ব্যাটিং টেকনিকের ‘ওভাররেটেড’ ধারণা

দুই-একদিনের জন্যও যদি কোন কোচের মাধ্যমে ট্রেনিং নিয়ে থাকেন, আপনি জানেন আপনাকে এই নিয়মেই ব্যাটিং অনুশীলন করতে হবে, আপনার ব্যাটিং ধরণ যে কোন কিছুই হোক না কেন। স্ট্যান্স সোজা হবে, কাধের উপর থেকে তাকাতে হবে, বলের দিকে যতখানি সম্ভব পা নিয়ে যেতে হবে, ড্রাইভ করার সময় ব্যাটের ফেইস ওপেন করা যাবে না, বডি আর মুভ করবে না, সামনের পায়ে ভর দিয়ে পুল শট খেলা যাবে না, শরীরের ওজন পিছনের পায়ে চাপিয়ে দিয়ে, শরীরকে পিছিয়ে নিয়ে এসে পুল বা হুক শট খেলা যাবে, সিম্পল।

ক্রিকেটে ব্যাটিং টেকনিকের যেই চিরাচরিত ধারণাটি আমরা পোষণ করি, সেটি একটি অধিমূল্যায়িত (ওভাররেটেড) ধারনা। আমরা সম্ভবত খেয়ালই করতে চাই না চারপাশে কতখানি পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। আদি টেকনিকের আলোচনায় গেলে, আমাদের বাংলাদেশিদের খুব বেশি কষ্ট করার দরকার হয় না।

দুই-একদিনের জন্যও যদি কোন কোচের মাধ্যমে ট্রেনিং নিয়ে থাকেন, আপনি জানেন আপনাকে এই নিয়মেই ব্যাটিং অনুশীলন করতে হবে, আপনার ব্যাটিং ধরণ যে কোন কিছুই হোক না কেন। স্ট্যান্স সোজা হবে, কাধের উপর থেকে তাকাতে হবে, বলের দিকে যতখানি সম্ভব পা নিয়ে যেতে হবে, ড্রাইভ করার সময় ব্যাটের ফেইস ওপেন করা যাবে না, বডি আর মুভ করবে না, সামনের পায়ে ভর দিয়ে পুল শট খেলা যাবে না, শরীরের ওজন পিছনের পায়ে চাপিয়ে দিয়ে, শরীরকে পিছিয়ে নিয়ে এসে পুল বা হুক শট খেলা যাবে, সিম্পল।

রাহুল দ্রাবিড়, মোহাম্মদ ইউসুফ, কুমারা সাঙ্গাকারা বা শিবনারায়ন চন্দরপলরা এই তত্ত্বের সমর্থক, পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে তারা এভাবেই ব্যাটিং করে গিয়েছেন। কিন্তু তারমধ্যেও তারা কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন, দ্রাবিড়, সাঙ্গাকারারা যখন ব্যাক শাফল করে বলের লাইনে গিয়েছেন, চন্দরপল সেখানে সাইডওয়েজ শাফল করেছেন, ক্যালিস তো ব্যাক শাফল করে আবার ফ্রন্ট ফুট প্ল্যান্ট করে রাখতেন অতিরিক্ত সময় পাওয়ার জন্য।

অপরদিকে শহীদ আফ্রিদি, আব্দুল রাজ্জাক বা ক্রিস গেইলরা দেখালেন বল জোরে মারতে চাইলে পা বলের কাছে নেয়ার থেকে দূরে নিলে ভালো হয়। ব্যাট ঘোরানোর জন্য অতিরিক্ত জায়গা পাওয়া যায়, শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে দেয়া যায়। এখন তো এটাই প্রতিষ্ঠিত টেকনিক।

বীরেন্দ্র শেবাগ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, হাশিম আমলা কিংবা হালের ডেভিভ ওয়ার্নাররা দেখালেন ড্রাইভ করার জন্য ফিট মুভমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ না, হাত এবং চোখের ব্যালান্সই গুরুত্বপূর্ণ। পন্টিং দেখালেন ফ্রন্ট ফুটে পুল করা, লারা দেখালেন মুভিং ফুটে ড্রাইভ করা, স্টিভ ওয়াহ দেখালেন ড্রাইভ করার পরেও ফিট মুভমেন্ট সম্ভব!

