অলরাউন্ডারদের ওয়ার্কলোড: আশির চতুষ্টয়

নি:সন্দেহে বলা যায়, এঁদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি ক্রিকেট খেলেছেন কপিল দেব। এছাড়া শতাংশের হিসাবে দলের খেলা টেস্ট ম্যাচের সবচেয়ে বেশি খেলেছেন কপিলই। তিনি তাঁর সময়কালে হওয়া ১৩২ টেস্টের মধ্যে ১৩১ টেস্ট খেলেন। হ্যাডলি তার পর (৮৬%)। ইমরান ও বোথাম অনেক পিছিয়ে-যথাক্রমে ৬৩.৭৭% ও ৬৫.৩৮% । এবার দেখে নেবো, ম্যাচ প্রতি ও বছর প্রতি বলের গড়ে কে কোথায় দাঁড়িয়ে।

একজন অলরাউন্ডারকে মাপার সবচেয়ে জুতসই মাপকাঠি কি হতে পারে? ব্যাপারটা নির্ধারণ করা সহজ নয়। এখনো অব্দি সবচেয়ে জনপ্রিয় মাপকাঠি হলো ব্যাটিং ও বোলিং গড়ের আঙ্কিক তফাৎ। কিন্তু সেই মাপকাঠি কি সব উত্তর দেয়? জানি না। তাই আমি নিজের মতো করে একটা অনুশীলন করার চেষ্টা করেছি অলরাউন্ডারদের নিয়ে। আজ সেই অনুশীলনের ষষ্ঠ পর্ব।

আগেই বলে রাখি, আমি অল-রাউন্ডার নির্বাচন করার সময় শুধু মাত্র তাঁদেরই বেছে নিয়েছি যাঁদের কমপক্ষে ২০০০ রান ও ১০০ উইকেট রয়েছে। এই অনুযায়ী, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে খেলোয়াড় দাঁড়াচ্ছেন ৩১ জন। এই পরিসংখ্যানের সময়সীমা গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর অবধি।

আজকের পর্বেও আলোচনা করবো খেলোয়াড়দের ওয়ার্কলোড নিয়ে। কিন্তু তার আগে গত পর্বের একটা ছোট্ট হিসেব করে নেই। গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছি বোলিং ওয়ার্কলোড নিয়ে। কিন্তু কপিল, বোথাম, ইমরান ও হ্যাডলি সেই আলোচনা থেকে বাদ পরে যান। আজ তাঁদের পরিসংখ্যান গুলো আগে দেখে নি। প্রথমেই দেখে নি, বছরে গড়ে কে কতগুলো টেস্ট খেলতেন।

  • কপিল দেব – ৮.১৮৮
  • ইয়ান বোথাম – ৬.৮০০
  • ইমরান খান – ৪.৪০০
  • রিচার্ড হ্যাডলি – ৫.০৫৯

কাজেই নি:সন্দেহে বলা যায়, এঁদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি ক্রিকেট খেলেছেন কপিল দেব। এছাড়া শতাংশের হিসাবে দলের খেলা টেস্ট ম্যাচের সবচেয়ে বেশি খেলেছেন কপিলই। তিনি তাঁর সময়কালে হওয়া ১৩২ টেস্টের মধ্যে ১৩১ টেস্ট খেলেন। হ্যাডলি তার পর (৮৬%)। ইমরান ও বোথাম অনেক পিছিয়ে-যথাক্রমে ৬৩.৭৭% ও ৬৫.৩৮% । এবার দেখে নেবো, ম্যাচ প্রতি ও বছর প্রতি বলের গড়ে কে কোথায় দাঁড়িয়ে।

ফরম্যাট: ম্যাচ প্রতি গড়/বছর প্রতি গড়

  • কপিল দেব – ২১১.৭৬/১৭৩৩.৭৫
  • রিচার্ড হ্যাডলি – ২৫৪.৮৬/১২৮৯.২৯৪
  • ইয়ান বোথাম – ২১৩.৮৭/১৪৫৪.৩৩৩
  • ইমরান – ২২১.১১/৯৭২.৯০০

