ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ’ফাইনাল’

২০০৩ সালের পর কেটে গেছে ১৮ বছর, এই সময়ে আটটি ম্যাচ খেললেও জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ দল। এবার দেড় যুগের অপেক্ষা শেষ হবে কি সেই প্রশ্নকে সামনে রেখে মাঠে নামছে ভারতের বিপক্ষে। এই লড়াইটা কারো কাছে পদ্মার সঙ্গে গঙ্গার লড়াই।

র‌্যাংকিংয়ে ভারত অনেক এগিয়ে থাকলেও কিছুটা স্বস্থি নিয়েই আজকে মাঠে নামছে বাংলাদেশ।। গত ৭ জুন সর্বশেষ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে ২-০ গোলে পরাজিত হয়েছে জামাল ভূঁইয়ার দল। বিশেষ করে, সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলে সুনীল ছেত্রীর চেয়ে আরও দুজন খেলোয়াড়কে নিয়ে বাংলাদেশ শিবিরে ছিল চিন্তার ভাজ। একজন ডিফেন্ডার সন্দেশ ঝিঙ্গান ও আরেকজন উইঙ্গার আশিক কুরিয়ানি। মূলত ইনজুরি সমস্যার কারণে আজকে তাঁদের সার্ভিস পাচ্ছেনা ভারত।

সাফ ফুটবলের পরিস্কার ফেবারিট দলটির নাম ভারত। ১২ আসরের মধ্যে ৭টিতেই শিরোপা উল্লাসে মেতেছে দলটি। সেরা দল নিয়ে যেমন সাফল্য পেয়েছে ঠিক তেমনি ‘বি’ টিম পাঠিয়েও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। তবে চলতি সাফ চ্যাম্পিয়নশীপে সেরা দলটাকেই মালদ্বীপের মালেতে পাঠানো হয়েছে। আজকে দ্বিতীয় ম্যাচে শক্তির বিচারে এগিয়ে থাকা দলটির মোকাবেলা করবে বাংলাদেশ।

বিকাল চারটায় মালে ফুটবল ষ্টেডিয়ামে কঠিন এক লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে জামাল ভুইয়ার দলকে। তাই ফাইনালের আগে আরেক ফাইনাল হিসেবে অবিহিত করা হচ্ছে এই লড়াইকে। ভারতের ফুটবল এখন অনেক এগিয়েছে। ঠিক সেভাবেই পিছিয়ে পড়েছে লাল সবুজ দেশটির প্রিয় খেলাটি। র‌্যাংকিং এটাই প্রমাণ দিচ্ছে। ১৮৯ তে যেখানে বাংলাদেশ সেখানে ১০৭ এ রয়েছে বাংলাদেশ। সাফের আগে কিরগিজস্তানে ত্রিদেশীয় সিরিজে ১০১ ও ১০২ র‌্যাংকিং এ থাকা ফিলিস্তিন ও স্বাগতিক দেশের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই পরাজিত হয়েছে জেমি ডে’র শীষ্যরা।

এমনকি কিরগিজস্তান অনুর্ধ্ব-২৩ অলিম্পিক দলের কাছেও পরাজয়ের বেদনায় নীল হতে হয়েছে। সাফের প্রস্তুতির পর প্রথম ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে ১-০ গোলের জয় দিয়ে পূর্ণ ৩ পয়েন্ট অর্জন করে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে মাঠে নামার অপেক্ষায় রয়েছে সুনীল ছেত্রীর দল।

তবে র‌্যাংকিং এ পিছিয়ে থাকা শ্রীলংকার পাশাপাশি শক্তির বিচারে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের মাত্র ১-০ গোলের জয়টাকে তাই স্বস্থির বলা যাবেনা। ফিনিশিংয়ের অভাবটা তাই দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। ভারতের মতো দলের বিপক্ষে সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। বড় দলগুলোর মধ্যে একমাত্র নেপালই এখনো পর্যন্ত সাফের ফাইনালে খেলতে পারেনি।

