নিল হার্ভে, বাঁহাতের সেরা অজি

ছোটবেলা থেকেই ভাইদের দেখে দেখে ক্রিকেটব্যাটে হাতেখড়ি হার্ভে। স্কুলের হয়ে খেলার সময়েই প্রডিজি হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। স্কুল ক্রিকেটের ফাইনালে খেলেছিলেন ১১২ রানের চোখধাঁধানো এক ইনিংস, যেখানে দলের বাকিরা মিলে নিয়েছিলেন মাত্র ১৮! ফলশ্রুতিতে হাই স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঘরোয়া ক্রিকেটে ডাক পেয়ে যান ভিক্টোরিয়ার হয়ে। 

১৩, ১৫৩, ১১২, ৪ (অপরাজিত), ১৭, ৩৪, ১৭৮, ২৩ অপরাজিত, ২, ১৫১ অপরাজিত, ৫৬ অপরাজিত, ১০০, ১১৬ – ক্যারিয়ারের প্রথম ১৩ ইনিংসের মাঝেই ছয়বার ছাড়িয়েছেন তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার। অথচ বয়স তখন সবেমাত্র ২১ ছাড়িয়েছে, যে বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই নিয়মিত হতে পারেননি বিশ্বখ্যাত অনেক ক্রিকেটার। অসাধারণ ফুটওয়ার্ক আর উইকেটের চারপাশে দারুণ সব স্ট্রোক খেলে মুগ্ধ করে রাখতেন দর্শকদের। তবুও কোথায় যেন একটু আক্ষেপ, ডন ব্র‍্যাডম্যানের ছায়ায় পড়ে যাবার। তিনি নিল হার্ভে, তর্কসাপেক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সেরা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।

ছোতখাটো গড়নের হার্ভে ছিলেন ছয় ভাইয়ের মধ্যে পঞ্চম। তাঁর বড় চার ভাই-ই ছিলেন ক্রিকেটার, ভিক্টোরিয়ার হয়ে নিয়মিত খেলেছেন শেফিল্ড শিল্ড। তবে জাতীয় দলে খেলতে পেরেছেন একজন, মার্ভে। ১৯৪৬-৪৭ অ্যাশেজেও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন নিল হার্ভের এই বড় ভাই।

ছোটবেলা থেকেই ভাইদের দেখে দেখে ক্রিকেটব্যাটে হাতেখড়ি হার্ভে। স্কুলের হয়ে খেলার সময়েই প্রডিজি হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। স্কুল ক্রিকেটের ফাইনালে খেলেছিলেন ১১২ রানের চোখধাঁধানো এক ইনিংস, যেখানে দলের বাকিরা মিলে নিয়েছিলেন মাত্র ১৮! ফলশ্রুতিতে হাই স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঘরোয়া ক্রিকেটে ডাক পেয়ে যান ভিক্টোরিয়ার হয়ে। 

অভিষেক ম্যাচে তাসমানিয়ার বিরুদ্ধে ১৮ রান করে আউট হলেও নিজের প্রতিভার জানান দেন পরের ম্যাচেই। একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেন ১৫৪ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। ফলশ্রুতিতে সুযোগ পেয়ে যান এমসিসি এবং ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের জন্য ঘোষিত অস্ট্রেলিয়া। এমসিসির বিপক্ষে ৬৯ আর ভারতের বিপক্ষে ৮৭ এবং অপরাজিত ৫৬ রানের ইনিংস খেলে জানিয়ে দেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত তিনি। বোঝাই যাচ্ছিল জাতীয় দলের গন্তব্যটা খুব বেশি দেরি নয় হার্ভের জন্য।

