১.
এ ম্যাচ সম্পর্কে উইজডেন বলছে, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ পুলড অ্যান এক্সট্রা অর্ডিনারি ডিফিট।’ উইন না কিন্তু, ডিফিট।
স্কোরবোর্ড ভুল ধারণা দিতে পারে। দিতে পারে না, দিচ্ছে। মনে হতে পারে, ৫ রানে হার মানে খুব হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হয়েছে দু’দলের যেখানে বিজয়ীর নাম অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু যারা এ ম্যাচ দেখেছেন শুধুমাত্র তারাই বলতে পারবেন কী অসম্ভব সহজ এক ম্যাচ অসম্ভব অবহেলায় নিজেদের হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
২.
১৯৯৬ সালের ১৪ মার্চ, উইলস বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। এ ম্যাচের একটু আগে দেখে আসি বরং। ইডেনে দর্শক উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে ভারত – শ্রীলঙ্কার প্রথম সেমিফাইনাল, বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। দ্বিতীয় সেমিফাইনালের খেলা পড়েছে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ফাইনালে যাবে কে? রিচি রিচার্ডসনের ওয়েস্টইন্ডিজ নাকি মার্ক টেলরের অস্ট্রেলিয়া?
৩.
টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন মার্ক টেলর। সিদ্ধান্তটা যে কতবড় ভুল ছিল তা প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন কার্টলি অ্যামব্রোস আর ইয়ান বিশপ। এই দুজনের তাণ্ডবে অস্ট্রেলিয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিণত হল ১৫/৪-এ। ফিনিশার মাইকেল বেভান জুটি বাঁধলেন স্টুয়ার্ট ল’র সাথে, ১৩৮ রানের জুটি গড়ে দলকে নিয়ে গেলেন ১৫৩-তে।
তখনই ব্যক্তিগত ৭২ রানে আউট হয়ে গেলেন ল, এর কিছুক্ষণ পরে ইনিংস ‘আনফিনিশড’ অবস্থায় রেখে ফিরে গেলেন মাইকেল বেভান, দলের স্কোর তখন ১৭১/৬। এরপরে ইয়ান হিলির ৩১, সাথে আরও কিছু খুচরা রান যুক্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়া থামল ২০৭-এ।
৪.
২০৮ আপাতদৃষ্টিতে বেশ সহজ একটা লক্ষ্য। তবে সহজ লক্ষ্য হলেই যে সহজে ম্যাচ জেতা গেলে খেলাটার নাম ক্রিকেট কেন? আর দলে আছেন ম্যাকগ্রা, ফ্লেমিং আর ওয়ার্নের মতো বোলাররা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ওপেনিংয়ে নামলেন কোর্টনি ব্রাউন আর শিবনারায়ণ চন্দরপল। নিজের প্রথম ওভারের প্রথম বলে কট অ্যান্ড বোল্ড করে ব্রাউনকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠালেন ওয়ার্ন, উল্লাসে ফেটে পড়ল মোহালির দর্শক। কারণ ব্যাট করতে নামছেন ব্রায়ান চার্লস লারা। স্কোর ২৫/১।
লারার ব্যাটিং মানেই বিনোদন। তাছাড়া আগের ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে এসেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে। চন্দরপলের সাথে তার জুটি জমে উঠল। ৪৫ রান করে যখন লারা ফিরছেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯৩/২। টু-ডাউনে নামলেন ক্যাপ্টেন রিচি রিচার্ডসন। চন্দরপলের সাথে ৭২ রানের জুটি গড়ে জয়ের বন্দরকে নিয়ে এলেন দৃষ্টিসীমায়।
চন্দরপল যেভাবে খেলছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল আজ তিনি অপরাজিত থাকবেন এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটা উঠবে তার হাতেই। কিন্তু পুরো ম্যাচ ঘুমিয়ে থাকা ক্রিকেটদেবতার ঘুম ভাঙল তখন। তিনি ভাবলেন, সেমিফাইনালের মতো একটা ম্যাচ কি এত ম্যাড়ম্যাড়ে হলে হয়! টুইস্ট আনা যাক।
খেলার বাকি তখন ৯ ওভার। সমীকরণ খুব সোজা – ৯ ওভারে লাগে ৪৩ রান, হাতে আছে ৮ উইকেট। এই ম্যাচ জেতা যতটা কঠিন, হারা তার চেয়েও বেশি কঠিন। যাই হোক, টুইস্ট এল ম্যাকগ্রার হাত দিয়ে। অপ্রতিরোধ্য চন্দরপলকে তুলে নিলেন দলীয় ১৬৫ রানে, চন্দরপলের সংগ্রহ তখন ৮০। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর যখন ১৭৩ তখন তিনি ফেরালেন নতুন ব্যাটসম্যান রজার হারপারকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখন লাগে ৩৯ বলে ৩৩, হাতে আছে ৬ উইকেট। ম্যাচ তখনও হাতের নাগালে।
গ্রেট খেলোয়াড়রা নাকি নিজেদের এক্সেলেন্স দেখানোর জন্য সবসময় বড় উপলক্ষ বেছে নেন। আর শেন ওয়ার্ন যে একজন গ্রেট তাতে সম্ভবত কেউই আপত্তি করবেন না। ১৭৩ থেকে ১৮৩ এই ১০ রানের মধ্যে ওটিস গিবসন আর জিমি অ্যাডামসের উইকেট পকেটে ভরে অস্ট্রেলিয়াকে ফিরিয়ে আনলেন ম্যাচে।
এবার ভয় পেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিশ্চিত জেতা ম্যাচ কি হারতে হবে নাকি? ভয় পাওয়াই সার, ওটিস গিবসন আর রজার হারপারকে জিমি অ্যাডামসের আগে নামিয়ে ব্যাটিং অর্ডার শাফল করার ফলে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে ততক্ষণে। এক রিচি রিচার্ডসন যদি পারেন বাঁচাতে, তবেই আর কী!