কাজেই এটা পরিস্কার, যে গোটা ক্রিকেট জীবন জুড়ে, সবচেয়ে বেশি বোলিং ওয়ার্কলোড নিয়েছেন কপিল। ইমরান বহু ম্যাচ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন। হ্যাডলি নিজের ক্রিকেট জীবনের মাত্র ১৯.৭৬% (১৭/৮৬) ম্যাচ খেলেছেন উপমহাদেশ ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, যেখানকার আবহাওয়া ফাস্ট বোলিং বা লম্বা স্পেলের জন্যে প্রতিকূল বলা যায়।

বোথাম ও ইমরানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা যথাক্রমে ১৭.৬৫ % ও ৬৭.০৪% । কপিল দেবের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ৭২.৫২%। সকলের চেয়ে বেশি ক্রিকেট খেলা সত্ত্বেও, কপিলের এই সংখ্যাগুলো বোঝায় ঠিক কতটা পরিশ্রমী ক্রিকেটার ছিলেন তিনি।

এবার ফিরে আসা যাক আজকের পর্বে। আজকে আলোচনা করবো, ব্যাটিং ওয়ার্কলোড নিয়ে। ব্যাটিং ওয়ার্কলোডের ক্ষেত্রেও আমি গড়ে টেস্ট প্রতি কে কত বল খেলেছেন তা বার করে নিয়েছি। কিন্তু আগেই জানিয়ে রাখি, ৩১ জনের মধ্যে মাত্র ১৮ জনের ক্ষেত্রে এই হিসাব পাওয়া গেছে।

আমি গত পর্বেও জানিয়েছিলাম, আজও জানাচ্ছি, যে কারুর কাছে যদি এই হিসাব থাকে, তবে আমাকে দিয়ে সাহায্য করবেন। এখানে যদিও একটা উপায় আছে, কিন্তু তা আঙ্কিক ভাবে ফুলপ্রুফ নয় বলে সেটা নিয়ে আলোচনা করা এই লেখায় নিষ্প্রয়োজন। তাহলে, আগে দেখে নেওয়া যাক টেস্ট প্রতি বল খেলার নিরিখে কে কোথায় রয়েছেন। এই ব্যাপারে প্রথম পাঁচ জন হলেন –

  • জ্যাক ক্যালিস – ১৭৪.১১
  • বেন স্টোকস – ১১২.৯০
  • কার্ল হুপার – ১১২.৩৭
  • সাকিব আল হাসান – ১১১.১৪
  • ক্রিস কেয়ার্নস – ৯৩.৭৯

প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানের মধ্যে ফারাক এতো বেশি কারণ সোবার্স কত বল খেলেছেন, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। সোবার্স ও ক্যালিস, এই দুজনেই প্রথম দুইতে থাকবেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই টেস্ট প্রতি বল খেলার হিসাব ও বল করার হিসাব মেলালে সম্ভবত ওয়ার্কলোডের সঠিক মূল্যায়ন করা যাবে। কিন্তু সে বিষয়ে আসছি পরে।

আগে এই হিসাব থেকে কি তথ্য পাওয়া গেলো সেটা দেখে নি। এই তালিকায় প্রথম পাঁচ জনের প্রত্যেকেই মোটামুটি ১ থেকে ৬ নম্বরে খেলতেন। ক্যালিস মাত্র ৪.২৮% ইনিংস খেলেছেন ৬ বা তার নিচে। বাকিদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হলো-স্টোকস-৬৬.৯২%, হুপার-২৪.২৭%, সাকিব-৩.১২৫%, কেয়ার্নস-৯৬.১৫%। স্টোকস ও বিশেষ করে কেয়ার্নস টপ-অর্ডারে খুব কম খেলেও যে টেস্ট প্রতি গড়ে এতো বল খেলতেন, এতেই তাঁদের ব্যাটিং মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়।