তবে প্রথম ম্যাচেই মালদ্বীপকে হারিয়ে দারুণ একটা চমকই দেখিয়েছে। অথচ ৩৬ মিনিটে ১০ জনের দলে পরিণত হওয়া লংকানদের হারাতে রীতিমতো ঘাম ঝড়াতে হয়েছে। পেলান্টি গোলের বদান্যতায় জয়টাকে তাই প্রশ্নের মুখে দাড় করিয়েছেন ভারতের কোচ ইগোর স্টিমাচ। যে পেলান্টিতে গোল করে জয় এসেছে সেখানে নাকি এরকম কিছু ছিলনা।

তবে ভারত কোচের এমন মন্তব্যকে পরের ম্যাচের জন্য প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার একটা কৌশলও মনে করছেন কেউ কেউ। ৫৬ মিনিটে পাওয়া পেলান্টি থেকেই গোল করেছেন বাংলাদেশে তপু বর্মন। এটিকে হাস্যকর বলার পাশাপাশি নেপালের বিপক্ষে মালদ্বীপ ভাল খেলেও হেরে যায় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। আর এসবকে পেছনে রেখে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে জয়ে চোঁখ টিম ভারতের।

নিজেদের স্বাভাবিক আর সেরা খেলাটা খেলে তবেই সাফল্য পেতে হবে মত দিয়েছেন স্টিমাচ। বোঝা যাচ্ছে মাঠের লড়াইয়ের আগেই মাঠের বাইরের কথার লড়াই জমে ওঠেছে। যদিও এখন বাংলাদেশ অনুপস্থিত রয়েছে। তবে কোচ অস্কার ব্রুজোন বলেছেন, ‘সাফে বাংলাদশের যে দলটা খেলছে সেটিকে সেরা না বলে উপায় নেই। দারুণ একটা কম্বিনেশনের দলেও পরিণত হয়েছি আমরা। তাই ভারতের বিপক্ষে জয়ের প্রত্যাশা নিয়েই মাঠে নামবে বাংলাদেশ।’

কিন্তু গোল করবে কে সেই প্রশ্ন আবারো সামনে চলে এসেছে। সুমন রেজা, মাহবুবুর রহমান সুফিল, মতিন মিয়াদের কেউ পাননি জালের দেখা না পাওয়ায় বাড়ছে দুশ্চিন্তা। জাতীয় ফুটবল দলের খণ্ডকালীন কোচ ব্রুজোন তাই জয়ে শুরু করলেও খুশি হতে পারেনি। তাই আক্রমণভাগ নিয়ে নির্ভার হতে পারারও কোন সুযোগ থাকছেনা। বিশেষ করে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে তো এমনটি করার কোন সুযোগই নেই। আজকের ম্যাচে ফরোয়ার্ডদের ফিনিশিং নিয়ে আরও বেশি কাজ করতে হবে বাংলাদেশকে। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে ভাল খেলেও জালের নাগাল পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রথম লেগে কলকাতার সল্টলেকে ১-১ ড্র ম্যাচে সাদ উদ্দিনের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল দল। ফিরতি লেগে গত জুনে কাতারে আবার হেরে গিয়েছিল ২-০ ব্যবধানে।

বর্তমানে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ৮২ ধাপ এগিয়ে রয়েছে ভারত। শক্তি আর সামর্থ্যে এগিয়ে থাকা দলটির বিপক্ষে গোলের সুযোগ যে কম মিলবে, সেটা আগেভাগেই বুঝতে পারছেন ব্রুজোন। জয় দিয়ে আসর শুরু করতে পারায় লাল-সবুজ দলের ফুটবলাররা বেশ ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছেন। এভাবেই রেকর্ড সাতবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে মোকাবিলা করার জন্য সতীর্থদের উদ্ধুদ্ধ করতে চান জামাল ভূঁইয়া। সাফ অঞ্চলের মধ্যে ভারতের র‌্যাঙ্কিং সবচেয়ে কম আর এগিয়ে রয়েছে। সর্বোচ্চ ৯৬ নম্বরেও ছিল দলটি। সাফে অংশগ্রহনকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানে।