ভারতের বিপক্ষে সেই সিরিজেরই চতুর্থ টেস্টে অ্যাডিলেডে অভিষেক ঘটে হার্ভের। মাত্র ১৩ রান করে আউট হলেও সেদিন হার্ভে নজর কাড়েন তাঁর দারুণ ফিল্ডিং দক্ষতা দিয়ে। পরের টেস্টেই মেলবোর্নে জ্বলে উঠেন ব্যাট হাতে, ভারতীয় বোলারদের কচুকাটা করে খেলেন ১৫৩ রানের ইনিংস। মাত্র ১৯ বছর বয়সে সেঞ্চুরি করে ভেঙে আর্চি জ্যাকসনের পূর্বের রেকর্ড। বনে যান অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালে অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পান হার্ভে। 

সেই সিরিজে শুরুতে সুযোগ না পেলেও চতুর্থ টেস্টের আগে কিংবদন্তি সিড বার্নস ইনজুরিতে পড়লে একাদশে সুযোগ পান হার্ভে। ইংল্যান্ডের ৪৯৬ রানের জবাব নেমে অস্ট্রেলিয়া তখন ৬৫ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে। অ্যালেক বেডসারের তোপে পড়ে ফিরে গেছেন আর্থার মরিস, হ্যাসেট এবং স্বয়ং স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান। মাথায় পাহাড়সমান চাপ নিয়ে ক্রিজে আসেন সদ্য কিশোর পেরোনো হার্ভে।

এসেই শুরু করেন পাল্টা আক্রমণ, মাত্র দেড় ঘন্টায় কিথ মিলারকে সাথে নিয়ে যোগ করেন ১২১ রান। মিলার আউট হলেও থামেননি হার্ভে, লুক্সটনকে সাথে নিয়ে গড়েন ১০৫ রানের জুটি। হার্ভের সামনে সেদিন বড্ড অসহায় লাগছিলো ইংরেজ বোলারদের। স্বয়ং স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান যেন পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর ছায়ায়। শেষপর্যন্ত ১৭ বাউন্ডারির সাহায্যে ১১২ রান করার পর থামেন তিনি। 

রানের ধারা বজায় রাখেন পরের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও। মাত্র আট ইনিংসে চার সেঞ্চুরিতে ১৩২ গড়ে করেন ৬৬০ রান। তাঁর ব্যাটে ভর করেই ঘরের মাঠে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য প্রোটিয়াদের ৪-০ ব্যবধানে বিধ্বস্ত করে অজিরা। বিশেষ তৃতীয় টেস্টে যেন অতিমানব হয়ে উঠেছিলেন হার্ভে।

প্রথম ইনিংসে ৭৫ রানে অল আউট হয়ে যাওয়া অজিদের সামনে শেষ দুদিনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৩৫। দক্ষিণ আফ্রিকার টার্নিং পিচে দুই স্পিনার হিউ টাইফিল্ড এবং টাফটি মানের সামনে টিকে থাকাই যেন দায়। ৫৯ রানেই টপ অর্ডারের তিন ব্যাটার ফিরে যেতেই ক্রিজে আসেন হার্ভে। তিনি আসার কিছুক্ষণ পর আউট হয়ে ফিরে যান আর্থার মরিসও।

কিন্তু, অবিচল ছিলেন হার্ভে, সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ক্রিজে থেকে অপরাজিত ১৫১ রানের ইনিংস খেলে জয় এনে দেন দলকে। গত শতাব্দীর টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই ইনিংসকে। সেই মৌসুমে সেবার প্রায় ৯২ গড়ে ১,৬৫৯ রান করেছিলেন হার্ভে, যা কিনা স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যানের চাইতে মাত্র ১৬ কম।

পরের বছর ক্যারিবীয় মূলুকেও ব্যাট হাতে রানের ফল্গুধারা ছোটান হার্ভে। সনী রামাধিন, আলফ ভ্যালেন্টাইনদের মতো স্পিনারদের সামলে খেলেন ২০৪ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। সেই সিরিজে ১০৮ গড়ে করেছিলেন ৬৫০ রান। ফলশ্রুতিতে অস্ট্রেলিয়াও সিরিজ জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। দুই সতীর্থ জনসন এবং আর্থার মিলার অবসর নিলে ভিক্টোরিয়ার অধিনায়কত্ব পান হার্ভে। সবাই ভেবেছিল অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্বও পাবেন তিনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে অজিদের নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয় ইয়ান ক্রেইগের হাতে।

