অজিত আগারকার, সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ

২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন আগারকার, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মেলবোর্নে ৬ উইকেট নিয়েছেন, দুদিকে চমৎকার সুইং করাতেন, ততদিনে রিভার্স সুইংটাও রপ্ত করেছেন বেশ, শুরুর দিকে নিয়মিত ১৪০ কিমি+ গতিতে বোলিং করতেন, ডেথ ওভারে ইয়র্কার কিংবা স্লোয়ারের ভেরিয়েশন রাখতেন আর কী চাই? কিন্তু এসবের পরেও একজন বোলারের আরেকটা বড়ো জিনিস দরকার পড়ে, সেটা হলো ধারাবাহিকতা। সেই ‘ধারাবাহিকতা’ নামের শব্দটিই অজিত আগেকারের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতার জায়গা।

রাজার ঘরে যে ধন নেই টুনির ঘরে সে ধন আছে। প্রশ্ন হলো হঠাৎ রাজা আর টুনিকে টেনে আনার কী হলো? ধরে নেওয়া যাক ব্যাটিং এর দিক থেকে শচীন টেন্ডুলকারকে যদি রাজা আর তাঁর দীর্ঘ দিনের বন্ধু তথা সতীর্থ অজিত আগারকারকে যদি টুনি বলা যায়, তাহলে কী এমন ব্যাটিং রেকর্ডের মহা বিস্ময় বা ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে অজিত আগারকারের মধ্যে যা শচীনের ও নেই?

লর্ডসে টেস্ট সেঞ্চুরির ঐশ্বর্য আছে শচীনের?

উত্তর হচ্ছে না নেই, কিন্তু অজিত আগারকার হলেন গুটি কয়েক ভারতীয়র মধ্যে একজন যিনি লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তুলে বসে আছেন, তাও আবার বল হাতে নয়, ব্যাট হাতে! ২০০২ সালে ভারতের ইংল্যান্ড সফরে লর্ডসে হেরে যাওয়া সেই টেস্ট ম্যাচে অনবদ্য একটা ১০৯ রানের ঝলমলে ইনিংস সেবার খেলে গিয়েছিলেন আগারকার।
এই সেই আগারকার একটা সময়ে যাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল আবার ‘বোম্বে ডাক’।

কারণ – সেটা ভাবলে এখনও নির্ঘাত লজ্জায় পড়বেন আগারকার, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টানা ৭টা ইনিংসে রানের খাতাই খুলতে পারেননি, তার মধ্যে চারবার আবার প্রথম বলেই ব্যাট বগলে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরেছেন। ব্যাট হাতে আসলে বরাবরই ‘আনপ্রেডিকটেবল’ ছিলেন আগারকার। তবে টেস্ট ক্রিকেটে লর্ডসে সেঞ্চুরি করা লোককেই একদিনের ক্রিকেটে পিঞ্চ হিটার হিসেবে অনেক সময়ই কাজে লাগানো হয়েছে।

২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেবার ভারতে এলো, জামশেদপুরের কিনান স্টেডিয়ামে অনবদ্য ৯৫ রানের একটা ইনিংস খেলেছিলেন ৩ নম্বরে নেমে। রাইট – সৌরভ তখন অনেক সময়ই পিঞ্চ হিটার হিসেবে কখনো আগারকারকে ৩ নম্বরে বা হরভজনকে ৪ নম্বরে পাঠাতেন।

সে যাক, পিঞ্চ হিটার ছাড়াও শেষ দিকে ৮ নম্বরে নেমে দলের রানের গতি বাড়াতে স্লগ ওভারেও কিন্তু আগারকার ভরসার হাত ছিলেন, সে শারজায় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১২ বলে ২৬ রানের ইনিংস বা গোয়ালিওরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১০ বলে ২২, এরকমই সব ক্যামিও ইনিংস আগারকারের ব্যাট থেকে তখন মাঝে মাঝেই আসতো।

আর যদি বলেন একদিনের ক্রিকেটে ভারতে সবচেয়ে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি কার? সেটার উত্তরেও কিন্তু অজিত আগারকার নামের মুম্বাইয়ের রোগা সোগা ছেলেটার নামই আসবে।

