টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ: শ্বাসরুদ্ধতার শেষ কথা

২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসেছে আট বার। এই আসর গুলোতে অনেক হাড় হিম করা শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচের স্বাক্ষী হয়েছে ক্রিকেট প্রেমীরা।

২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসেছে আট বার। এই আসর গুলোতে অনেক হাড় হিম করা  শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচের স্বাক্ষী হয়েছে ক্রিকেট প্রেমীরা। অসংখ্য রোমাঞ্চক স্মৃতির জন্ম দিয়েছে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অনেক ম্যাচই ক্লাসিক ম্যাচের মর্যাদা পেয়েছে। এমনই জনপ্রিয় কিছু ম্যাচের স্মৃতিচারণ করবো আজ।

  • অস্ট্রেলিয়া – জিম্বাবুয়ে (গ্রুপ পর্ব, ২০০৭) – জিম্বাবুয়ে ৫ উইকেটে জয়ী

২০০৩ সালে ক্রিকেট বোর্ডে রাজনীতির সংমিশ্রণ, ২০০৪ সালে অধিনায়ক হিথ স্ট্রিককে জোর করে বাদ দেওয়া এবং ১৫ ক্রিকেটারের সেচ্ছায় অবসর সব মিলিয়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের মহাপতন। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপসহ কোন ওয়ানডে ম্যাচ না জেতা, টেস্টও হারের বৃত্তে আটকে থাকা জিম্বাবুয়ে শেষ পর্যন্ত টেস্ট থেকেই সরে দাঁড়ায়।

এই জরাজীর্ণ দল অংশগ্রহণ করে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। সে আসরে ৪ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় তারা। সাম্প্রতিক জিম্বাবুয়ের পারফরম্যান্স ও দলে তেমন কোন তারকা না থাকায় গুটি কয়েকজন ছাড়া কেউই তাদের নিয়ে মিথ্যা আশা দেখছিল না। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিং, ম্যাথু হেইডেন, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, ব্রাড হজদের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ আর ব্রেট লি, মাইকেল ক্লার্ক, ব্রাকেন, জনসনদের বোলিংয়ের সামনে জিম্বাবুয়ে ঠিক কত রান করতে পারবে তা নিয়ে চলছিল নানান কথা।

কিন্তু কে জানতে এই শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ ধসে দিবেন এলটন চিগুম্বুরা, গ্যারি ব্রেন্টর, মাসাকাদজারা। ৫০ রান যোগ করার আগেই প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে দিবেন তাদের টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে। জিম্বাবুয়ের উইকেট নেওয়ার উৎসবে দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে আনার জোর চেষ্টা চালিয়েছেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস ও ব্রাড হজ। দুইজনের ৩০ উর্ধ্ব ইনিংসে ৯ উইকেটের বিনিময়ে ১৩৮ রান সংগ্রহ করে অজিরা।

তখনও সবার ভাবনা ছিল বোলারদের ক্যামিওতে জিতে যাবে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেদিন আর ব্রেট লির গতি, নাথান ব্র্যাকেনের সুইং, ব্রেন্ডন টেলরদের দমাতে পারেনি। সিবান্দা, টেলরের ৩১ রানের উদ্বোধনী জুটি জয়ের আশা দেখায় তাদের। কিন্তু সংশয় জাগে ম্যাচের শেষ ওভারে। তখন ৬ বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন পড়ে ১২ রানের! বল করছিলেন ব্রাকেন। প্রথম বলেই বাউন্ডারি হাঁকান দলকে জয়ের স্বপ্ন দেখানো টেলর। দ্বিতীয় বলে নিলেন ১ রান। প্রান্ত বদলে স্ট্রাইকে তখন চিগুম্বুরা।

