১৯৮৪ সালের সাত জুলাই পৃথিবীতে নতুন একটি ফুল ফুটেছিল। সেই ফুল আশরাফুল। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল শনিবার। সেদিন বোধহয় পৃথিবীর এহেন মন খারাপ ছিল না। প্রতিদিনের মতো সেদিনও পৃথিবী হয়তো কর্মব্যস্ততায় মুখর ছিল।
শরীর থেকে তখনো কৈশোরের গন্ধ ছাড়েনি। আশরাফুল নেমে পড়েন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়িয়ে। হিসেব কষে সতেরো বছর ৬১ দিন বয়স। কৈশোরের উচ্ছ্বলতার মতোই শতক হাঁকিয়ে তবেই ক্ষান্ত দেন। তাতে বিশ্ব ক্রিকেটে শোরগোল পড়ে যায়।
আজকে এসে আপনি সেই আশরাফুলের ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে পান না। সেই আশরাফুল অচেনা। সেই আশরাফুল অজানা গন্তব্যের শেষ গল্পটুকুন হয়ে টিকে আছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে মোহাম্মদ আশরাফুলের নামটা ধুমকেতুর আর্বিভাবের মতোই হয়েছিল। সেই আশরাফুল শৈশবের ঘোর লাগানো প্রথম প্রেম। সাংবাদিক উৎপল শুভ্রকে বলা তামিম ইকবালের কথাটাই বলি, ‘আশরাফুল বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম প্রেম। প্রথম প্রেম যেমন কোনো দিন ভোলা যায় না। আশরাফুল ভাইকেও মানুষ চিরদিন মনে রাখবেন।’
শুভ্রদাকে যখন তামিম এই কথাগুলো বলছিলেন, তখনো বোধহয় ‘কাগজে কলমে’ আশরাফুলের গায়ে ক্রিকেটের কালো অধ্যায়ের দাগ লাগেনি। সেই দাগ লাগার পরও মানুষ আশরাফুলকে মনে রেখেছে। ওই যে প্রথম প্রেম ভোলবার নয়। আশরাফুল, কখনো কি সেসবের প্রতিদান দিতে পারবেন?
আপনি দিনের পর দিন খারাপ খেলেছেন তবুও আমরা আপনাতেই মজেছিলাম। আপনাকেই ভালোবেসেছিলাম। আমরা কোনদিন এইটুকুন প্রতিদান চাইনি! আজ চাইছি, কারণ আপনি আমাদের সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় দাগ লাগিয়েছেন।
সেই আশরাফুল স্মৃতির বিস্মৃতিতে চাপা পড়ে ফিরে আসেন কার্ডিফের অস্ট্রেলিয়া বধের ওই সেঞ্চুরি হয়ে, ২০০৭ বিশ্বকাপে গায়ানার ৮৭ হয়ে, নটিংহামের ঝড় তোলা ৫২ বলে ৯৪ হয়ে, জোহানেসবার্গের ২৭ বলে ৬১, চট্টগ্রামে অপরাজিত ১৫৮ হয়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় সব সাফল্যেই তো আছেন আশরাফুল।
আমাদের তখন একজন সাকিব আল হাসান ছিলেন না। একজন মুশফিকুর রহিম ছিলেন না। আশরাফুল আমাদেরকে কালেভদ্রে একটা জয় পাইয়ে দিতেন। আশরাফুল ইনিংসের মতোই আমরা আরেকটা জয়ের অপেক্ষার প্রহর গুনতাম। সেই মোহাম্মদ আশরাফুল আমাদের ক্রিকেট উপাখ্যান।
আপনাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস লিখতে দেয়া হলো? ‘শুধু আশরাফুল একা নন’ শিরোনামে লিখাটা পড়েও আপনাকে আশরাফুলের নামটি লিখতে হবে আমাদের ক্রিকেট গল্পের একটি অধ্যায়জুড়ে। যে অধ্যায়ের শুরুটা হবে অবিশ্বাস্য কিছু গল্প দিয়ে। এরপর যে অধ্যায় এগোবে, সেখানে মিটমিটে আলো থেকে পরিণত হবে ঘোর অমানিশায়। কল্পলোকের সব গল্প নাকি পূর্ণতা পায়না। বাঘেদের ক্রিকেটে ‘আশরাফুল গল্পটিও’ পূর্ণতা পায়নি।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আমাদের কাছে আশরাফুল স্বপ্নের সমান বড় একজনই ছিলেন। সেই আশরাফুল ছিলেন একটা অনুভূতি। শত খারাপের মাঝেও আমরা আশরাফুলে সমর্থন দিয়ে গেছি। আপনার মনে হতে পারে আবেগের প্রলাপ। কিন্তু আশরাফুল যে শৈশবের আবেগের বিশাল ক্যানভাস জুড়ে ছিলেন সেটা একবিন্দু মিথ্যে নয়।
এখনো যে আশরাফুল প্রেম একদম নেই, তা নয়! তবে সেখানে এখন চাপা ক্ষোভ, হতাশা আর একরাশ অভিমান যুক্ত হয়েছে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হওয়া আমাদের আশার-ফুল। আমাদের স্বপ্নের নায়ক। স্বপ্নের নায়ক -ই তো! কত স্বপ্নই তো দেখেছি আশরাফুলকে ঘিরে। স্বপ্ন যখন ভেঙেছে, দেয়ালে ঝুলানো পোস্টারে পরক্ষণে সেই আশরাফুলকেই দেখেছি।
কি হওয়ার ছিলেন আশরাফুল। দিনে দিনে কি হয়েছেন আশরাফুল! শুভ্র’দার সেই শিরোনাম। শুধু আশরাফুল একা নন। শব্দহারা করেছিল। স্তব্ধ করেছিল। হতাশার চাদরে ঢেকে দিয়েছিল নিরন্তর প্রবাহ। মুহূর্তের জন্য পৃথিবী থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল! একটা সময় ছিল আশরাফুল পারফর্ম না করা স্বত্বেও দিনের পর দিন খেলে গেছেন।
অ্যাশ একটা ইনিংস খেললে বাংলাদেশ জেতে তাই জন্য খেলেছেন। সেই আশরাফুল আজকে আরেকটা বার লাল সবুজ জার্সিটা গায়ে চাপাতে চান। অপ্রকাশিত আহাজারি করেন। অথচ ক্যারিয়ারের মূল্যবান সময়গুলো আশরাফুল হেলায় হারিয়েছেন!
প্রত্যাশার পারদ শিখরে তুলে আশরাফুল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। সময় যত গড়িয়েছে সেটা বেড়েছে বৈ কমেনি। কিন্তু সে বাড়ন্ত চাওয়া গুলো আশরাফুলের জন্য বুমেরাং হয়ে এসেছিল। ছোট দলের বড় তারকা খ্যাতি আশরাফুল সামলাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফিক্সিং কেলেঙ্কারি তাতে আরো কালি লাগিয়েছে।
আজ আশরাফুল বারেবারে ক্ষমা চান। হতাশার কণ্ঠে জিজ্ঞাসা রাখেন, আমি আর কি করতে পারি? সেটাই আশরাফুল, আপনি আর কিবা করতে পারেন! আপনি জানেন না তিলে তিলে আপনার জন্য যে তীব্র ভালোবাসার জন্ম হয়েছিল, সেই ভালোবাসায় এক ফোঁটা খুঁত ছিল না। তাই সবার ভালোবাসা পেয়ে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। এখনো সেই ভালোবাসা পাচ্ছেন। মানুষ আপনাকে দিনের পর দিন গ্রহণ করেছে। পারফর্ম না করা স্বত্বেও। ওই মনের মনিকোঠায় জায়গা দেওয়ার কারণেই।