এতক্ষণ তো আগারকারের ব্যাটিং নিয়ে বেশ কচকচানি হলো, কিন্তু আগারকারের আসল পরিচয় তো ভুললে হবে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগারকারের উত্থান বড়োই চমকপ্রদ। প্রথম কয়েকটা ওয়ান ডে টুর্নামেন্টে (তখন ত্রিদেশীয় সিরিজই বেশি হতো) বল হাতে আগুন ছুটিয়ে বিশ্বের নজর কাড়তে শুরু করলেন। একদিনের ক্রিকেটে ভারতের দ্রুততম ৫০ উইকেট শিকারীর তালিকায় চোখ বোলালে, এখনও প্রথম নামটাই অজিত আগারকারই আসবে। কিন্তু দিন তো চিরকাল সমান যায়না।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের সময় থেকে ফর্ম খারাপ হতে থাকলো। কিন্তু ২০০৭ সালে শেষবারের মতো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলা অবধি বেশিরভাগ সিরিজে বা টুর্নামেন্টে ভারতীয় দলে অজিত আগারকার নামটা প্রায় বাঁধাধরা, থাকতোই। এর মধ্যে ২০০৩ বিশ্বকাপে দলে থাকলেও একটা ম্যাচেও সুযোগ মেলেনি আর ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত দ্রুত বিদায় নেওয়ায় খুব বেশি খেলার সুযোগও পাননি।

বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কিংবা এশিয়া কাপের মতো টুর্নামেন্টে কোনোদিনই ভালো পারফরমেন্স না দেখাতে পারলেও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগারকারের পারফরমেন্সকে আপনি কোনোদিনই অস্বীকার করতে পারবেননা। ১৯১ ওয়ানডেতে ২৮৮ টা উইকেট, ২৮ এর কাছাকাছি গড় আর ৫ ইকোনমি রেটে, এ কিন্তু বিশ্বের অনেক তাবড় তাবড় বোলারের স্ট্যাটিসটিক্স খুললেও দেখা যাবে না।

২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন আগারকার, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মেলবোর্নে ৬ উইকেট নিয়েছেন, দুদিকে চমৎকার সুইং করাতেন, ততদিনে রিভার্স সুইংটাও রপ্ত করেছেন বেশ, শুরুর দিকে নিয়মিত ১৪০ কিমি+ গতিতে বোলিং করতেন, ডেথ ওভারে ইয়র্কার কিংবা স্লোয়ারের ভেরিয়েশন রাখতেন আর কী চাই? কিন্তু এসবের পরেও একজন বোলারের আরেকটা বড়ো জিনিস দরকার পড়ে, সেটা হলো ধারাবাহিকতা। সেই ‘ধারাবাহিকতা’ নামের শব্দটিই অজিত আগেকারের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতার জায়গা।

ব্যাটিংয়ের আলোচনার সময় আগারকার সম্পর্কে একটা শব্দ বলা হয়েছিল – ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। বোলার আগারকার সম্পর্কেও সেই শব্দটা আবার বসাতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কোনো ম্যাচে বল হাতে ৪ উইকেট নেওয়ার পরের ৩ টে ম্যাচে এলোমেলো বোলিং করা, অকাতরে রান বিলিয়ে দেওয়া আগারকারকে দেখাটাই ছিল সেকালের দস্তুর। উইকেট নিয়মিত নিলেও দরাজ হস্তে রান বিলিয়ে ভারতের বহু ম্যাচই কঠিন করেছেন আগারকার।

তাই ২৮৮ ওয়ান ডে উইকেট তাঁর পকেটে থাকলেও একদিনের ক্রিকেটে ভারতের সেরা একাদশ তৈরী করতে খুব বেশি মানুষের আগারকার নামটা কিন্তু মাথায় আসবে না, কিংবা ওয়ান ডে ক্রিকেটের গ্রেট দের তালিকাতেও ফেলবেন না, তার অবশ্যই একটা বড়ো কারণ বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে নিষ্প্রভ থাকা।

এতো কিছুর পরেও আগারকার হলেন সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও একটা লড়াই এর নাম। ২০০৩ এর অ্যাডিলেড টেস্টে ঐতিহাসিক জয় সেটাও কিন্তু মুম্বাইয়ের এই ডানহাতির অসম্ভব ও অপ্রত্যাশিত ৪১ রানে ৬ উইকেটের স্পেলটা না থাকলে হয়তো সম্ভবই হতো না, যতই দ্রাবিড় অতিমানবীয় ব্যাটিং ঐ টেস্টে করুন। আগারকারের হাত থেকে টেস্ট ক্রিকেটে আর কস্মিনকালেও অমন একখানা স্পেল আর বেরোয়নি।

এজন্যই আগারকারকে কেউ স্কোয়াড থেকে দূরে সরাতেও পারেননি আবার তিনিও পারেননি সব ক্যাপ্টেনের ভরসার পাত্র হতে। আজকের শামি বা বুমরাহকে আপনি চোখ বন্ধ করে যতটা ভরসা করতে পারবেন, তা কী কোনোদিনও করেছেন আগারকার কে? উত্তর হচ্ছে না। অজিত আগারকার কোনোকালেই তাই বোধহয় ‘ডিপেন্ডেবল’ হতে পারেননি, ‘আনপ্রেডিক্টেবল’-ই থেকে গেলেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...