আর একজন ছিলেন, শচীন রমেশ টেন্ডুলকার, দ্য ট্রু সায়েন্টিস্ট। তিনি তার প্রয়োজন অনুসারে এর সবগুলো করে দেখিয়েছেন। বলের কাছে পা নিয়ে ড্রাইভ করেছেন, দূরে সরিয়েও ড্রাইভ করেছেন। ফ্রন্ট ফুট পুল, ব্যাক ফুট পুল, শাফল করে থ্রু দ্যা লাইন শট, পা সরিয়ে নিয়ে স্লগ করা, সবকিছু ছিলো তার ব্যাটিংয়ে।

ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, ডেনিস লিলির যুগে হাই ব্যাক লিফট নিয়ে এক ওভার কেউ ব্যাটিংয়ে টিকে যাবে, এমন ভাবনাটাই অবিশ্বাস্য ছিলো। শচীন, লারা, পন্টিংরা কেবল টিকেই গেলেন না, ক্রিকেটকেও টিকিয়ে গেলেন খোলস থেকে বের করে নিয়ে এসে।

পরের জেনারেশনে কেভিন পিটারসেন এলেন, আমি বলি আধুনিক ইম্প্রোভাইজ ক্রিকেটের জনক। তিনি কাধের উপর থেকে তাকান না, স্ট্যান্সকেই ওপেন করে নিয়ে সরাসরি বল দেখেন। লম্বা পায়ের পুরোটাই ব্যবহার করলেন স্ট্যান্সে, দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে শরীরকে ছোট করে নিয়ে আসলেন। শাফল করেন, মুভ করেন, স্ট্যান্স এবং লম্বা পায়ের পুরোটাই কাজে লাগিয়ে গুড লেন্থ বলগুলোকে ফুলার লেন্থ বল বানাতে শুরু করলেন। শরীর ছোট করে নিয়ে আসার কারনে বলের সাথে রাইজ করতে পারেন। ফলে গুড লেন্থ বলগুলোতে অবলীলায় লফটেড শট খেলতে পারেন।

শর্ট অফ লেন্থ বলগুলোকে ফ্রন্ট ফুটে গুডলেন্থ বল বানাতে পারেন, ব্যাকফুটে শর্ট বল বানাতে পারেন। একই সুবিধা নিয়ে স্কুপ করতে পারেন, রিভার্স সুইপ করতে পারেন সুইপের মতই স্বাভাবিক ভঙ্গিমায়। ইনোভেশনের চুড়ান্ত দেখালেন সুইচ হিটের মাধ্যমে। এখন, অসংখ্য ব্যাটসম্যানের স্ট্যান্স ওপেন দেখবেন, তারা কাধের উপর থেকে তাকান না, বলের লাইনে গিয়ে শট খেলেন না, সুইপ-রিভার্স সুইপ একইভাবে করতে পারেন স্ট্যান্সের সুযোগ নিয়ে।

এবি ডি ভিলিয়ার্স, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, জশ বাটলাররা তো এই ইনোভেশনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে গিয়েছেন, তারা এখন গুড লেন্থ ডেলিভারিকে ব্যাকফুটে দাঁড়িয়ে লং অফ এর উপর দিয়ে ছক্কা হাকান। প্রসঙ্গত, এখানে ছোট করে আমাদের মুশফিকুর রহিমের নামও নেয়া যায়। অবশ্যই উপরে উল্লেখিত ব্যাটসম্যানদের শক্তি কিংবা প্রভাবের সাথে তাঁর পার্থক্য রয়েছে।