আস্থার প্রতিদান দিয়ে ৩য় বলে ২ রান ও ৪র্থ বলে ১ রান নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন টেলরকে। হাতে আছে ২ বল, জয়ের জন্য প্রয়োজন ৪ রান। আজিদের আর শেষ রক্ষা আর হলো না। ৫ম বলেই জয় তুলে নেয় জিম্বাবুয়ে। লেগ বাই থেকে আসে জয়ী ৪ রান। ৫ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় আফ্রিকানরা। ম্যাচের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট হাতে লড়াই করা টেলরের ব্যাট থেকে আসে ৪৫ বলে ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস। বাউন্ডারি হাঁকান ৪টি, ওভার বাউন্ডারি ২টি।

  • ভারত-পাকিস্তান (ফাইনাল, ২০০৭) – ভারত ৫ রানে জয়ী

২০০৭ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে দুই দল মুখোমুখি হয়। সে ম্যাচে মিসবাহ উল হকের প্রাণপণ চেষ্টায়ও ম্যাচ জিততে পারেনি পাকিস্তান। ড্র থাকা অবস্থায় ম্যাচ শেষ হলে বল আউট পদ্ধতিতে ৩-০ তে জয় লাভ করে ভারত। কিন্তু তখনই শেষ নয় এশিয়ার দুই পরাশক্তি আবারও মুখোমুখি হয় ফাইনালে।

ভারত পাকিস্তান ম্যাচ মানেই বাড়তি উত্তেজনা। আর সেটা যদি হয় কোন বড় আসরে কিংবা কোন টুর্নামেন্টের ফাইনাল তাহলে তো আর কথাই নেই! ফাইনালে আগে ব্যাট করতে নেমে গৌতম গম্ভীরের ৭৫ আর রোহিত শর্মার ৩০ রানের ইনিংসে ১৫৭ রানের সংগ্রহ পায় ভারত।

জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে রুদ্র প্রতাপ সিং, ইরফান পাঠান আর যোগিন্দর শর্মার বোলিংয়ে তোপে থিতু হতে পারেননি মোহাম্মদ হাফিজ, কামরান আকমল, শোয়েব মালিক, শহীদ আফ্রিদিরা। তবে সেদিন ইমরান নাজিরের ব্যাটিং ভালো কিছু উপহার দিতে পারতো পাকিস্তানকে। ২৩০+ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা নাজির ১৪ বলে ৩৩ রান করে ফিরলেন রান আউট হয়ে। এতেই যেনো পরাজয়ের ঘন্টা বাজতে শুরু পাকিস্তানের।

মিসবাহ উল হক আর ইউনুস খানও চেষ্টা চালিয়েছন। ব্যাটও ঘুরিয়েছন। কিন্তু অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়া আটকাবে কে? ম্যাচের শেষ ওভার পর্যন্ত ব্যাট চালিয়েছন মিসবাহ। তীরে এসেই তরী ডুবিয়ে দিলেন তিনি। ম্যাচের তখনও বাকি ৪ বল, দরকার মাত্র ৫ রান। কিন্তু আর তিনি পারলেন না। হয়তো তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই বল ভাসিয়ে দিলেন বাতাসে। শ্রীসান্তও তালু বন্দি করতে ভুল করেননি। আউট হয়ে গেলে খান। অল আউট হয়ে গেলো পাকিস্তান। হাতছাড়া হলো বিশ্বকাপ ট্রফি।

