বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি পাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছেন আরামবাগের ফুটবলাররা। বয়সে তারা অনেকটাই নবীন, সামনে পড়ে রয়েছে ভবিষ্যত। কিন্তু এই অবস্থার মধ্যে ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি চেষ্টা করছে বাফুফের সাথে কথা বলে শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে আনতে। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা এসকল ফুটবলারদের পাশে বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য আরিফ হোসেন মুন দাড়িয়েছেন। কিন্তু বাফুফেতে করা আপিলে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে দেশের ফুটবলে ক্লাব ও খেলোয়াড়দের জন্য কি বার্তা দিয়েছে সেটি এখন আলোচনার বিষয়। ঢাকার ফুটবলে হচ্ছেও তাই।
অতি প্রচলতি একটি কথার নাম, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। ঠিক যেন এই কাজটিই হয়েছে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের হয়ে। নিজেদের আর্থিক দুরবস্তার মধ্যে অনেকটা ইজ্জত বিক্রি করার মতোই, ক্লাবের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল বিতর্কিত কিছু সংগঠকের হাতে। তারাই বারোটা বাজিয়ে দিয়ে সটকে পড়েছেন। আর ক্ষতি যা হওয়ার তার সবই হয়েছে মতিঝিলের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির। এমনিতে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে সপ্তাহ খানেক আগে দেশের পেশাদার ফুটবলের সর্বোচ্চ স্থর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) থেকে অবনমিত হয়ে নেমে যায় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশীপ লিগে।
এবার অনলাইন ফিক্সিং করে খেলোয়াড়, কর্মকর্তারা সর্বনাশ ডেকে এনেেছন। বেশ কয়েক বছর পাতানো খেলা নামক বিষবাস্প না থাকার পর আলোচনা শুরু হয়েছিল। বিপিএল ফুটবলে পাঁচটি ম্যাচকে ঘিরে পাতানো খেলার এই অভিযোগ এসেছিল। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের পাঁচটি ম্যাচকে এই তালিকায় রাখা হয়েছিল। অভিযুক্ত দুই ক্লাবকে চিঠি দিয়ে এই অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছিল।
আর গত ১২ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কাছ থেকে জবাব চেয়েছিল এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি)। এরপরই তদন্ত করে মোবাইল ফোনে বলা কথাগুলো থেকে প্রমাণিত হয়েছে ব্রাদার্স নয় সরাসরি জড়িত ছিলেন আরামবাগ। সে কারণে কর্মকর্তা থেকে শুরু ফুটবলারদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আরামবাগকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করার পাশাপাশি প্রথম বিভাগে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই বছর এই বিভাগে খেলবে তারা। এই সময়ে রেলিগেটেড হলে সেটি কার্যকর হলেও প্রমোশন হলে সেটি কার্যকর করা হবেনা।
- অর্থের লোভে পড়ে সর্বনাশ
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন বেটিং একেবারেই নতুন। শুধু ফুটবল নয় অন্যান্য খেলার জন্যও এটি প্রথম পাওয়া অভিজ্ঞতা। আগে ক্রিকেটের সাথে বেটিংয়ের একটা সাদৃশ্য খুজে পাওয়া যেত। এবার এটি আঘাত হেনেছে ঘুড়ে দাড়ানোর চেষ্টায় মত্ত ফুটবলে। বিষয়টি নিয়ে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন, যে কোন ক্লাব কিংবা ব্যক্তি যারাই ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকুক না কেন প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে অভিযুক্ত দুই ক্লাব বাফুফের চিঠির জবাবও দিয়েছে।
নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে তারা বলেছে, কোনোভাবেই তারা ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। অপ্রকাশিত বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা গেছে, দেশি বিদেশি কয়েকজনকে এরই মধ্যে চিহ্নিত করে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছিল। তারাই এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে। তবে একটা বিষয় অনেকটাই পরিস্কার হয়ে গেছে, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ যেখানে রেলিগেশনের ফাঁদে পড়েছে সেখানে ইচ্ছা করে দলকে বিপদে ফেলবে কোন যুক্তিতে? এএফসির কাছে সেই অভিযোগটাই পৌছে গেছে। যদি প্রমাণসহ পাঠানো হয় তাহলে তো এককথায় সর্বনাশই হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে গেছে! হয়েছেও তাই। প্রমাণসহ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যা দেশের ফুটবল ইতিহাসে একেবারে নতুন একটি ঘটনা।
