চোয়ালবদ্ধ লড়াইয়ের রং ‘লাল’

১৯৮৯-৯০। এখনো অবধি শেষবারের জন্য রঞ্জি জিতেছিল বাংলা। সম্বরণ ব্যানার্জির অধিনায়কত্বে। অঘোষিত নেতা ছিলেন অন্য একজন। তার ৬/৭ বছর আগে থেকেই মনের বাসিন্দা হয়ে গেছেন তিনি। তাঁর খেলা, ব্যবহার, মানবিকতা আর স্বচ্ছ লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য। ও হ্যাঁ, কলকাতার তাঁর ক্লাবের নাম ছিলো মোহনবাগান। তিনি অরুণ লাল।

আমার মতে, যার চেয়ে বড় ‘বাঙালি’ ক্রিকেটার খুব কমই দেখেছি জীবনে, তাঁকে নিয়ে এই লেখাটা। যিনি দিল্লীর লোক হয়েও দিল্লীর হয়ে খেলেছিলেন মাত্র চার বছর (১৯৭৭-৭৮ থেকে ১৯৮০-১৯৮১) আর বাংলার হয়ে খেলেছিলেন পনের বছর (১৯৮১-৮২ থেকে ১৯৯৫-৯৬)।

১৯৮৯-৯০। এখনো অবধি শেষবারের জন্য রঞ্জি জিতেছিল বাংলা। সম্বরণ ব্যানার্জির অধিনায়কত্বে। অঘোষিত নেতা ছিলেন অন্য একজন। তার ৬/৭ বছর আগে থেকেই মনের বাসিন্দা হয়ে গেছেন তিনি। তাঁর খেলা, ব্যবহার, মানবিকতা আর স্বচ্ছ লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য। ও হ্যাঁ, কলকাতার তাঁর ক্লাবের নাম ছিলো মোহনবাগান। তিনি অরুণ লাল।

ঐ রঞ্জিতেই অনেক সমস্যা ছিল সেবার বাংলা দলে। যার মধ্যে অরুণলাল-সম্বরণ ব্যানার্জী আর অরুণলাল-রাজা ভেঙ্কট সমীকরণ ছিল একদম দৃশ্যমান।তবু মাঠে নামার পরে সেসব সমস্যা মিলিয়ে গিয়ে শুধু চোয়াল চাপা লড়াইয়ের শপথে চাঙ্গা থাকত ‘টিম বাংলা’।

ওইবারের রঞ্জি ফাইনালে অরুণলালের ব্যাটিং আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। ওইরকম ‘আউট হব না’ মানসিকতা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সব সতীর্থর মধ্যে, যার ফলশ্রুতিতে দিল্লী সেবার ফাইনালে হার মানে কোশেন্টে। মানসিকতাই মস্ত সম্বল ছিল অরুণ লালের, টেকনিক ছাড়াও।

যার প্রতিফলন ১৬ টেস্টে ৭২৯ (সর্বোচ্চ ৯৩) বা ১৩ একদিনের ম্যাচে ১২৯ (সর্বোচ্চ ৫১) রানে ধরা নেই।তবু ৬টা টেস্ট অর্ধশতক আর একটা একদিন অর্ধশতক ছিল তার নামে। এটা বরং উজ্জ্বল তাঁর প্রথম শ্রেণীর ব্যাটিং পরিসংখ্যানে, যা দেখায় ১৫৬ ম্যাচে ২৪১ ইনিংসে ১০৪২১ রান (সর্বোচ্চ ২৮৭) আর তার মধ্যে ৩০টি শতরান আর ৪৩টি অর্ধশতক।

তারপর ক্রমে অবসর, একটু আড়াল, টিভি কমেন্ট্রি এবং এরপর হঠাৎ টিভি কমেন্ট্রি না করা। যা হয়, খবরে না থেকে মনে আছেন। ২৪ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে হঠাৎ তিনি আবার খবরে। বাংলা মিডিয়ায়। লড়াকু লোকটি লড়ে যাচ্ছেন চোয়াল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে (১৪ ঘন্টার দীর্ঘ অপারেশন যে লড়াইয়ের অঙ্গ ছিল)।

সেই চোয়াল, যা মাঝে মাঝেই খোঁদ বিসিসিআইয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল বলে অনেক বেশি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ১৬ টেস্ট আর ১৩ একদিনের ম্যাচে থেমে গিয়েছিল তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার। তারপর?