এবার দেখে নি এই নিরিখে শেষ পাঁচ জন কারা –

  • হরভজন সিং – ৩৩.৩২
  • স্টুয়ার্ট ব্রড – ৩৫.৪৭
  • শেন ওয়ার্ন – ৩৭.৭২
  • মিশেল জনসন – ৪৮.৪৪
  • অনিল কুম্বলে – ৪৮.৯০

প্রসঙ্গত, গোটা তালিকায় শুধু এই পাঁচজন টেস্ট প্রতি বল খেলায় ৫০ এর কম রয়েছেন।

এবার আবারো, গড়ে বছর প্রতি টেস্ট ও টেস্ট প্রতি বলের সংখ্যা গুন করে, বছর প্রতি বল খেলার যে হিসাব বার করেছি, সেই অনুযায়ী দেখে নি, কার অবস্থান কোথায়।

প্রথম পাঁচ জন হলেন –

  • জ্যাক ক্যালিস – ১৬০৫.৭২
  • বেন স্টোকস – ৯৪৫.৫০
  • কার্ল হুপার – ৮৮১.৬৯
  • মঈন আলী – ৭৭৭.৪৩
  • শন পোলক – ৫৯৯.৮৩

আর শেষ পাঁচ জন হলেন –

  • হরভজন সিং – ২০১.৮৮
  • অনিল কুম্বলে – ৩৫৮.৬১
  • শেন ওয়ার্ন – ৩৬৪.৬৭
  • ক্রিস কেয়ার্নস – ৩৮৭.৬৭
  • স্টুয়ার্ট ব্রড – ৩৯০.১৫

আবারো দেখা যাচ্ছে, যদিও টেস্ট প্রতি গড় বল খেলার সংখ্যায় কেয়ার্নস প্রথম পাঁচে, কিন্তু বছর প্রতি গড় বল খেলায় কেয়ার্নস শেষ পাঁচে।

এবার ওয়ার্কলোড নিয়ে সবচেয়ে জরুরি আলোচনা টা করবো। ব্যাটিং বা বোলিং যেকোনো একটা দিয়ে ওয়ার্কলোডের প্রতি সুবিচার হয়না বলেই মনে করি। কাজেই ওয়ার্কলোড ইন্ডেক্স নামের একটি সূচক আমি তৈরি করেছি। অত্যন্ত সহজবোধ্য এই সূচকে ব্যাটিং ও বোলিংয়ের মিলিত ওয়ার্কলোডের একটা হিসাব পাওয়ার চেষ্টা করেছি।

একটা উদাহরণ দেই। ধরে নিচ্ছি সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের নাম রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তিনি গড়ে টেস্ট প্রতি ২৭৫.৮৬ বল করেন এবং ৬১.৬১ বল খেলেন। যদি বছর প্রতি গড় টেস্টের সংখ্যার সাথে এই দুই সংখ্যাকে গুন করি, তাহলে আমরা পেয়ে যাবো অশ্বিন গড়ে প্রতি বছর কতগুলি বল করেন এবং খেলেন। অশ্বিন গড়ে প্রতি বছর খেলেন ৭.৮৮৯ টেস্ট। তাহলে অশ্বিনের ক্ষেত্রে বছর প্রতি বল করা ও খেলার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে যথাক্রমে ২১৭৬.২২২ ও ৪৮৬.০০। ওয়ার্কলোড ইনডেক্স হলো এই দুই সংখ্যার যোগফল।

অশ্বিনের ক্ষেত্রে তা দাঁড়াচ্ছে ২৬৬২.২২২। যদিও এই মেথড আঙ্কিক ভাবে ফুলপ্রুফ নয়, কারণ যাঁরা মূলত বোলার, তাঁদের ক্ষেত্রে কিছুটা স্কিউনেস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এই ইন্ডেক্সের। আবার সকলের জন্যে যেহেতু বল খেলার সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, কাজেই পুরোপুরি সঠিক মূল্যায়ন আমি দাবি করবো না। পরবর্তীতে এই ইনডেক্স নিয়ে কাজ করার আরো ইচ্ছা রইলো।

