- দৃশ্যপট-১
২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমি ফাইনাল ম্যাচ। ভারত-পাকিস্তান মধ্যকার সে ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়ে হঠাতই নজরে এলেন পাকিস্তানের এক তরুণ পেসার। বিরেন্দর শেবাগ থেকে শুরু করে বিরাট কোহলি, যুবরাজ সিং, ধোনি-এদের সবাইকে গতি আর আগ্রাসনের মিশেল বিধ্বস্ত করলেন। একে তো ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই এক মহাযজ্ঞ , তার উপর বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চ।
এমন এক ম্যাচে পারফর্ম তাই লাইমলাইটে আসতেও সময় লাগলো না সে পেসারের। অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে প্রথম ফাইফার পাওয়ার সে দিনে বিজীতদের দলেই থেকে গিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানকে হারিয়ে সেবার ফাইনালে উঠেছিল ভারত।
- দৃশ্যপট-২
ঠিক পরের বিশ্বকাপের কথা। ২০১৫ সালে হওয়া সে বারের বিশ্বকাপে তৃতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া। অ্যাডিলেডের সে ম্যাচে প্রথম ব্যাট করে সর্বসাকুল্যে স্কোরবোর্ডে ২১৩ রান জমা করে পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়ার যে ব্যাটিং লাইনআপ তাতে একপেশে এক ম্যাচ হওয়ারই সম্ভাবনা জেগেছিল সে সময়।
কিন্তু পাকিস্তান দলের হয়ে আবারো ত্রাতা হয়ে আবর্তিত হলেন সেই পেসার। যিনি আগের বিশ্বকাপেই ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। ৪ বছরের ব্যবধানে ক্যারিয়ার কিছুটা সমৃদ্ধির দিকে এগিয়েছে। আগের চেয়ে বলের ধার বেড়েছে। আর আগ্রাসন তো আগে থেকেই ছিল। এবার সেই পেস আর আগ্রাসনের আঁচটা দেখা মিলল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও। অজি ব্যাটারদের বিপক্ষে তিনি সেদিন একের পর এক যেন গোলা ছুড়ছিলেন।
দলীয় ৫৯ রানের মাঝে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার তছনছ করে দেন তিনি। যে শেন ওয়াটসন বাউন্সার বল অবলীলায় পুল করে ছক্কা হাঁকান সেই ওয়াটসন তার বল ঠিক মতো বুঝতেই পারছিলেন না। একের পর বাউন্সারে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যান তিনি। এর মাঝে আবার স্লেজিংয়েরও শিকার হন তিনি। দুর্দান্ত সেই স্পেলের পরও অস্ট্রেলিয়া সেদিন জিতেছিল। কিন্তু অ্যাডিলেডের মাটিতে বোলিংয়ের অমন আগ্রাসন বেশ আলোচনায় এসেছিল তখন। ক্রিকেট গ্রেট স্বয়ং ব্রায়ান লারা পাকিস্তানের এ বোলারের প্রশংসা করেছিলেন।
এ দুই দৃশ্যপটের সাথেই মিশে আছে ওয়াহাব রিয়াজের নাম। ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট কিংবা শেন ওয়াটসনকে বাউন্সার দিয়ে হিমশিম খাইয়ে দেওয়া- দুই দৃশ্যপটেরই নায়ক এই বাঁহাতি পেসার। সময়ের ব্যবধানে বয়স বেড়েছে। তারুণ্য ফেলে এসেছেন। পাকিস্তানের হয়ে ক্যারিয়ারটাও তেমন বিশেষ কিছুতে রূপান্তর করতে পারেননি। জাতীয় দল থেকে ছিটকে গেছেন প্রায় বছর তিনেক হলো।
কিন্তু একজন ক্রিকেটারের পারফর্ম করার মঞ্চ তো আর শুধু জাতীয় দল নয়। ওয়াহাব রিয়াজও তাই বল হাতে আগ্রাসন চালিয়ে গেছেন ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক ক্রিকেটে। করাচি কিংস থেকে শুরু করে পেশোয়ার জালমি কিংবা সাসেক্স থেকে সারে, ডার্বিশায়ার, গল গ্লাডিয়েটর্সসহ প্রায় গোটা বিশেক দলের হয়ে পা মাড়িয়েছেন।
সেই ধারাবাহিকতায় এবার বিপিএলে খেলছেন খুলনা টাইগার্সের হয়ে। বয়স ৩৭ পেরিয়েছে। পেসারের জন্য এই বয়সই ঢের। কিন্তু ওয়াহাব রিয়াজের জন্য সেটাও যেন ক্রান্তিলগ্ন নয়। বয়স শুধু একটা সংখ্যা- এই আপ্ত বাণীকে প্রমাণ করে এক রকম বুড়ো হাড়ের ভেলকিই দেখালেন ওয়াহাব রিয়াজ। এ বারের আসরে নিজের চতুর্থ ম্যাচে এসে একাই নিলেন ৪ উইকেট। ওয়াহাব রিয়াজের এ বোলিং দ্যুতিতে খুলনাও পেল প্রথম জয়ের দেখা।
ওয়াহাব রিয়াজ ফুরিয়ে যাননি- এমন কিছুর শিরোনাম যোগে আলোচনার টেবিলে আসতে ওয়াহাব রিয়াজের এমন একটা পারফরম্যান্সেরই দরকার ছিল। সেটা তিনি যে একদমই পারছিলেন না তেমনটা নয়। তবে সামর্থ্যের জানান দেওয়ার মতো দুর্দান্ত কিছু একটার প্রয়োজন ছিল।
রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে বল হাতে ঠিক তেমনটাই করে দেখালেন ওয়াহাব রিয়াজ। ৪ ওভার বল করেছেন। মাত্র ১৪ রান দিয়ে কিপ্টে বোলিংও করেছেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ওয়াহাব রিয়াজ তাঁর ৪ উইকেটের ৩ উইকেটই নিয়েছেন শেষ ওভারে। কিন্তু শুরুর দিকে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে রংপুরকে চেপে ধরার কাজটা আজ তিনি ভালভাবেই করেছেন। নিজের করা প্রথম ৩ ওভারে দিয়েছেন মাত্র ৭ রান।
নিজের ৪ উইকেট পাওয়ার দিনে ম্যাচসেরার পুরস্কার অবধারিতভাবে গিয়েছে তাঁরই হাতে। তবে আরেকটি মাইলফলক ছোঁয়ার একদম কাছে চলে গেলেন তিনি। আর তিন উইকেট নিলেই স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৪০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করবেন ওয়াহাব রিয়াজ।
এই মুহূর্তে ওয়াহাব রিয়াজের জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে যে বয়সের এসে অনেক পেসার ক্রিকেট থেকে গুটিয়ে নেন সেখানে তিনি খেলে যাচ্ছেন দুর্দান্ত গতিতে। আবার পারফর্মও করছেন। দিনশেষে এই সব ব্যাপারগুলোই তো নজর কাড়ে। কিছুটা বিস্ময়েও ভাসায় বটে। বুড়ো হাড়ের ভেলকি, আর যাই হোক নিত্যদিনের ঘটনা নয়।