  • ইংল্যান্ড – নেদারল্যান্ডস (গ্রুপ পর্ব, ২০০৯) – নেদারল্যান্ডস ৪ উইকেটে জয়ী

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরের উদ্বোধনী ম্যাচ। খেলবে ফেভারিট ইংল্যান্ড ও আন্ডারডগ নেদারল্যান্ডস। ম্যাচ হবে ঐতিহাসিক লর্ডসে। তাতে কি আর পাত্তা পাবে ডাচরা? কিন্তু মাঠটা ঐতিহাসিক বলেই হয়তো রক্ত গরম ছিল ডাচ বাহিনীর। তাইতো বিশ্বকাপের শুরুতেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় তুলে নিলো তারা। টক্কর দিলো ইংলিশদের ১৬২ রানের পাহাড়। তাও আবার ৪ উইকেট হাতে রেখেই।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুতে ধাক্কা খায় ডাচ বাহিনী। কিন্তু টম ডে গ্রুথ আর পিটার বোরেনের ৫০ রানের জুটি জয়ের স্বপ্ন দেখায় নেদারল্যান্ডসকে। সে জয়ে আর কাটা হতে পারেনি স্টুয়ার্ট ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসনরা। শেষ ওভারে যখন জয়ের জন্য ৭ রান প্রয়োজন, তখন ব্যাট হাতে ধৈর্য্যশীলতা আর বিচক্ষণতার প্রমাণ দেয় ডাচরা। গুটিগুটি পায়ে জয় তুলে নেয় তারা। ৫ বছর পর ইংলিশদের আবারও চোখ রাঙিয়েছিল চট্রগ্রামে। মাত্র ৮৮ রানেই অলআউট করে দেয় ইংল্যান্ডকে।

  • শ্রীলঙ্কা – ভারত (সুপার আট, ২০১০) – শ্রীলঙ্কা ৫ উইকেটে জয়ী

গ্রস আইলেটে সেদিন দিনের প্রথম খেলার ভাগ্য নির্ভর করছিল দ্বিতীয় খেলার উপর। তবে প্রথম খেলায়ও জয়ের প্রয়োজন ছিল, শ্রীলঙ্কা যদি ভারতকে বড় ব্যবধানে হারাতে পারে আর অস্ট্রেলিয়ার কাছে যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারে তবেই রান রেটে এগিয়ে থেকে সেমিফাইনালের টিকেট কনফার্ম হয়ে যাবে লঙ্কানদের। জটিল সমীকরণ সহজ করতে হলে আগে ভারতকে এক ঘা দিতে হবে লায়ন্সদের৷ ১৬৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামা সাঙ্গাকারা বাহিনী ৬ রানের মাথায় হারায় জয়াবর্ধনে আর জয়াসুরিয়ার উইকেট।

দলের ভার তখন এসে পড়ে কাপ্তানের ঘাড়ে। প্রথমে দিলশানের সাথে ৪৩ এরপর অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের সাথে ৫৬ রানের জুটি গড়ে ব্যাক্তিগত ৪৬ রানে অভিষিক্ত বিনয় কুমারের বলে বোল্ড আউট হন সাঙ্গাকারা। হতাশ লঙ্কান শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কিন্তু তখনও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস আছেন৷ জয়ের সম্ভাবনা এখনও আছে। সাথে চমক দেখিয়ছেন চামারা কাপুগেদারা।

ম্যাচের শেষ মূহুর্ত। ৮ বলে প্রয়োজন ২৪ রান! বিনয় কুমার করছিলেন ১৯তম ওভার, প্রথম চার বল ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু শেষ দুই বলে দুই ছয় হাঁকিয়ে ৬ বলে ১২ রানের সমীকরণ দাঁড় করালেন চামারা কাপুগেদারা। নেহেরার প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে জয়ের ইঙ্গিত দিয়ে দিয়ছিলেন। জয়ের দুই রান বাকি থাকতেই ম্যাথিউজের রান আউট। কিন্তু কাপুগেদারকে আর কে আটকায়? শেষ বলে ছয় হাঁকিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর জয় তুলে নেন তিনি। তার হার্ড হিটিং ব্যাটিং জয় উল্লাসে মাতিয়েছিল গ্যালারি ভর্তি দর্শককে। দিনটা পুরোটাই ছিল লঙ্কানদের। দিনের অপর ম্যাচের ভাগ্যও তাদের সাথেই ছিল।

  • অস্ট্রেলিয়া – পাকিস্তান (সেমিফাইনাল, ২০১০) -অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী

সদ্য ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতা অস্ট্রেলিয়া এক মাসের মাথায় আরেকটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় পাকিস্তানের। মানষিক আর পারফরম্যান্স দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে আউসরা। কামরান আকমল আর ওমর আকমলের ঝড়ো ফিফটিতে ১৯১ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় পাকিস্তান। কিছুটা হলেও কাঁপুনি ধরেছিল অজি শিবিরে।