আর অর্থের লোভের ফাদে পড়েই এমন কাজ করেছে আরামবাগ। যখন অভিযোগ ওঠে তখন ক্লাব সাধারন সম্পাদক ইয়াকুব আলী বলেছিলেন, তখনকার সভাপতি মিনহাজুল ইসলাম মিনহাজের সাথে একটা মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। যার সুত্র ধরে বসুন্ধরা কিংসের এই সাধারন সম্পাদক অর্থের যোগান দেবেন। এটি করতে গিয়ে তিনি ক্লাবের পাশাপাশি দেশের ফুটবলের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।
ইন্টারনেটে বিভিন্ন বেটিং ওয়েবসাইটে চলে অনলাইন বেটিং নামে। এই বেটিং শুধু কোনো দলের জয়-পরাজয় নিয়েই ধরা হয় না, ম্যাচের প্রথমার্ধে কত গোল হবে, কে গোল করবে, কিংবা কয়টি হলুদ-লাল কার্ড দেখবে, এসব নিয়েও সমানতালে বেটিং হয়। অনেকটা ক্রিকেটের বলে বলে বাজি ধরার বিষয়টি। ইউরোপসহ বিশ্বের যেসব দেশে বেটিং বৈধ হলেও এই বাজিটা হয় বেটিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তির। এই বেটিংয়ে কোনো খেলোয়াড়-কোচ কিংবা সংশ্নিষ্ট ক্লাবকে জড়ানো কিংবা প্রভাবিত করার নজির নেই। বাংলাদেশের এই বেটিং সরকারীভাবে অবৈধ।
- আরামবাগকে প্রথম বিভাগে নামিয়ে দেওয়া হলো
সপ্তাহ খানেক আগে বিপিএল থেকে বিসিএলে নেমে যাওয়ার পর আরামবাগের এবারের ঠিকানা হলো প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে। এই লিগে দু বছর খেলতে হবে। কোন প্রমোশন পেলেও উপরের লিগে ওঠার কোন সুযোগ নেই। তবে রেলিগেটেড অবশ্যই দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যেতে হবে। তাই হিসাব করলে আরো তিনটা মৌসুম নিচেজর লিগে কেলে তবেই বিপিএলে ফেরার সুযোগ রয়েছে ক্লাবটির। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে অনেক ধরনের শাস্তির নজির রয়েছে। তারকা ফুটবলাররাও জেলের চার দেয়ালে বন্দি থেকেছেন।
কিন্তু, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ যে যে শাস্তিটা পেল তা ইতিহাসে বড় শাস্তিই বলতে হবে। এমনিতেই তারা বিপিএল থেকে নেমে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী আগামী বছর তাদের বিসিএলে খেলার কথা। কিন্তু এবার তাদের খেলতে হবে একধাপ পিছিয়ে প্রথম বিভাগ লিগে। কেননা আরামবাগের বিরুদ্ধে অনলাইন রেটিং স্পট ফিক্সিংসহ ম্যাচ পাতানোর প্রমাণ স্বাপেক্ষে এই শাস্তিটা দেওয়া হয়েছে। সাথে ৫ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এই অর্থ আগামী ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাফুফের অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হবে। ক্যাসিনো কান্ডের পর এমন আরেকটি কান্ড রীতিমতো লজ্জার মুখে পেল দিয়েছে দেশের ফুটবলকে।
- অনেকটা অন্ধকারে রাহাদ-মিরাজরা!
অনলাইন ফিক্সিংয়ের বিষয়টা না জেনেই শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে কাজী রাহাদ মিয়া ও মিরাজ মোল্লারা। তবে এই দুজনের একজনও জানেন না তারা কি কারণে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার কবলে পরলেন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে লাইভ বেটিং, ম্যাচ ফিক্সিং, ম্যাচ ম্যানিপুলেশন ও অনলাইন বেটিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার এই সিদ্ধান্তে একেবারেই হতবাক বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলা ফুটবলার কাজী রাহাদ, ’আমি অনেক স্বপ্ন নিয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলের পর যোগ দিয়েছিলাম আরামবাগে।
এবারই প্রথম বিপিএলে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভাবতেই কেমন লাগছে যে, আমাকে তিন বছরের জন্য সব ধরনের ফুটবল থেকে বিরত থাকতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, আমি জানি না আসলে আমি কি করেছি’। মিরাজ মোল্লাও অন্ধকারে রয়েছেন। তার কথায়, ‘প্রথম পর্বে আমি ম্যাচই খেলেছি মাত্র ২-৩টি। বেশিরভাগ সময়েই ছিলাম ইনজুরি আক্রান্ত। প্রথমদিকে যারা কর্মকর্তা ছিলেন তাদের সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্টতাও ছিল না আমার। এখন যখন জানলাম আমাকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে তখন ভাবতেই অবাক লাগছে।’ ক্লাব হিসেবে আরামবাগের মতো এই দুজনও নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পেতে আপিল করবেন বলে জানা গেছে।
