নির্বাসনের পর

সোফায় বসলেই চোখে পড়ে দেয়ালে ঝোলানো কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো মাঝারি আকারের ইসএসপিএন-এর পোস্টারটা-যাতে আছেন ক্রীড়াবিশ্বের পাঁচ ‘আইকন’। দু পাশে চার মহারথী টাইগার উডস, শচীন টেন্ডুলকার, ডেভিড বেকহ্যাম ও মাইকেল শুমাখারের ছবি; মাঝে জ্বলজ্বল করছে মোহাম্মদ আশরাফুলের মুখটা!

সোফায় বসলেই চোখে পড়ে দেয়ালে ঝোলানো কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো মাঝারি আকারের ইসএসপিএন-এর পোস্টারটা-যাতে আছেন ক্রীড়াবিশ্বের পাঁচ ‘আইকন’।

দু পাশে চার মহারথী টাইগার উডস, শচীন টেন্ডুলকার, ডেভিড বেকহ্যাম ও মাইকেল শুমাখারের ছবি; মাঝে জ্বলজ্বল করছে মোহাম্মদ আশরাফুলের মুখটা!

কথা বলতে বলতে হঠাৎ পোস্টারটার দিকে চোখ গেল। পোস্টারটা দেখে আনমনেই একটা শব্দ করলেন তিনি। বাইরে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা বৃষ্টিতে শব্দটার অর্থ বোঝা গেল না। তবে মুখের ভঙ্গিটা দেখে মনে হল, হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বল খেলতে গিয়ে আউট হয়ে গেছেন আশরাফুল!

ইএসপিএন-এর ওই পোস্টার, গাদা গাদা স্মারক স্ট্যাম্প, ট্রফি আর ক্রেস্টে সাজানো নিজের ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছিলেন আশরাফুল। মাঝে যে ঝড়টা গেল সেটা কিছুটা হলেও অন্তত শান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) দুটি ম্যাচের স্পট ফিক্সিং বিতর্ক থেকে শুরু করে গোটা তিনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচেও কিছু অন্যায়ে আশরাফুলের জড়িয়ে থাকার বিতর্ক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশকে। সে বিতর্ক এখনো ঝড় হয়ে ঘুরছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। কিন্তু আশরাফুলের ভেতরের ঝড়টা একটু কমেছে।

আশরাফুল আগেও বলেছেন; আবারো বললেন, সাধারণ মানুষের কাছে সব পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পর থেকে একটা প্রশান্তির মধ্যে আছেন। এই প্রশান্তির রূপটা ব্যাখ্যা করতে গিয়েও যেন একটু স্বস্তি পেলেন, ‘আকসু যেদিন প্রথম ডেকেছিল সেদিন থেকেই খুব মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম। আগেও অনেকবার মনে হয়েছে, মানুষকে সব বলে দেই। তারপর পত্রিকায় যখন খবর আসা শুরু হল, চাপটা সহ্য করতে পারছিলাম না। মানুষ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিল, আমার রাতে ঘুম হতো না। তারপর মনে হল আমার নিজের জন্য, আমার ভক্তদের জন্য এবং ক্রিকেটের জন্য সবকিছু বলে ক্ষমা চাওয়া দরকার। তাই করেছি।’

এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ ছিল না, এটা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না।

আশরাফুল যেদিন সংবাদ মাধ্যমে সব বলতে নিচে নেমে আসছিলেন; আসলে তিনি লিফট ধরে নেমে আসছিলেন নিশ্চিত অর্থ আর খ্যাতির চূড়া থেকে। পৃথিবীতে হাজারটা নজির আছে, এ অবস্থায়ও সব অস্বীকার করে মিথ্য কথার খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা চালানোর। আশরাফুলও সেটা করতে পারতেন। তার ভক্তদেরও কারো কারো জিজ্ঞাসা-আশরাফুলের দরকার ছিল কী সত্যি বলে ফেলার!

এই প্রশ্নটাই আশরাফুল খুব ‘ভালো প্রশ্ন’ বলে মনে করলেন না। প্রশ্নটা শুনে হাসলেন। বললেন, ‘এইসব আফসোস একটুও নেই। স্বীকার করে কী হারালাম, তার চেয়ে আমি বেশি বড় করে দেখছি, কী পেলাম। আমি সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। সেদিনই ফেসবুকে দেখেছি, হাজার হাজার মানুষ স্ট্যাটাস দিয়েছেন-মন থেকে ক্ষমা করে দিলাম। আমি মিথ্যা বলে সব চেপে রাখতে চাইলে এই আন্তরিক ক্ষমাটা তো পেতাম না।’

সমর্থকদের কাছ থেকে এই পাওয়াটা আছে; সেই সঙ্গে হারানোও নিতান্ত কম নয়। আপাতত তিনি প্রথমেই এক ধাক্কায় হারিয়ে ফেলেছেন সব ব্যস্ততা। প্রতিদিনের গতবাঁধা অনুশীলন, জিম, প্রিমিয়ারের খোঁজ; এই যে নিয়মবাঁধা ব্যস্ততার জীবন, এসবই হঠাৎ নেই হয়ে গেছে তার জীবন থেকে।

একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন, একটা একটা করে চোখ বোলান পত্রিকায়, দেশ-বিদেশের খেলা দেখেন টিভিতে; এভাবেই চলছে জীবন। নিজেই বললেন, ‘আসলেই কিছু করার নেই। ইচ্ছে করেই কোথাও যাই না। নতুন ফোন নম্বর বেশি লোকে জানে না, তাই ফোনও খুব আসে না। এর মাঝে জাভেদ ভাই (জাভেদ ওমর বেলিম), সানি (ইলিয়াস সানি), দুই একজন এসেছিল। এছাড়া একেবারেই চুপচাপ সময় কাটাচ্ছি।’

