একটি অলরাউন্ড স্বপ্নের অপমৃত্যু

শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার ক্যারিয়ারে ইনজুরির বাঁধনে বার বার আটকে না গেলে হয়তো বিশ্বক্রিকেটে অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারতেন। সেটা হয়নি, বরং তিনি বোলিংটা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। ব্যাট হাতেও জ্বলে ওঠাটা নিয়মিত নয়। বারবার পুরনো হ্যামস্ট্রিংয়ের ব্যাথা তাঁকে দলের বাইরে ঠেলে দেয়। তিনি আবারও ফিরে আসেন, গ্রেটদের কাতারে না গেলেও অন্তত লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

কিংবদন্তি চামিন্দা ভাসের ক্যারিয়ারের প্রায় শেষের দিকেই তখন। ওয়ানডেতে তখন একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডারের বেশ অভাববোধ করছিলো লঙ্কানরা। ঠিক তখনি ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ দাপট দেখিয়ে নির্বাচকদের নজর কাড়েন ২১ বছর বয়সী এক তরুণ।

২০০৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে সেই তরুণকে দলে ডাকা হলো। পারভেজ মাহরুফ, থিলান কান্দাবিরা তখন ওয়ানডে দলে খেললেও ঠিক সুবিধাজনক পারফরম্যান্স করতে পারছিলেন না।

২৮ নভেম্বর, ২০০৮।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫ ম্যাচ সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে মুখোমুখি লংকানরা। ইতোমধ্যেই ৩-০ তে জয় নিয়ে সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছেন লঙ্কানরা। বাজে ফর্মের কারণে চতুর্থ ম্যাচে পারভেজ মাহরুফের বদলি অভিষেক হলো ২২ বছর বয়সী এক তরুনের। জিম্বাবুয়ের দেওয়া ১৪৭ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ৯৫ রানে ৫ উইকেট হারায় লংকানরা। ব্যাটিংয়ে নামেন অভিষিক্ত সেই তরুণ অলরাউন্ডার। দলের বিপর্যয়ে নেমে ৯ বলে ০ রান করে অভিষেকেই এক লজ্জার রেকর্ড করে বিদায় নেন। সেই ম্যাচে জিহান মুবারকের ব্যাটে ২ উইকেটের জয় পায় লঙ্কানরা।

আন্তর্জাতিক অভিষেকে ডাক মারা সেই তরুন তুর্কি এখন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম ভরসার নাম! শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। যদিও অলরাউন্ডার পরিচয়টা তিনি নিজেই হয়তো ভুলে গিয়েছেন!

এরপর সিরিজের শেষ ম্যাচেও দলে সুযোগ পান ম্যাথুস ৷ সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৩০ বলে ১ ছক্কায় ৩১ রান করেন৷ যা ছিলো সেই ম্যাচে লংকানদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর। মূলত শেষদিকে ম্যাথুসের সেই ইনিংসও জয়ের পার্থক্য গড়ে দেয়। লঙ্কানরা ১৫২ রান করেও ১৯ রানের জয় পায়।

এরপর থেকে তিন ফরম্যাটেই দলের নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন ম্যাথুস। ব্যাট হাতে মিডল অর্ডারে ধীরে ধীরে ভরসার নাম হয়ে উঠলেও বল হাতে নিজের সামর্থ্য ঠিকভাবে প্রমাণ করতে পারছিলেন না। তবে ওয়ানডে অভিষেকের পরের বছরই ভারতের বিপক্ষে প্রেমাদাসায় ২০ রানে ৬ উইকেট নিয়ে বোলিং জাদু দেখান তিনি৷ মিডল অর্ডারে তার ব্যাটিং আর আঁটোসাটো বোলিংয়ে লংকান ক্রিকেটে নিজের জায়গা পাঁকা করে ফেলেছিলেন এই অলরাউন্ডার।

ওয়ানডের সাথে সাথে টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টিতেও বেশ ভালো পারফরম্যান্স দেখান ম্যাথুস৷ মূলত টেস্টে প্রায় ৪০- এর কাছাকাছি গড়ে ব্যাটিং শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডারের শক্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো। মাহেলা জয়বর্ধনে অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাড়ালে ওয়ানডে ও টেস্টে সেই দায়িত্ব পান ম্যাথুস। ২০১৪ সালে ৩২ ম্যাচের মধ্যে ২০ ম্যাচেই জয়লাভ করে সেই বছর সেরা ওয়ানডে অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ওই বছরের পারফরম্যান্সে আইসিসির বিশ্ব টেস্ট একাদশের অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি।

শুধু তাই নয় পরবর্তী বছর ২০১৫ সালে সাকিব আল হাসানকে সরিয়ে আইসিসির ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর অলরাউন্ডার নির্বাচিত হন তিনি। সনাত জয়সুরিয়া, অরবিন্দ ডি সিলভা এবং দিলশানের পর চতুর্থ লঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট এবং তিন হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। শূন্য রানে ক্যারিয়ার শুরু করা ম্যাথিউস তখন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তবে ক্যারিয়ারের গ্রাফটা নিচের দিকে নামতে শুরু করে এরপরই!

