন্টিং ঝড় শুরু হবার আগেই যে মোমেন্টাম সেট করে দিয়েছিলেন গিলি-হেডেন।

একটা প্রজন্ম ধরে গিলক্রিস্ট রঙিন জার্সিতে নেমেছেন হেডেনের সাথে, নতুন বল পিটিয়ে ক্রিজে থিতু করে দিয়ে গেছেন পন্টিং-মার্টিন-বিভানদের ৷ ওয়াসিম আকরাম-ভ্যাস-শোয়েব আখতর-জাহিরের গোলাগুলি সামলেছেন।

ম্যাথু হেইডেন একবার বলেছিলেন, ‘পয়েন্টের পিছন দিকটায় বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের একটা ব্লাইন্ড স্পট থাকে, কাট করার সময় চোখ সরতে দেরী হয়ে যায়- একমাত্র গিলিকে দেখতাম কোনোদিন ভুল করেও ব্লাইন্ড স্পটে ওকে ধোঁকা দিতে পারেনি কোনো বোলার!’ পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে সাদা বলে গিলি দশ হাজারের কাছে রান করলেন ৯৮ স্ট্রাইকরেট রেখে।

অজি ক্রিকেটে কোনোদিন তারকার অভাব হয়নি, প্রজন্মের পিছনে প্রজন্ম দাঁড়িয়ে থাকে ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ মাথায় তুলে নেবার জন্য, কিন্তু বারো বছর কেটে গেলেও গিলক্রিস্ট ফিরে আসেন না। পন্টিং, হেইডেনের সাথে অনেকে তুলনা করেন স্মিথ-ওয়ার্নারের। কিন্তু গিলির বিকল্প একজনই,আজও, তিনি শুধুই অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। প্রজন্ম পেরিয়ে গেলেও ক্যাপ্টেন যার দিকে তাকিয়ে অনায়াসে বলে দিতে পারতেন, ‘লিভ ইট টু গিলি!’

এখনো সবুজের ভেতর হলুদ জার্সি গায়ে ছটফট করে ওঠেন গিলি, এখনো স্লিপের পাশ দিয়ে একটা বল ফসকালে ডানা ঝাপটে ওঠেন বৃদ্ধ জটায়ু। হয়ত অনেক দূরে বসে কোথাও শক্ত করে চেপে ধরেন কফির মাগটাই। কত কতদিন পর সে এক আশ্চর্য ক্যানভাসে সবুজ জোহানেসবার্গের বাউন্ডারির ধার ঘেঁষে নেমে আসছেন গিলি আর হেইডেন – অজি সভ্যতার বিশাল রেলগাড়ি বাঁক নিচ্ছে তার দুই ইঞ্জিনের ওপর ভর করে।

আবার কোথাও সবুজ কিংবা কমলা দস্তানা জুড়ে ফুটে উঠছে সাদা পাখির আশ্চর্য অবয়ব। সিডনির সকালে টুপি ঠিক করতে করতে উইকেট থেকে পিছোচ্ছেন অজি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দর পাইনগাছ। যার গায়ে লেগে আছে গ্রিন গ্রাস কন, ক্রিকেটকে ভালবেসে যিনি ঐ অস্ট্রেলিয়া দলের সদস্য হয়েও আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গিয়ে নিজেই ক্রিজ ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে পারেন। যিনি ২০০৮ সালে হাত থেকে মাত্র দুটো ক্যাচ ফস্কানোর অভিমানে ৯৬ টেস্টের মাথায় দাঁড়িয়ে ১০০ টেস্ট খেলার মোহ ছেড়ে অনায়াসে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিতে পারেন- তাঁর ঔদ্ধত্য দেখানোর জন্য দরকার লাগে না শব্দ, সমস্ত ঔদ্ধত্য জমা হয়ে থাকে দুটো গ্লাভসে, জমা হয়ে থাকে জীবন দর্শনে।

দেবতার দস্তানা জুড়ে আলোর খেলা শুরু হয়, শচীন থেকে লারা সবাই বন্দী সেখানে আর সেখান থেকেই অজি ক্রিকেটের শেষ সীমানা স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটু একটু করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link