১৯৮১। উইম্বলডনের ফাইনালে মুখোমুখি বিয়র্ন বার্গ আর জন ম্যাকেনরো। টেনিস দুনিয়া যে ম্যাচটিকে জানবে আইস ভারসেস ফায়ার হিসাবে। বোম্বের গোটা ‘সাহিত্য সহবাস’ ঢলে পড়েছে বিয়র্ন বার্গের দিকে।
ম্যাকেনরোর সমর্থক কেবল ছোটো একটি ছেলে। ম্যাচটি জিতেছিলো ম্যাকেনরো। আর ম্যাকেনরোর সমর্থক হিসাবে জয়ের হাসিটাও হেসেছিলো সেই ছোট্ট ছেলেটি যাকে ক্রিকেটবিশ্ব চিনবে ‘টেন্ডুলকার’ হিসেবে। সাংবাদিক দেবাশীষ দত্ত শচীনের ম্যাকেনরো সমর্থক হবার পিছনে বলেছিলেন, একজন অসামান্য সবসময় একজন অসামান্যকেই বেছে নেয়।
আসলে ম্যাকেনরো ছিলেন অগ্নির উপাসক। শচীনও তাই। আবার শচীনের পরবর্তীকালের আরাধ্য টেনিস সম্রাট বরিস বেকারও তাই। শুধু শচীনের উপাস্য আগুনের ভিতর ছিলো স্নিগ্ধতা, তাই হয়তো শীতল সরের প্রলেপে সেই আগুনে ঝলকানি দেখেননি অনেকেই। কিন্তু শিয়ালকোটের সেই শীতল মৌসুমে মুখের রক্ত মুছে ওয়াকারকে ব্যাক টু ব্যাক বাউন্ডারি মেরে তাক করা শচীনের সেই দুটি ঝলসে যাওয়া চোখ, কিংবা হেনরি ওলোঙ্গার ওপর বারুদবর্ষণ, সেই আগুনে আহুতি দিতে হয়েছে প্রতিপক্ষকে, কিন্তু স্নিগ্ধতার সাথে, শীতলতার সাথে। এই আগুনটা উপাস্য। এই টেন্ডুলকারও উপাস্য।
শচীন তেন্ডুলকার যখন স্কুলছাত্র ছিলেন তখন স্কুলে মোট বাহান্নটি ছুটি পেতেন। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, এই বাহান্নটি দিনই একটা ক্রিকেট বলকে ঝুলিয়ে শ্যাডো আর ব্যাকলিফট প্র্যাকটিস করে যেতেন একনাগাড়ে। আর আজ প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সেও শচীন তেন্ডুলকার টানা নেট প্র্যাকটিস করে চলেন একটা রোড সেফটি ওয়ার্ল্ড সিরিজের জন্যেও, একটা অল স্টার চ্যাম্পিয়নশিপের জন্যেও।
এখানেই শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেটার থেকে ক্রিকেট উপাসক হয়ে গেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের উত্থানের সময়কাল হিসাবে অনেকেই ১৯৭১ কে বলেন। আদতে সেটাই ঠিক। আর শচীন তেন্ডুলকার ছিলেন নীলজাতির ক্রিকেট খেলাকে ক্রিকেট ধর্মে রূপান্তর করা একজন ক্রিকেট পূজারী। শচীন এক অদ্ভুত মাধ্যাকর্ষণ যাতে আটকা পড়েছে ভারতীয়দের সব ক্ষোভ-উল্লাস,হর্ষ-বিষাদ,রাগ-প্রশান্তি আর শত শত জীবন।
’১৩ এর নভেম্বরে যখন ৭৪ রানে আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন প্যাভিলিয়নের দিকে জীবনের শেষবারের মতো, গেইলদের উইন্ডিজ গার্ড অব অনার দিয়েছিলো তাঁকে। সে রাত্রেও দাদা অজিত টেন্ডুলকারকে ফোন করেছিলেন শচীন। জানতে চেয়েছিলেন সেই আউট হবার টেকনিক্যাল ফল্টগুলো।তখন হয়তো শচীনের মননে সেই অমোঘ বাচ্যটি ধরা দেয়নি – ‘I shall never pass this way again’ – এই ছেড়ে যাওয়া পথে তিনি যে আর কখনও অগ্রপথিক হবেন না।
শচীনের অবসরের সময়টা খুব মনে পড়ে। ইডেনে ১৯৯ কেজির গোলাপ ছড়ানো হয়েছিলো তাঁর ১৯৯ তম টেস্ট ম্যাচকে স্মরণ করে। ম্যাচ শেষে প্রেজেন্টেশন প্রোগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। পরিয়ে দিয়েছিলেন রাজমুকুট। আলিঙ্গন করলেন তাঁকে। কিন্তু কেন জানিনা মনে হয়েছিল শচীন অত্যন্ত বেশি আড়ষ্টভাবে জড়িয়ে আছেন তাঁর সবুজ পিচের সখাকে।