তারপরেও টেকনিকের এই টিউনিং বা কারেকশন করে তিনি উইকেটের সবদিকেই রান বের করার যায়গা করে নিয়েছেন। এবং এরা সকলেই একসাথে আদি টেকনিক বলতে যা বুঝতাম, ক্রিকেটকে সেখান থেকে বের করে এনেছেন।

স্টিভেন স্মিথ, মার্নাস ল্যাবুশেন বা প্রয়াত ফিল হিউজের টেকনিককে কি বলবেন? মহেন্দ্র সিং ধোনির টেকনিক? কিংবা ফাওয়াদ আলম? তাহলে টেকনিকের যে ধারণা আমরা ধরে রেখেছি তার কাজ কি? কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

এর উত্তর আমার কাছে খুব সহজ। টেকনিকের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। হাজার হাজার ক্রিকেটাররা যেই জিনিসটার অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের ভিত তৈরি করেছেন, সেটি খামখেয়ালিভাবে তৈরি হয় নি। কিন্তু টেকনিক কোন এন্ড রেজাল্ট প্রোডাক্ট না। প্রতি মুহুর্তে এর টিউনিংয়েরও প্রয়োজন আছে। আপনার ক্যাপাবিলিটি, আপনার ইলাস্টিসিটির উপর নির্ভর করবে আপনার জন্য টেকনিক কেমন হওয়া উচিত।

বাবর আজম সম্পূর্ণ বলের লাইনে গিয়ে কাভার ড্রাইভ করেন, বিরাট কোহলি বলের লাইনে তার হাত নিয়ে যান, দুইজনেই এফেক্টিভ। আবার বিরাট কোহলি স্টেডি স্ট্যান্স নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও এখন শাফল করে স্ট্যান্স নেন। শচীন প্রয়োজনে শাফল করে স্ট্যান্স নিলেও, সাধারনত স্টেডি স্ট্যান্সেই ব্যাটিং করতেন। টেকনিক কোন ফিক্সড ডিপোজিট না, আপনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারেন।

প্রসঙ্গত, জানিয়ে রাখি, তামিম ইকবালের উচিত তার টেকনিক নিয়ে আবারও কাজ করা। একটা সময়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে তামিমকে সমস্যায় পড়তে হত, সেটি ঠিক করতে গিয়ে তিনি ফ্রন্ট ফুট প্ল্যান্ট করা শুরু করেন। ফ্রন্ট ফুট প্ল্যাট করতে গিয়ে তিনি অনেকখানি ফ্রন্ট ফুটে চলে আসেন।

গুড লেন্থ ডেলিভারি ভিতরের দিকে আসলে প্ল্যান্টেড ফ্রন্ট ফুট তিনি আর সামনে নিতে পারেন না, শরীরের ভর ফ্রন্ট ফুটে থাকার কারণে তিনি আর পিছনেও মুভ করাতে পারেন না। সাম্প্রতিক সময়ে তামিমের অধিকাংশ উইকেট দেখবেন গুড লেন্থ/ফুলার লেন্থ ডেলিভারি যেগুলো ভিতরের দিকে আসছে, সেগুলোতে তিনি ফিট মুভ করাতে পারছেন না, ব্যাট পায়ের সামনে আনতে নিজের শরীর বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে, তিনি বলের উপরে পড়ে যাচ্ছেন এবং এলবিডব্লিউ কিংবা বোল্ড হয়ে যাচ্ছেন।

তামিম চাইলে ক্যালিসের স্ট্যান্স ফলো করতে পারেন। জ্যাক ক্যালিস ফ্রন্ট ফুট প্ল্যান্ট করলেও স্ট্রাইড ছোট রাখতেন এবং শরীরের ওজন আগেই ফ্রন্ট ফুটে চাপিয়ে দিতেন না। ফলে বলের লেন্থ এবং লাইন অনুযায়ী পা মুভ করতে পারতেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...