ভিলেন অথবা ভিক্টিম

একটা স্তব্ধতা। প্রথম যখন খবরটা জেনেছিল সবাই তখন নিশ্চয়ই সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে অনুভব করছিল এক শূন্যতা। এক বিশাল শূন্যস্থান তো ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে পৃথিবীর বুকে, ক্রিকেটের বিস্তৃত ময়দানে। ক্রিকেটের অন্যতম এক প্রফুল্ল প্রাণ যে হয়েছেন গত।

ঠিক তাঁর পর মুহূর্তেই সবার মনে হয়ত আরেকটি প্রশ্ন জেগেছিল। ঠিক কতটা গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস? কেননা গাড়ি দূর্ঘটনাইতো তাঁকে নিয়ে গেল দূর দেশে। সেখানে হয়ত ক্রিকেট নেই। থাকলে হয়ত তিনি সেখানটাও মাতিয়ে রাখবেন। তবে গাড়ির গতি যে ছিল শ্বাসরুদ্ধকর, তা বলে দেওয়া যায় কোন দ্বিধা ছাড়াই।

কেননা তিনি বরাবরই সখ্যতা গড়েছিলেন গতির সাথে। জীবন কিংবা বাইশ গজ অথবা গাড়ির স্টেয়ারিং হুইল। সবখানেই যেন তিনি হতে চেয়েছেন সবার সেরা। ছাপিয়ে যেতে চেয়েছেন সবাইকে। রোমাঞ্চ তো তাঁর সবসময়ের প্রিয়। বাইশ গজে ব্যাট আর দস্তানার অদ্ভুত তারতম্য তাঁকে আলাদা করত আর পাঁচটা খেলোয়াড় থেকে।

তিনি ছিলেন সদা ব্যস্ত। ব্যাটিং ক্রিজে দ্রুততার সাথে ব্যাট দিয়ে আঘাত করতে থাকতেন। যেন তাঁর আর অপেক্ষা সইছে না। তিনি যেন বোলারকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন। ‘দ্রুত বল কর, আমি সপাটে মারব।’ দ্রুতিই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম এক নিয়ামক। সজোরে ব্যাট চালিয়ে দ্রুত রান তোলা কিংবা টপাটপ দুই-চার গ্লাস মদ্যপান, তাঁর জীবনের সর্বক্ষেত্রেই গতির আধিক্য ছিল।

এই যেমন ক্রিকেটের উদাহরণই ধরা যাক। তিনি তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার তো ছিলেনই। ছিলেন সময়ের আগে জন্ম নেওয়া এক কিংবদন্তি। ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণে কি করে ব্যাট চালাতে হয় সেটা সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম আসর আসার আগেই যেন তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। হয়ত আরও কিছু সময় তিনি ক্রিকেট সমর্থকদের আনন্দে ভাসাতে পারতেন।

তবে তাঁর আর হয়ে ওঠে না। এক দশকের ক্যারিয়ারটা হঠাৎ করেই থমকে যায় ৩৪ বছর বয়সেই। তাঁর ব্যাটিং আলাদা এক মুগ্ধতার সৃষ্টি করত। তিনি একাধারে যেমন মারকাটারি ব্যাটার ছিলেন তেমনি ছিলেন শৈল্পিক ব্যাটার। আধুনিক এই টি-টোয়েন্টির যুগ শুরু হওয়ার আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে তাঁর খেলা গুটিকতক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পরিসংখ্যান দেখে যেন তাঁর বোঝারই উপায় নেই।

১৪টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। সেখানটায় তিনি রান তুলেছেন প্রায় ১৭০ স্ট্রাইকরেট। ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নেও এমন মারকুটেই ছিলেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। তবে এটা সবাই বিশ্বাস করতেন যে তাঁর মধ্যে আরও খানিকটা ক্রিকেট বাকি ছিল। তবে মাঙ্কিগেট কাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেটের খলনায়ক।

সে কাণ্ডে সাইমন্ডস ঠিক খলনায়ক ছিলেন কি না সেটা বলা মুশকিল। তবে তাঁর উড়নচন্ডী মনোভাব যেন তাকেই দোষারোপ করতে বাধ্য করেছে বারেবারে।  টিম মিটিং বাদ দিয়ে মাছ শিকার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে প্রকাশ্যে মদ্যপান ও রেডিও প্রোগ্রামে ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে গালমন্দ করা। এসবকিছু তাঁকে যেন খলনায়কের চরিত্রের দিখে ঠেলে দিতে শুরু করে।

তবে অস্ট্রেলিয়ার সে সময়ের অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের মত মাঙ্কিগেট কাণ্ডের পর থেকেই হারিয়ে যাওয়ার পথে হাটতে শুরু করেন সাইমন্ডস। সে কাণ্ডের পর থেকে তিনি যেন ক্রিকেট থেকে ক্রমশ মলিন হতে থাকেন। সদা উদ্দীপ্ত সাইমন্ডসের মানসিকতায় কেমন যেন এক স্থির ভাব চলে আসে। তিনি যেন ক্রিকেটটা আর ঠিক করে ধারণ করতে পারছিলেন না নিজের মধ্যে।

কতশত তিরস্কার সইতে হয়েছে তাঁকে। তা সইত পারাটাও তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও তিনি সময়ে সময়ে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে হাল ধরেছেন। শেষ যেবার তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে নেমেছিলেন সেদিনও যেন তিনি নিজের সেরাটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে ঐ যে একটা মানসিক ধাক্কা। সেটা আর কাটিয়ে ওঠা হয়নি। ভারতের আপামর জনতার কাছে তিনি ‘ভিলেন’ হয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন।

অদ্ভুতরকম এক প্রতিদান দিয়েই তিনি তাঁর ক্রিকেট খেলোয়াড়ি জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। ২০১১ সালে সাইমন্ডস শেষ যেবার ক্রিকেটের সবুজ প্রান্তরে নেমেছিলেন সেটা ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ। সে ম্যাচে সাইমন্ডস খেলেছিলেন ভারতীয় দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে। প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস। বিদায় বেলায় তিনি যেন কোন ক্ষোভ নেই তাঁর এমন এক বার্তাই দিয়ে যান ভারতীয় দর্শকদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link