কিন্তু রিচার্ডসনের সাথে তো কাউকে থাকতে হবে, নাকি? ১৮৭ রানে আর্থারটনকে আউট করলেন ডেমিয়েন ফ্লেমিং। ১৯০ রানে দাঁড়িয়ে ওভারের শেষ বলে বাউন্ডারি মারলেন রিচার্ডসন, বাউন্ডারি হলো বটে কিন্তু বিশপ চলে গেলেন স্ট্রাইকে। এবং ৪৯তম ওভারের প্রথম বলেই ওয়ার্নের আঘাত। দারুণ এক ফ্লিপারে এলবিডব্লিউ করে আউট করলেন ইয়ান বিশপকে। প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে পরপর ৩ ওভারে ৩ উইকেট। সেই ওভার শেষ হলে ওয়ার্নের ফিগার দাঁড়াল এরকম: ৯ – ০ – ৩৬ – ৪“
ম্যাকগ্রার ওভার শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ ওভার করতে এলেন ডেমিয়েন ফ্লেমিং, দরকার ১০ রান। স্ট্রাইকে রিচার্ডসন, ফ্লেমিঙের প্রথম বলে লেগ সাইডে উড়িয়ে মারলেন, বাউন্ডারি হয়ে গেল। ৫ বলে ৬ লাগে আর। পরের বলেই এমন এক বোকামি করলেন রিচার্ডসন যার কোনও মা-বাপ নেই।
বল ইনসাইড এজ হয়ে চলে গেল হিলির কাছে, কোনওভাবেই রান হয়না; তারপরেও দৌঁড়ালেন। এই সুযোগ চিনতে হিলির ভুল হওয়ার কথা না, হলোও না। অ্যামব্রোস ক্রিজে পৌঁছানোর আগেই বেল পড়ে গেল উইকেট থেকে।
শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে নামলেন কোর্টনি ওয়ালশ। এই মুহূর্তে সম্ভবত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সব খেলোয়াড়ের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল। ব্যাট হাতে ওয়ালশের ‘দক্ষতা’র কথা তো অজানা নয় কারোরই।
আশঙ্কা ফলে গেল। ওয়ালশ যখন ব্যাট করতে নামলেন, রিচার্ডসন অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বোঝালেন তাঁকে। কিন্তু বোঝালেই তো হবে না, ওয়ালশের ব্যাটকে তো সেই বোঝানোকে কাজে রূপান্তর করতে হবে। বলের দিকে চোখ না রেখে আন্দাজের উপরে সোজা ব্যাট চালালেন, ব্যাট আর প্যাডের মাঝখানে এক বিশাল গ্যাপ দিয়ে বল উইকেট থেকে বেল ফেলে দিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০২/১০।
রিচার্ডসন শূন্যচোখে তাকিয়ে আছেন। নামের পাশে অপরাজিত ৪৯, কিন্তু এই ম্যাচ হারার দু:খ ভোলাবে, সেই সাধ্য কি ‘অপরাজিত ৪৯’ এর আছে?
এই ম্যাচের পরেই অবসর নিলেন রিচার্ডসন। বিশ্বকাপ জিতেই হয়তো অবসর নিতে পারতেন, ক্লাইভ লয়েডের পরে থাকতে পারত তার নামও। কিন্তু যা ভাবা যায়, তা তো হয় না সবসময়। তাই রিচি রিচার্ডসনকে বিদায় নিতে হয় ট্র্যাজিক হিরো হয়েই।
১০০ ওভারের খেলায় প্রায় ৯৫ ওভার নিজেদের আয়ত্ত্বে থাকার পরেও পরাজিত দলের নাম ওয়েস্টইন্ডিজ।
ক্রিকেট যে আসলেই গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা তা এসব ম্যাচ ছাড়া আর ভালো কে বোঝাবে!
এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন ইএসপিএনক্রিকইনফোতে একটা কমেন্ট চোখে পড়ল। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় এরকম, ‘এটাই নিয়তি ছিল। অজিরা ৩-৪ মাস আগে অস্ট্রেলিয়াতে শ্রীলঙ্কার সাথে যা করেছিল তাতে নিয়তিই ঠিক করে রেখেছিল অস্ট্রেলিয়া – শ্রীলঙ্কা ফাইনাল হবে। সে সময় অর্জুনা (রানাতুঙ্গা) বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়াকে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে পরাজিত করব আমরা।’ পেব্যাক ইজ আ বি*।’