দরকার ছিল ভালো শুরুর। কিন্ত ১ রানের মাথায় ওয়ার্নারের উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়তে হয় অস্ট্রেলিয়াকে। রানের পাহাড় টপকাতে হলে প্রয়োজন ছিল ক্যামিও। শেন ওয়াটসন, ব্রাড হ্যাডিন, মাইকেল ক্লার্ক, ডেভিড হাসির ছোট ছোট ইনিংস কিছুটা আস্থা যুগিয়েছিল অজিদের। কিন্তু তখনও বড় কিছুর প্রয়োজন। ক্যামেরন হোয়াইটও ব্যাট চালিয়েছেন। খেলেছেন ৫ ছক্কায় ৪৩ রানের ইনিংস। শেষ ২ ওভারে জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ৩৪ রান! শেষবেলায় একাই যুদ্ধের ময়দানের মাইকেল হাসি।

হোয়াইট এর উইকেট হারানোর পর স্মিথও থিতু হতে পারেননি। তখন ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’-র ভূমিকায় মাইকেল হাসি। তিনিই এখন শেষ ভরষা। সাথে আছেন মিচেল জনসন। ১৯তম ওভারে ২ চার আর ৪ ডাবল সিঙ্গেলে ১৬ রান তুলে নিলেন হাসি। শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৮ রান। বল হাতে আজমল, স্ট্রাকাইকে জনসন। প্রথম বলে শর্ট ফাইন লেগে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন হাসিকে। টানটান উত্তেজনার ম্যাচে হতাশ করেননি হাসি।

টানা দুই ছক্কা আর পরের বলে চার মেরে স্বস্তি ফিরিয়ে আনলেন আজি শিবিরে। ম্যাচ তখন ড্র। ২ বলে প্রয়োজন ১ রান। ছাড়লেন না হাসি। পরের বলেই আবারও বাউন্ডারি লাইনের ওপারে বল পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর ১ বল বাকি থাকতেই নাটকীয় জয় তুলে নেয় অজিরা। তার দৃষ্টিনন্দন সব শট সেদিন হয়তো কিছুটা হলেও আনন্দ দিয়েছিল পাকিস্তানি ভক্তদের। তার ব্যাটিং কতোটা আক্রমনাত্মক ছিল তা স্কোর দেখেই বুঝা যায়। ২৫০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট চালিয়ে ২৪ বলে ৬০ রান করেছিলেন হাসি।

  • ওয়েস্ট ইন্ডিজ – নিউজিল্যান্ড (সুপার এইট, ২০১২): ম্যাচ টাই হয়, সুপার ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়

২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের কথা তো সবারই জানা। কেননা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ ছিল এটি। মূল খেলা টাই থাকার পর সুপার ওভারও টাই হয়। জয় পরাজয়ের হিসাব কষা হয় বাউন্ডারির সংখ্যা দিয়ে। টানা দ্বিতীয় বারের মতো ফাইনাল খেলেও বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেলো নিউজিল্যান্ডের। এই টাই-টাই খেলায় অনেকটাই যেনো অভস্ত্য হয়ে গিয়েছে কিউইরা। আর ২০১৯ বিশ্বকাপই প্রথম নয়। এর আগেও অনেক বার ম্যাচ টাই হয়েছিল ব্ল্যাক ক্যাপসদের।

২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ টাই হয় যাদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছিল সুপার ওভারে কিংবা বল আউট পদ্ধতিতে। এই ১৯ ম্যাচের সর্বোচ্চ ৭টি ম্যাচের স্বাক্ষী নিউজিল্যান্ড। যার মাত্র দুইটিতে জয় লাভ করে তারা। টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের প্রথম টাই হওয়ার ম্যাচের স্বাক্ষীও এই নিউজিল্যান্ডই। ফিরে যাই ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। সে আসরে বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে এক আসরে দুইটি টাই ম্যাচের রেকর্ড করে নিউজিল্যান্ড।