২০১৬ সালেও ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে ছিলেন ম্যাথুস। সেই সাথে দলেও ছিলেন বেশ ভালো ফর্মে। ২০১৭ সালে তার অধীনেই অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করে লঙ্কানরা! তবে ইনজুরিতে বোলিং থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলেন তিনি। এক পর্যায়ে একজন ব্যাটসম্যান হিসেবেই নিয়মিত খেলা শুরু করলেন তিনি। পরবর্তীতে ক্যারিয়ারে বড় ইনজুরির ভয়ে বল হাতে সচরাচর দেখা যেতো না তাকে। ইনজুরির প্রভাবটা তার ক্যারিয়ারে বেশ ভালোভাবেই পড়ে।

২০১৬ সালের পর টি-টোয়েন্টিতে মাত্র তিন ফিফটি আর ২০ এর কাছাকাছি গড়ে রান করেছেন তিনি। ওয়ানডেতে অবশ্য দলের পারফরম্যান্সে ভাঁটা পড়লেও তার ব্যাটে ধার কমেনি৷ ১৬ সালের পর ৮ ফিফটি আর ২ সেঞ্চুরিতে ৬০ এর কাছাকাছি গড়ে তিনি রান করেছেন।

টেস্টে ২০১৬ ও ১৭ সালে ইনজুরি আর অফ ফর্মে নিজের স্বভাবসুলভ ফর্মে ছিলেন না ম্যাথুস। দুই বছরই টেস্ট গড় ৩০ এর নিচে। তবে ২০১৮ সালে পাঁচ ফিফটি আর ১ সেঞ্চুরিতে দূর্দান্ত এক বছর পার করেন তিনি। এরপর ইনজুরি আর সাময়িক অফ ফর্মে দলে আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন তিনি। আর বল হাতে ২০১৬ এর পর একপ্রকার পার্ট টাইমারের ভূমিকাতেই ছিলেন তিনি!

কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়বর্ধনে, তিলকারত্নে দিলশানের অবসরের পর ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের পতন শুরু হয়। একসময়ের ঘায়েল সিংহরা পরাজিত হতে থাকে একের পর এক ম্যাচ। এক সময় ২২ গজে দাপিয়ে বেড়ানো লংকানরা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও ম্যাচ হেরে বসে ৷ র‍্যাঙ্কিংয়ে ক্রমাগত অবনতি, দলের পারফরম্যান্স সব মিলিয়ে বেশ খারাপ সময়ই পার করছিলো লঙ্কান ক্রিকেট। সেই সময়ে অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন ম্যাথুস।

লংকান ক্রিকেটের এমন ভরা ডুবির কারণ হিসেবে ম্যাথুসের অধিনায়কত্বকে দায়ী করতে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে। শুরু হয় তার অধিনায়কত্বের সমালোচনা। এদিকে ইনজুরির কারণে দলে একপ্রকার আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলেন তিনি। তার অনুপস্থিতিতে দলের দায়ভার সামলাতেন মিডল অর্ডারে তখন লঙ্কান ক্রিকেটের আরেক ভরসা দীনেশ চান্দিমাল।

অধিনায়ক হিসেবে ৩৪ টেস্টে ১৩ জয় আর ১৫ টি হার দেখেছেন ম্যাথুস। ওয়ানডেতে ১০৬ ম্যাচে তার অধীনে ৪৯ জয় আর ৫১ হার দেখেছে লংকানরা। টি-টোয়েন্টিতে অবশ্য খুব ভালো রেকর্ড নেই তার। ১৬ ম্যাচে ৬ জয় আর ৯ হারে খুব বেশি ভালো অবদান রাখতে পারেননি টি-টোয়েন্টিতে। তবে সব মিলিয়ে ওয়ানডে ও টেস্টে দলের অবস্থা ও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বিচারে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অধিনায়ক বলা যায় ম্যাথুসকে।

১৯৮৭ সালের আজকের এই দিনে জন্ম নেওয়া ম্যাথিউস শ্রীলঙ্কার সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন। এই সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকেই আরেক লঙ্কান গ্রেট চামিন্দা ভাস উঠে এসেছিলেন। পরবর্তীতে প্রথম জোসেফ স্টুডেন্ট হিসেবে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে নেতৃত্ব দেন ম্যাথুস।

শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার ক্যারিয়ারে ইনজুরির বাঁধনে বার বার আটকে না গেলে হয়তো বিশ্বক্রিকেটে অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারতেন। সেটা হয়নি, বরং তিনি বোলিংটা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। ব্যাট হাতেও জ্বলে ওঠাটা নিয়মিত নয়। বারবার পুরনো হ্যামস্ট্রিংয়ের ব্যাথা তাঁকে দলের বাইরে ঠেলে দেয়। তিনি আবারও ফিরে আসেন, গ্রেটদের কাতারে না গেলেও অন্তত লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...