এবার তবে দেখে নেয়া যাক এই নিরিখে প্রথম ও শেষ পাঁচ জন কারা

প্রথম পাঁচ জন –

  • শেন ওয়ার্ন – ৩০৭৮.৩৩৩
  • জ্যাক ক্যালিস – ২৭২৯.৭২২
  • রবিচন্দ্রন অশ্বিন – ২৬৬২.২২২
  • শন পোলক – ২৬২৯.২৫০
  • অনিল কুম্বলে – ২৬২৮.০৫৬

এখানে দেখার বিষয় হলো, ক্যালিস ও পোলক, দুজনেরই ওয়ার্কলোড ইনডেক্স প্রায় কাছাকাছি। অর্থাৎ একই দলে দুজন ভিন্ন ধারার অলরাউন্ডার ছিলেন যাঁরা প্রায় একইরকম খাটান দিতেন। যদিও পলক ক্যালিসের থেকে ৫৮ টেস্ট কম খেলেছেন। এর কারণ, তিনি ছিলেন ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার। ঠিক এইখানে কপিলের অমানুষিক ওয়ার্কলোড নিয়ে কথা বলা যায়।

তিনি ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার হয়েও ১৩১ টেস্ট প্রায় টানা ১৬ বছর ধরে খেলে গেছেন। তাও তো পলক তাঁর ক্রিকেটজীবনে ৬৩.৪৬% ইনিংস ৮ নম্বর বা তার নিচে খেলেছেন। আর কপিল সেখানে মাত্র ৩৫.৩৩% ইনিংস ৮ নম্বর বা তার নিচে খেলেছেন। কপিলের ব্যাটিংয়ে বলের হিসাব যদি পাওয়া যেত, হয়তো ওয়ার্কলোড ইনডেক্সে খুব ওপরের দিকে থাকতেন।

অপরজন যিনি খুব উপরের দিকে থাকতেন বলে মনে হয়, তিনি সোবার্স। কারণ তিনি বল করতেন টেস্ট প্রতি ২৩২.২৫, যা ক্যালিসের প্রায় দ্বিগুন। এবং ব্যাটের গড়ে তিনি ক্যালিসের চেয়ে এগিয়ে। সোবার্স খেলার ধরণে যদিও বা ক্যালিসের থেকে অনেকটাই আক্রমণাত্মক, তবু টেস্ট প্রতি গড়ে ৮৬.৩৬ করতে ১২০ থেকে ১৬০ এর মধ্যে কোথাও তাঁর টেস্ট প্রতি খেলা বল সংখ্যা থাকা উচিত। কিন্তু, যেহেতু হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না, তাই এ নিতান্তই অনুমানভিত্তিক।

যাই হোক, ওয়ার্কলোড ইনডেক্সের হিসাবে শেষ পাঁচ জন কারা, তা দেখে শেষ করবো আজকের পর্ব।

  • ক্রিস কেয়ার্নস – ১১৬৭.৫৩৩
  • সাকিব আল হাসান – ১৪৮০.৩০৮
  • জেসন হোল্ডার – ১৭৬৮.১৬৭
  • হরভজন  সিং – ১৮৮৩.০৫৯
  • অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ – ১৯২২.৫৪৫

এখানে এমন মনে করার কারণ নেই, যে এনারা গড়ে কম টেস্ট খেলেছেন, তাই এই নিরিখে পিছিয়ে। সাকিব ও কেয়ার্নস ছাড়া প্রত্যেকেই বছরে গড়ে ৬ বা তার বেশি টেস্ট খেলেছেন। এখানে যেহেতু ইমরান, কপিল ও হ্যাডলির টেস্ট ম্যাচে খেলা বলের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না, তাই তাঁদের নিয়ে আর আলাদা করে আলোচনা করলাম না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...