৭৩ বছরের ডন আর ২৯ বছরের ভিভের দেখা হয়েছে। নভেম্বর, ১৯৮১। অ্যাডিলেড ওভালের ড্রেসিং রুম।
ডন’ই প্রথমে মুখ খুললেন। ভিভ, সবাই বলছে আমাদের নাকি একসাথে কোন ছবি নেই? এ প্রশ্ন করার আগে অবশ্য ডনকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বেশ ভিড় ঠেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ড্রেসিং রুমে ঢুকতে হয়েছে। বেশ কষ্ট করেই। তখনকার দিনে ড্রেসিং রুম অব্দি চলে যাওয়া সম্ভব এবং খুব সহজ ছিল। কোনো সিকিউরিটি নেই। যে কেউ যেতে পারে।
অবশ্য নিজের পরিচয় দিলে, ডন নিশ্চিতভাবেই, ওভালের বুকে, বেশী সুবিধে পেতে পারতেন। এখন বয়স হয়ে গেছে, সবাই আর চট করে চিনতে পারে না। তাছাড়া মিডিয়া থেকে বরাবর নিজেকে সরিয়ে রাখেন ডন। নিজেকে বরারবর’ই আন্ডারপ্লে করতে পছন্দ করেন। নিজের পরিচয় প্রকাশ করে কাউকে বিব্রত করা ডনের স্বভাবের পরিপন্থী।
শোনা যায়, ১৯৭৯ সালের ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে, ডন নিজে থেকেই ভারতীয় ড্রেসিং রুমে ঢুকতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় ড্রেসিংরুমে, ক্যাপ্টেন বেদীর নেতৃত্বে, সদ্য টেস্ট জিতে ফেরা ভারতীয় খেলোয়াড়েরা তখন আনন্দে আত্মহারা। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার বুকে তাদেরকেই ২২২ রানে গুঁড়িয়ে দেওয়া কী মুখের কথা! তাও আবার কীনা টেস্টের প্রথম দিনে ব্যাট করতে নেমে, ভারতের স্কোর ছিল জিরো ফর টু। সানি আর চেতন দুজন ওপেনার’ই গোল্লা।
সেই ম্যাচ এভাবে দুশোর বেশি রানে জিতে ফেরা। গাভাস্কারের দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি। বেদী চন্দ্রশেখর জুড়ির সারা ম্যাচে মাত্র ১৮টি উইকেট। মাত্র। অস্ট্রেলিয়াকে স্পিনমন্ত্রে পিষে দেওয়া গেছে মেলবোর্নের বুকে। সব চেয়ে বড়ো কথা, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবার টেস্ট জেতার স্বাদ। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে, কে এক বুড়ো অস্ট্রেলিয়ান দেখা করতে এসেছে শুনে, ভারতীয় খেলোয়াড়েরা যারপরনাই বিরক্ত।
সবাই প্রায় একযোগে জানান, যে এই মুহূর্ত একান্তই তাঁদের। এর মধ্যে বিদেশি কারোর না ঢোকাই ভালো। ড্রেসিং রুমের বাইরে বুড়ো অপেক্ষা করুক, পরে সময় মতো দেখা করা যাবে। বেশ কিছুক্ষণ পরে একজন ভারতীয় খেলোয়াড় (সম্ভবত, সুনীল গাভাস্কার) বাইরে থেকে ড্রেসিং রুমে ঢোকেন।
ঢুকে বাকিদের বলেন, এই যে ভায়ারা, ড্রেসিং রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম দরজার বাইরে একজন বয়স্ক মানুষ অপেক্ষা করছেন। জিজ্ঞেস করে জানলুম অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তোমরা নাকি ওকে তাই বলেছো। আচ্ছা, উনি কে জানো? ডন ব্র্যাডম্যান। তোমরা ওনাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছো? কেমন খেলতেন-টেলতেন কোনো ধারণা আছে?