র‌্যাঙ্কিংয়ে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও প্রতিবেশী দুই দেশের লড়াই মানেই ভিন্ন এক উন্মাদনার নাম। কিরগিজস্তানের ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ফিলিস্তিন ও স্বাগতিক দলের বিপক্ষে গোল না পেলেও কিরগিজস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কাছে ৩-২ ব্যবধানে হেরে যাওয়া ম্যাচে দুটি গোল করেছিলেন ফরোয়ার্ড সুমন রেজা। সাফে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বেশ কয়েকবার আক্রমণে উঠলেও উত্তর বারিধারার এই ফরোয়ার্ড কাঙ্খিত গোলের দেখা পাননি। এছাড়া মতিন মিয়া, মাহবুবুর রহমান সুফিলরা হতাশ করেছেন। নাম্বার নাইনের যে কতটা প্রয়োজন রয়েছে দলে সেটি আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে।

ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে দলের সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান রক্সি বলেন, ‘শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে রণকৌশল ঠিক করা হয়েছে। ব্রুজোনের সঙ্গে সবাই মিলে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য একটা পরিকল্পনা এরই মধ্যে করা হয়েছে। ভারত ম্যাচের আগে আরও চিন্তা করব আমরা। পরের ম্যাচে যেন পরিকল্পনার প্রতিফলন দেখা যায়, সেভাবেই দলকে তৈরি করা হচ্ছে।’

তবে ভারতের বিপক্ষে গোল আদায় করা কঠিনই হবে বলে মনে করছেন এই সাবেক ফুটবলার। এদিকে প্রতিবেশী দেশটির বিপক্ষে মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে আছেন লাল-সবুজ ফুটবলাররা। মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ মানেই সবসময়ই হাইভোল্টেজ ম্যাচ হয়ে থাকে। আমাদের সব খেলোয়াড় এই ম্যাচ খেলার জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা সল্টলেকে ভালো খেলেও জিততে পারিনি। এবার জয়টা পেলে ফাইনালের আগে আত্ববিশ্বাস বাড়বে।’

প্রথম ম্যাচের আগে ডিফেন্ডার রেজাউল করিম রেজা জ্বরে আক্রান্ত বলে অনুশীলনের বাইরে থাকলেও জ্বর থেকে সুস্থ হয়ে মালেতে দলের সঙ্গে প্রথমবার অনুশীলন করেছেন মিডফিল্ডার সোহেল রানা। ভারতের বিপক্ষে খেলার সম্ভাবনা আছে অভিজ্ঞ এই মিডফিল্ডারের। সেক্ষেত্রে দলের শক্তিটা কিছুটা হলেও বাড়বে।

প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দারুণ একটা ম্যাচ উপহার দিয়েছে জামাল ভঁ‚ইয়ারা। বল নিজেদের দখলে রাখার পাশাপাশি নিখুঁত পাসিং ফুটবল খেলে মন ভরালেন সমর্থকদের। ম্যাচ শেষে জয়ের কারণে জাতীয় দলে অভিষিক্ত কোচ অস্কার ব্রুজোনের মুখে ছিল তৃপ্তির হাসি। কিন্তু বিজয়ের উচ্ছাসের পাশাপাশি কোচকে কাঁটার মতোই খোঁচাচ্ছিল আরও একাধিক গোল না পাওয়ার যন্ত্রণা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একাধিক গোলের সুযোগ নষ্ট করেছেন সুমন রেজা ও সুফিলরা। এবার প্রতিপক্ষ ভারত বিধায় সুযোগ হাতছাড়া করার কোন সুযোগ থাকবে না।

এদিকে ভারতকে হারানোর প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আলফাজ আহমেদ বলেন, ‘আজকে যদি ভারতকে হারাতে পারে বাংলাদেশ তাহলে ফাইনালের আশা উজ্জ্বল হবে। এখন জয় পাবে কি না সেটাই সংশয় রয়েছে। ভারতকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া মানে মাঠে খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত চাপে থাকা। অস্বীকার করব না আমরাও যখন ভারতের বিপক্ষে লড়তাম চাপে ছিলাম। এখন নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে জয় পাওয়া সম্ভব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link