কিন্তু অধিনায়কত্ব না পাওয়া নিয়ে কখনো আক্ষেপ ছিল না হার্ভের। জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারাটাকেই সবসময় প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। এমনকি অফফর্মের কারণে পোর্ট এলিজাবেথে পঞ্চম টেস্টের আগে সবাই যখন ক্রেইগকে ছেঁটে ফেলতে চাইছেন, এমনকি ক্রেইগ নিজেও সরে দাঁড়াতে প্রস্তুত। ঠিক তখনি ক্রেইগের পাশে দাঁড়ান হার্ভে, নির্বাচকদের সাফ জানিয়ে দেন সিরিজের মাঝে পরিবর্তন মানবেন না। ফলে সে যাত্রায় টিকে যান ক্রেইগ, অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ম্যাচ জিতে সিরিজটাও বগলদাবা করে নেয় অজিরা। 

ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে ক্রিকেট ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবেন হার্ভে। কারণ সেই সময়টাতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড থেকে পর্যাপ্ত অর্থ পাচ্ছিলেন না ক্রিকেটাররা, বারবার প্রতিবাদ জানিয়েও লাভ হয়নি। ফলে স্ত্রীর সাথে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ মূহুর্তে সিডনিতে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় সে যাত্রা মত বদলান। 

পরের বছর অজি জাতীয় দলে ফিরে আসেন হার্ভে। নিযুক্ত হন রিচি বেনোর সহকারী অধিনায়ক হিসেবে। অ্যাশেজে ব্রিসবেনে খেলেন ১৬৭ রানের চোখধাঁধানো এক ইনিংস। সেই সিরিজেও রান করেন প্রায় ৪৮ গড়ে, অজিরাও অ্যাশেজ জিতে নেয় ৪-০ ব্যবধানে। হার্ভে রানের ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছেন উপমহাদেশেও।

বাইরের ব্যাটাররা যেখানে উপমহাদেশে ব্যাট করতে ভয় পান, সেখানে স্পিনের বিপক্ষে দারুণ সাবলীল তিনি। ঢাকায় জ্বর এবং ডায়রিয়া নিয়ে খেলেন ৯৬ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। স্পিননির্ভর ঢাকার সেই পিচ এতটাই দু:সাধ্য ছিল যে ব্যাটসম্যানরা দাঁড়াতেই পারছিলেন না। সেখানে অসুস্থতা নিয়েও বুকচিতিয়ে লড়াই করেন হার্ভে।

রিচি বেনো পরবর্তীতে এই ইনিংসকে আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর দেখা অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে। পরের বছর ঘরের মাঠে অ্যাশেজ খেলে ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই কিংবদন্তি। অজিদের হয়ে ৭৩ টেস্ট খেলে ৪৮ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৬,১৪৯ রান। তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়েছেন ২১ বার, ডন ব্র‍্যাডম্যানের ২৯ সেঞ্চুরির পর অজিদের হয়ে যা কিনা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাচক হিসেবেও অনেকদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

মজার একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি, তাঁর অবসরের সাত মাস পর এক পুত্রসন্তানের জন্ম নেন ল্যাংকারশায়ারের তরুণী বারবারা ফেয়ারব্রাদার। নিজের ক্রিকেট আইডলের সাথে মিলিয়ে নাম রাখেন নিল হার্ভে। পরবর্তীতে সেই নিল হার্ভেও পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ, থ্রি লায়ন্সদের হয়ে খেলেছেন ১০ টেস্ট এবং ৭৫ টি একদিনের ম্যাচ। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...