- যেভাবে পাতানো ম্যাচের কবর পাওয়া গেল
শুরুতে খুব বেশি আলোচনা না থাকলেও আলোচিত সেই পাঁচ ম্যাচে কি ফলাফল হয়েছিল সেটি জানতে এখন ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ বাড়ছে। মূলত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেটিং সাইট ঘেঁটে এএফসি আর বাফুফে মিলে দেখেছে এই পাঁচ ম্যাচে অস্বাভাবিক বেটিং হয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত ফলাফলের পক্ষে ১০:১ আনুপাতিক হারে বেশ কয়েকজন এটি নিয়ে বাজি ধরেছে। যা থেকেই মূলত সন্দেহ তৈরি হয়েছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন হলে সেটিও নেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছিল। দুটি ক্লাবই তাদের ওপর আনীত অভিযোগ মিথ্যা বলে চিঠির জবাবে সে সময় উল্লেখ করেছিল। অভিযোগের তীর অবশ্য আরামবাগের দিকেই ছিল বেশি। বাফুফের একটি সূত্র জানিয়েছে এ মৌসুমে ক্লাবটিকে স্পন্সর আনতে সহায়তা করা বসুন্ধরা কিংসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম মিনহাজ, আরামবাগের সাবেক ম্যানেজার গওহর জাহাঙ্গীর রুশো, সাবেক ভারতীয় কোচ সুব্রত চ্যাটার্জিসহ বেশ ক’জন কর্মকর্তা, ফুটবলার ও ফুটবলারদের এজেন্টের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গিয়েছিল। যদিও মিনহাজ ও গওহর জাহাঙ্গীর তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছিলেন।
- কী ফলাফল ছিল অভিযুক্ত ম্যাচগুলোর
আরামবাগ ও ব্রাদার্সের বেশ কয়েকটি ম্যাচেই পাতানোর অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্ত প্রথম ম্যাচে আরামবাগ মোহামেডানের কাছে হেরে যায় যায় ৩-০ গোলের ব্যবধানে। গত ১৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত ম্যাচে তিনটি গোল করেন সুলেমান দিয়াবাতে, আবিওলা নুরাদ ও আমিনুর রহমান সজীব। আরামবাগ এই ম্যাচে একটি পেনাল্টি পেলেও ব্যবধান কমাতে পারেনি। ১৯ জানুয়ারী দ্বিতীয় ম্যাচে ব্রাদার্স ইউনিয়ন আবাহনী লিমিটেডের কাছে হারে ২-০ গোলের ব্যবধানে।
ফ্রান্সিসকো তোরেস ও কারভেন্স বেলফোর্ট গোলদুটি করেন। ২৩ জানুয়ারি কুমিল্লায় স্বাগতিক বসুন্ধরা কিংস ১-০ ব্যবধানে ব্রাদার্স ইউনিয়নকে পরাজিত করে। রবসন রবিনহোর গোলে কষ্টার্জিত জয় পায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। এরপর ৯ ফেব্রæয়ারী অভিযুক্ত চতুর্থ ম্যাচটিতে আরামবাগের বিপক্ষে ৪-০ গোলে জেতে শেখ রাসেল। ওবি মোনেকে হ্যাট্টিক করেন, অপর গোলটি করেন মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। মুন্সীগঞ্জে অনুষ্ঠিত ১৩ ফেব্রæয়ারীর ম্যাচটিতে আবাহনী লিমিটেড ৪-০ হারায় আরামবাগকে। ফ্রান্সিসকো তোরেস দুটি, মাসিহ সাইঘানি একটি গোল করার পাশাপাশি আরামবাগের অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্ডার বার্ডি স্মিথের আত্মঘাতী থেকে আসে বাকি গোলটি। ম্যাচের ফলাফল অবিশ্বাস্য না হলেও অনলাইন বেটিংয়ের অভিযোগ ওঠে।
- আজীবন নিষিদ্ধ যারা
ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি মিনহাজুল ইসলাম মিনহাজ, দলের ম্যনেজার গওহর জাহাঙ্গীর রুশো, সহকারী ম্যানেজার আরিফ হোসেন, ট্রেইনার ভারতীয় নাগরিক মাইদুল ইসলাম শেখ।
- দশ বছরের জন্য নিষিদ্ধ
ক্লাবের ফুটবল দলের ফিজিও ভারতীয় নাগরিক সঞ্জয় বোস, গেম এনালিস্ট এবং প্লেয়ার এজেন্ট ভারতীয় নাগরিক আজিজুল শেখ।
- পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ
গোলকিপার আপেল মাহমুদ, যদিও এই ফুটবলার ভিক্টোরিয়ায় খেলছেন।
- তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ
গোলকিপার আবুল কাশেম, ডিফেন্ডার আল আমিন, রকি, জাহিদ হোসেন, কাজী রাহাদ মিয়া, মোস্তাফিজুর রহমান সৈকত, শামীম রেজা ও অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলার স্মিথ ব্রাডি ক্রিশ্চিয়ান।
- দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ
নাইজেরিয়ান ফুটবলার চিজোবা ক্রিস্টোফার লিকওবে, মিডফিল্ডার ওমর ফারুক, রাকিবুল ইসলাম, ফরোয়ার্ড মেহেদী হাসান ফাহাদ ও মিরাজ মোল্লা।