২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইট পর্বের প্রথম খেলায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি ম্যাচ টাই হয় তাদের। তার ৪ দিন পর রহস্যজনক ভাবে আবারও সেই টাইয়ের মুখোমুখি হয় কিউইরা। এই বার প্রতিপক্ষ ক্যারিবিয়ানরা। ম্যাচটিতে ১৪০ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামে নিউজিল্যান্ড। সব কিছুই গতানুগতিক ছিল। শেষ ৪ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র ২৭ রান। কিন্তু দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ক্যারিবিয়ান বোলার সুনীল নারাইনের ওখনও ২ ওভার বাকি ছিল। সব চিন্তা তখন তাকে ঘিরেই।

বল হাতেও তারই প্রমান দিলেন তিনি। ২ ওভার করে ৫ রান দিয়ে শিকার করেন ২ উইকেট। চাপে পড়ে নিউজিল্যান্ড। ম্যাচের শেষ ওভারে সমীকরণ দাঁড়ায় ৬ বলের ১৪ রানের। তখন পিচে ছিলেন ৩৫ বলে ৫১ রান করা রস টেইলর। কিউইদের ভরষা তখন তিনিই। আর ক্যারিয়ানদের ভাগ্য তখন স্যামুয়েলসের উপর। ওভারের প্রথম ৩ বলে ওয়াইডসহ আসে ৫ রান, শেষ ৩ বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন ৯ রান। স্যামুয়েলসের ১২৭ কি.মি/ঘন্টা বেগে করা ৪র্থ বলটি ফাইন লেগ অঞ্চল দিয়ে সীমানার ওপারে নিয়ে ফেলেন টেইলর।

তখন কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে কিউই শিবিরে। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে পঞ্চম বলে সিঙ্গেল নিলে। প্রান্ত বদলে শেষ বলে স্ট্রাইক পান ডগ ব্রেসওয়েল। কিন্তু শেষ বলে তিনি দ্বিতীয় বার প্রান্ত বদলের সময় রান আউটের শিকার হন। ম্যাচ টাই অবস্থায় শেষ হয় এবং সুপার ওভারের স্বীদ্ধান্ত হয়। সেখানে ১৮ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে পরাজিত হয় নিউজিল্যান্ড। সে পরাজয়ের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায় তারা।

  • ইংল্যান্ড – দক্ষিণ আফ্রিকা (সুপার টেন, ২০১৬) ২ বল হাতে রেখে ২ রানে জয় লাভ করে ইংল্যান্ড

ম্যাচটি ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানের তাড়া করে জেতা আর তখনকার সময়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ২য় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতা ম্যাচ। দক্ষিণ আফ্রিকা দেওয়া ২৩০ রানে লক্ষ্যে ব্যাট করে ম্যাচটি জয় লাভ করে ইংলিশরা। হাশিম আমলা, কুইন্টন ডি কক আর জেপি ডুমিনির অপরাজিত অর্ধশতকে ৪ উইকেটে ২২৯ রান সংগ্রহ করে প্রোটিয়ারা।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে জেসন রয়ের ১৬ বলে ৪৩, হেলসের ৭ বলে ১৭, জো রুটের ৪৪ বলে ৮৩ রানের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ২ বল আর ২ উইকেট হাতে রেখেই জয় তুলে নেয় থ্রি লায়ন্সরা।

  • ভারত – বাংলাদেশ (গ্রুপ পর্ব, ২০১৬) – ভারত ১ রানে জয় লাভ করে

আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ম্যাচ ছিল এটি। ব্যাকপুটে থেকেও জয়ের ধারায় ফিরে আসে ভারত। আর নিশ্চিত জয়কে হারে পরিণত করে বাংলাদেশ। ক্রিকেট যে অনিশ্চয়তার খেলা সেদিন কিছুটা হলেও বুঝে গিয়েছিল ক্রিকেট প্রেমিরা।