তারপর আর কি? চিরলড়াকু তিনি আরো শক্তিশালী চোয়াল নিয়ে ফিরে এলেন জীবনে এবং ক্রিকেটেও। গত দু’বারের বাঙলা ক্রিকেট দলের মেন্টর/হেডকোচ হয়ে। কথা বলতে এখনো কষ্টে তিনি। তবু হতশ্রী এবং আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বদীর্ণ বাঙলা ক্রিকেট দল তারই শরণাপন্ন হল, রঞ্জিতে ভাল কিছু করার জন্য। গতবারের আগেরবার পারেননি, কোয়ার্টার ফাইনালেও যায়নি সেবার বাংলা।

আর গতবারের চ্যালেঞ্জটা সামলানোও তার জন্য খুব কঠিন ছিলো। অফ ফর্মের মনোজ, সুদীপ, রমন, ঈশ্বরণকে সামলানো, বেসুরো অশোক ডিন্ডাকে সামলানো, একসূত্রে দলকে বাঁধা এবং সর্বোপরি ফিটনেসে চূড়ান্ত লেভেলে দলের প্রত্যেককে নিয়ে যাওয়া – এই সবকটা কাজ ঐশ্বরিক দক্ষতায় করে দেখালেন তিনি গতবার, ফাইনালে যাওয়া অবধি।

অনুষ্টুপ-মনোজ-ঈশান-মুকেশ-আকাশদীপ-শাহবাজদের সঙ্গে এই ভদ্রলোকের নাম একবার অন্তত: অস্ফুটে উচ্চারণ করেছিলেন অনেকেই, একবার অন্তত: অবচেতনেও অনেকেই মনে করেছিলেন এই লড়াইয়ের প্রতিশব্দ ভদ্রলোককে, পরপর রাজস্থান-পাঞ্জাব-কর্ণাটককে সরাসরি হারিয়ে বাংলার ফাইনালে যাওয়ার অদৃশ্য নায়ক হিসেবে।

অনেকের অনেক শুভেচ্ছা নিয়েও, তার আপ্রাণ লড়াইয়ের মানসিকতাটা। রমন-ঈশ্বরণ-অর্ণব-অনুষ্টুপ-মনোজ-ঈশান-মুকেশ-আকাশদীপ-শাহবাজদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েও গতবারের রঞ্জি ফাইনাল জিততে ব্যর্থ হয়ে রাজকোট থেকে বাংলার হয়ে রণজি ট্রফি নিয়ে ফিরে আসতে পারেন নি অরুণলাল, অল্পের জন্য।কিন্তু তার লড়াইটা অক্ষয় হয়ে থেকে গেছে, বরাবরের মতই।

এবার আইপিএল-কে প্রাধান্য দিয়ে বিসিসিআই-র রঞ্জি ট্রফিকেই কোতল করা, দীর্ঘ লকডাউন, অনুশীলনে ঘাটতি, চোট-আঘাতজনিত যোগফলে হাতে পড়ে থাকা এবারের সি কে নাইডু ট্রফি (মায়ের মৃত্যুতে মাঝপথে চলে যেতে হয়েছিল তাকে শিবির ছেড়ে, তারপরই এলিয়ে পড়া শুরু হয় বাংলার) আর বিজয় হাজারে ট্রফিতে বাংলার ব্যর্থতা আবার হয়ত ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে ফেলতে যাচ্ছে ‘লালজি’-কে, অনেককে বাঁচার সুযোগ করে দিতে।আপাতত খবর সেরকমই।

এই আশ্চর্য আবহাওয়াতেও, এই সঙ্কটেও ‘লালজী’ যেন থেকে যান তার মত করে, লড়াইয়ের প্রতিশব্দ হয়েই, নিজের জায়গা অটুট রেখে। তা না হলে, বাংলা ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য ‘অনন্ত শুভেচ্ছা’।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...