এসব নিরাপত্তা, কর্মহীনতা নিয়ে অনেক কথা হল। এর মাঝে একটা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠল-ভবিষ্যৎ। এখন আশরাফুল কী করবেন? আশরাফুল জানেন না। ভবিষ্যৎটাকে ভবিষ্যতের হাতেই ছেড়ে দিলেন, ‘এখনো তো জানি না, কী শাস্তি হবে। শাস্তি ঘোষণা হলে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। এখন আসলে কিছুই ভাবছি না। সব সময় ঠিক করে দেবে।’

এইসব আলাপচারিতায় ঘটনাক্রমটা উঠে এলো। আমরা ফিরে দেখতে চাইলাম কী কী ঘটেছে।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে ম্যাচগুলোর দিকে চোখ রাখার জন্য বিসিবি ও আইসিসির মধ্যে এক চুক্তি হয়। আর সেই চুক্তির ফলে আইসিসির দুর্নীতি দমন ও নিরাপত্তা ইউনিট (আকসু) প্রতিটি ম্যাচে তদন্ত করে ঢাকা গ্ল্যাডিয়ের্সের কমপক্ষে দুটি ম্যাচ সন্দেহজনক বলে রায় দেয়। এরপর অধিকতর তদন্তশেষে চাঞ্চল্যকর ভাবে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও দেশের অন্যতম সেরা তারকা মোহাম্মদ আশরাফুলসহ কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম বেরিয়ে আসে।

এরপর দীর্ঘ গুঞ্জনের পর ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরেই আইসিসি ও বিসিবি সংবাদ সম্মেলন করে বলে ৯ জন খেলোয়াড় বা কর্মকর্তা এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত।

এরপর সে বছরই ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও আইন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রশীদকে ডিসিপ্লিনারি কমিটির প্রধান হিসেবে মনোনীত করে বিসিবি। পরে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন কমিটির বাকি ১০ সদস্যকে। এরপর ১০ নভেম্বর ওই ডিসিপ্লিনারি কমিটি সাবেক বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনালের বাকি দুই সদস্য হলেন আজমালুল হোসেন কিউসি এবং সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাশেম।

কয়েক দফা শুনানির পর ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক রায় ঘোষণা করেন সেই ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয় অভিযুক্ত সেলিম চৌধুরী, জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিক, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের কর্মকর্তা গৌরব রাওয়াত, জাতীয় ক্রিকেটার মোশাররফ রুবেল ও মাহবুবুল আলম রবিন এবং ইংলিশ ক্রিকেটার ড্যারেন স্টিভেন্সের বিপক্ষে কোনো অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।

তবে আশরাফুলের বিপক্ষে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ফিক্সিংয়ের দায়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলকে ৮ বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ডিসিপ্লিনারি কমিটির গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে দশ লাখ টাকা জরিমানা করেন এই ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল বলেন, বিসিবি, এসিসি ও আইসিসির দুর্নীতি ও ফিক্সিং বিরোধী শিক্ষা কার্যক্রমে সময় দিলে এবং নৈতিক জীবন যাপন করলে তার শাস্তি পাঁচ বছরে নেমে আসবে। শাস্তি ঘোষনার আগেই এক বছর তিনি অতিবাহিত করেছেন।

এই ট্রাইবুনাল রায় ঘোষনার সময় জানান, আশরাফুলের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ ছিল। চারটিই ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব অভিযোগে আট বছর তাকে খেলাধুলা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অভিযোগে তাকে অতিরিক্ত ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে বিসিবিকে। চারটি অভিযোগেই দোষী সাব্যস্ত হন তিনি।

ঢাকার হয়ে খেলার সময় আশরাফুল চিটাগং, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট রয়্যালসের চারটি ম্যাচের কারণে অভিযুক্ত হন। ট্রাইব্যুনাল চারটি ম্যাচকে পাতানো বলছে।

এরপর শাস্তিপ্রাপ্তরা শাস্তির বিপক্ষে এবং আইসিসি ও বিসিবি অন্য রায়গুলোর বিপক্ষে আপিল আবেদন করেন আইন অনুযায়ী ডিসিপ্লিনারি প্যানেলেরই চেয়ারম্যানের কাছে। এই আবেদনগুলোর বিবেচনায় আশরাফুলের শাস্তি তিন বছর কমায় বিসিবির ডিসিপ্লিনারি প্যানেল। সেটা কমে দাড়ায় পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞায়। যার দুই বছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা, মানে মূল নিষেধাজ্ঞা তিন বছরের।

এসব ভারি কথা আর চলতে পারল না। হঠাৎ পরিবেশটা হালকা করে দিতেই যেন ঘুম থেকে উঠে ছুটে এলো ছোট্ট তাবাসসুম; আশরাফুলের ভাতিজি। চাচুর কোলে উঠেই আবদার-চলো ক্রিকেট খেলি। আশরাফুল হেসে প্রতিবেদকের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এই যে, একেবারে কিছু করি না, তা না। ওর সঙ্গে ক্রিকেট খেলে সময় কাটাই এখন।’

মুত্তিয়া মুরলিধরন, শেন ওয়ার্ন, স্টিভ হার্মিসনদের ঘাতককে এখন তাবাসসুমের বোলিংয়ে ব্যাট চালিয়ে সময় পার করতে হচ্ছে!

সময়ের পরিহাস বোধ হয় একেই বলে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...