সেদিন ক্রিকেটের অন্যতম শক্তিশালী দল ভারতকে টি-টোয়েন্টিতে হারানোর খুব সহজ সুযোগ ছিল বাংলাদেশ। হারাতে পারলে এইটি হতো ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম জয়। মাশরাফি, মুস্তাফিজ আর আল আমিনদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ১৪৬ রানেই সীমাবদ্ধ থাকে ভারতের ইনিংস। ১৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ শুরুতে ধাক্কা খেলেও তামিম, সাব্বির, সাকিবের ব্যাটিংয়ে জয়ের প্রহর গুনতে থাকে বাংলাদেশ ভক্তরা।

সব ঠিকঠাকই ছিল। ম্যাচের শেষ ওভারের ১১ রানের কঠিন সমীকরণও দুই বলে দুই চার মেরের সহজ করে দেন মুশফিক। তাইতো জয়ের ২ রান দূরে থেকেও হার্দিককে চার মেরে উল্লাসে মেতে উঠেন মুশফিক। এই আবেগই যেনো কাল হয়ে দাঁড়ায়।

বড় শট খেলার বোকামিতে পরের দুই বলে দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহকে হারায় বাংলাদেশ। উড়তে থাকা বাংলাদেশকে মাটিতে নামিয়ে আনেন হার্দিক পান্ডিয়া। ম্যাচ জয় নয় ড্র করারই তখন বাংলাদেশের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিধির বাম! শেষ রক্ষাও হলো না। বাংলাদেশ ভুল করলেও ধোনি আর ভুল করেননি। স্টাম্পের পেছন থেকে ডিরেক্ট থ্রো না করে দৌঁড়ে এসে মুস্তাফিজকে রান আউট করেন তিনি। ১ রানের আক্ষেপ রেখে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ।

  • ওয়েস্ট ইন্ডিজ – ইংল্যান্ড (ফাইনাল, ২০১৬) – ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী

ইডেন গার্ডেন্সের সেই রোমাঞ্চকর ম্যাচের কথা কে না জানে? ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো শিরোপ ঘরে তোলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সে দিনের নায়ক ছিলেন কার্লোস ব্রাথওয়েট। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলে বড় বড় তারকারা। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল তার দানবীয় ব্যাটিংয়ে।

১৫৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করা ক্যারিয়ানদের সেদিন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৬৬ বলে ৮৫ রান করা মারলন স্যামুয়েলস। ১১ রানে ৩ উইকেট হারানো ক্যারিবিয়ানদের স্বপ্ন সারথি তখন তিনিই ছিলেন। ম্যাচের শেষ ওভারে যখন ১৯ রান প্রয়োজন তখনও তিনি মাঠেই ছিলেন। তার সঙ্গী কার্লোস ব্রাথওয়েট তখন চালকের আসনে, আর তিনি নিরব দর্শক৷ হয়তো নিজের ব্যাটিংয়ের চেয়েও কার্লোসের শেষ চার বলের ক্যামিওই বেশি উপভোগ করেছিলেন স্যামুয়েল।

ইংল্যান্ড অধিনায়ক শেষ ওভারে ভরসা রেখেছিলেন বেন স্টোকসের উপর। অনিয়মিত বলার বলেই সেদিন তার হিরো হওয়ার সুযোগ ছিল বেশি। ম্যাচের ভারও তখন তাদের দিকেই ছিল। প্রথম বলে যখন ছয় খেলেন তখনও স্বাভাবিক ছিল সব, কিন্তু দ্বিতীয় বলেও ছয় খেলেন। বুঝে উঠার আগেই তৃতীয় বলে আবারও ছক্কা হাঁকালেন ব্রাথওয়েট। স্কোর তখন লেভেল। কিন্তু ব্রাথওয়েট যেনো তিন ছক্কা মেরেও তৃপ্তি পেলেন না। চতুর্থ বলে আবারও ছক্কা হাঁকান তিনি।

তখনই ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো – ‘Carlos Brathwaite, remember the name!’ সত্যিই ম্যাচটি ছিল অবিশ্বাস্যকর। কার্লোসের দানবীয় ব্যাটিংয়ে কিছুটা হলেও আনন্দ দিয়েছিল ইংলিশ ভক্তদের মনে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...