হয়তো শেষবেলায় মানুষ বেশি বেশি আঁকড়ে ধরতে চায়। শচীনও আঁকড়ে ছিলেন তাঁর জীবনের ঘনিষ্ঠতম ছায়াটিকে। ওয়াঙখেড়েতে জীবনের শেষবারের মতো ভাষণ দিতে যখন এলেন,তখন চারিদিকে ‘শচীন… শচীন’ ঐক্যতান,আওয়াজ এতোটাই বেশি যেটাতে চেপে যাচ্ছিলো মাইকের আওয়াজটাও।
অবশেষে শচীন বলে উঠলেন – ‘তোমরা শান্ত হও, আমি আরও আবেগী হয়ে পড়ছি।’ সবশেষে আস্তে আস্তে ওয়াংখেড়ের পিচের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি, প্রণাম করে নিলেন নিজের উপাসনাগৃহটিকে। চব্বিশটা বছর ধরে এই যে ছাত্র-নবিশী-উপাসক সত্ত্বার ধরা পড়ে যাওয়া কেবল একটা মানুষকে ঘিরে, এ ঘটনা ভারতবর্ষে আগে ঘটেনি। শচীন সেদিন কেঁদেছিলেন কিনা জানিনা, তবে সংবাদপত্রে শচীনের পানামা হ্যাট পরে আকাশের দিকে উর্ধপানরত চোখের ছবির নীচে লেখা বেরিয়েছিলো – ‘ভগবানের চোখে জল।’ শচীন ক্রিকেট ঈশ্বর কিনা এটা বিতর্কিত হলেও, শচীন ক্রিকেটকে ঈশ্বর মেনেছেন-এটা নিয়ে কোনো বিতর্কের তরজা আসমুদ্র হিমাচলে কোনোদিনও হবেনা।
মনে পড়ছে ২০০৭-০৮ এর কমনওয়েলথ ব্যাংক সিরিজকে। লি-ব্র্যাকেনদের এমনভাবে খেলছিলেন শচীন, ঠিক যেন সেই বৃদ্ধ বট, যে চারপাশে ডালপালা ছড়িয়ে কত নতুন পাতাকে আশ্রয় দিয়ে চলেছে। মনে পড়ছে ৯৬’এর বিশ্বকাপটাও। নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। শুনেছি শুধু।
শুনেছিলাম শচীন নাকি আগুন জ্বালিয়েছিলেন। ছোটোবেলায় আগুন জ্বালাবার মানে বুঝতামনা।এখন বুঝি। এটা সেই জন ম্যাকেনরোর আগুন। এটা বরিস বেকারের আগুন। এটা সেই উপাসনার আগুন, যে আগুনের বিশুদ্ধ ওমে হাত রেখে পবিত্র হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট।
শচীন টেন্ডুলকার জীবনের প্রথম ইরানি ট্রফি সেঞ্চুরি যেদিন করেন, সেইদিন সুনীল গাভাস্কার তাঁকে নিজের প্যাড উপহার দিয়েছিলেন, যে প্যাড পরে ১৯৮৭ রিলায়েন্স কাপে জীবনের শেষ ম্যাচগুলি খেলেছিলেন গাভাস্কার। সেই সময়ে কিশোর শচীনের আকাশের দিকে চেয়ে থাকার একটি ছবি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। ক্রিকেট সাহিত্যিক এই ছবি নিয়ে কিছু লিখলে সেটা হয়তো নির্ঘাৎ এরকম হতো –‘সুনীল আকাশ আর কত দূরে’।
ভারতবর্ষের সেইসময়কার আকাশ সত্যিই সুনীলময়, যার মধ্যে একযুগ ধরে বয়েছে বিজয় মার্চেন্ট ঘরানার রক্ত। কিন্তু শচীন সুনীল আকাশকে ছুঁতে চাননি। তিনি আরেকটা আকাশ হতে চেয়েছেন। একটা কাছের আকাশ। যে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভারতবাসী নিজের সমস্ত অভিমান উগরে দেবে,২০০৩ এর স্বপ্নভঙ্গের আসামী করবে, আবার যার একটু অপমানে, একটু বিপদে উজার করে দেবে নিজেদের,যার একটু সাফল্যে অকাল দীপাবলি ঘটবে ভারতে।
তাদের রাগ-অভিমান-আনন্দ-জয়-উল্লাস প্রকাশের একমাত্র দায়ী হওয়া ব্যক্তি, অনেকটা ঈশ্বরের মতোই, সেটা ক্রিকেট হিসাবে না হোক অনেকটা সমস্ত ভাব উজার করে দেবার মাধ্যম হিসাবে খানিকটাতো বটেই।
মহামারী, বন্যা, জ্বরা, শোক, আনন্দ, উল্লাস, কৃষক আন্দোলন, বিপ্লব,অভ্যুত্থান – সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষ শচীন, ব্যক্তি শচীন, ক্রিকেটার শচীনকে পাবার জন্য একটা গোটা ভারতবর্ষের যে আকুতি, এই আকুতিটাই শচীন টেন্ডুলকার নামটিকে সজীব করে রাখবে আগামী পঞ্চাশ বছর ধরেও। এই আকুতি কখনও পূরণ হবে, কখনও পূরণ হবেনা। কিন্তু রয়ে যাবে বিশ্বাসটা – আকাশের মতো করেই।