আহ, শাখা গল্প ছেড়ে মূল গল্পে ফেরত আসো অনির্বাণ। ১৯৮১ সালে ভিভের সামনে বসে থাকা, ডন বলে উঠলেন, আচ্ছা এটা সত্যি নাকি ভিভ? আমাদের দুজনের একসাথে কোন ছবি নেই? দ্যাটস রাইট, স্যর। ভিভের ছোট্ট জবাব। স্যর বলতে হবে। ডন নাইটহুড প্রাপ্ত। ভিভের নাইটহুড পেতে এখনো আঠেরো বছর দেরি।
দুজনের দেখা হওয়া খুব অর্থবহ। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে দাঁড়িয়ে, ডনের ৫২ টেস্টে ৯৯.৯৪ গড়ের পরে, ডনোত্তর এবং ডনপূর্ব ক্রিকেট ইতিহাসে, বাকী সবার সামনে, লাইনের একেবারে প্রথমে, দাঁড়িয়ে আছেন ভিভ। ৪৪ টেস্টে ৬২.০১।
ডন ফের মুখ খুললেন। তোমার খেলা বেশি দেখি নি ভিভ। কিন্তু যতটুকু দেখেছি, অন সাইডে তুমি দারুণ। মাঝে মাঝে ছোট্ট ড্রাই হিউমর বাদ দিলে, ডন বরাবর’ই স্পষ্ট কাটাকাটা কথা বলতে ভালোবাসেন। তাই ভিভকে বলেই ফেললেন, না হে, সত্যি বলতে, কম দিন তো খেলা দেখছি না। তোমার মত এত ভালো অন সাইড নিয়ে আর কাউকে মাঠে দেখেছি বলে মনে পরে না।
হঠাৎ ডনের নজরে পড়লো, চেয়ারে রাখা আছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেরুন রঙের রঙে রাঙানো একটা আজব জিনিস। হেলমেট। রাস্তায় নয়, পিচে পরার জন্যে। সামনে আবার স্বচ্ছ ভাইসর লাগানো। ডন খুব সাবধানে মেরুন হেলমেট’টা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করলেন। খুব সন্তর্পণে, যেনো মহামূল্যবান ভঙ্গুর কোনো রাজমুকুট। সাথে মুখ চলছে। ভিভ, আসলে আমি কখনো এতো কাছ থেকে দেখি নি ভাইসর লাগানো হেলমেট।
আলতো হাত বুলিয়ে টেক্সচার আর ওজন বোঝার চেষ্টা করছেন ডন। করতে করতেই ভিভের দিকে তাকিয়ে বলে ফেললেন, আসলে আমাদের সময় এসব ছিলো না তো। সারা জীবন নিক্তিতে মেপে চলা, বৃদ্ধ মানুষটি এবার এক অদ্ভুত স্বভাববিরোধী কাজ করলেন। কারোর তোয়াক্কা না করে, হেলমেট’টা সটান দুহাতে তুলে নিয়ে, মাথায় গলিয়ে দিলেন। অভ্যেস নেই। ফলে যা হবার তাই হলো। ৭৩ বছরের বৃদ্ধের চশমা, হেলমেটের ধাক্কায়, নাক বেয়ে বেশ খানিকটা নেমে এলো।
পাশে বসে থাকা কলিন ক্রাফট আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। কিট ব্যাগ থেকে ঝটপট ক্যামেরা বার করে হেলমেট পরা ডনের ছবি তুলে ফেললেন। এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? ডন হেলমেট পরার অনুমতি নেন নি, কলিন ক্রাফট’ও ছবি তোলার অনুমতি নিলেন না। হেলমেট খুলে রেখে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত ডন এবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। বেরোবেন।
হেলমেট পরার মিনি দুর্ঘটনায় মুখে সামান্য বিব্রত ভাব। টাইটা আরেকবার টেনে ঠিক করে, পা বাড়িয়ে বেরোতে যাবেন হঠাৎ কী যেন মনে হলো। স্মিত হাস্যে, ভিভের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ভিভ – হেলমেট পরে ব্যাট করতে কেমন লাগে?
আমিও কোনদিন পরি নি, স্যর। ২৯ বছরের যুবা, দুধসাদা দাঁতের সারি মেলে, হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন। ডন সামান্য মাথা নেড়ে, যেন প্রশ্নের উত্তর বেশ পছন্দ হয়েছে, মুখে এরকম একটা ভাব ফুটিয়ে, অবশেষে ড্রেসিং রুমের দরজার দিকে হাঁটা লাগালেন।