নন স্ট্রাইক এন্ডে দাঁড়ানো ঋদ্ধিমান সাহা বোধহয় গোগ্রাসে মুখস্থ করছিল এক একটা কভার ড্রাইভ। ব্যাগি গ্রিন পরা মাইকেল ক্লার্কের টুপিসহ সানগ্লাসটা মাঝে মাঝেই নিচে নেমে আসছে। বাংলা ভাষায় ওগুলো নাকি হতাশার লক্ষণ। পপিং ক্রিজ বরাবর এগিয়ে এলো নাথান লায়নের লেগ স্টাম্প বরাবর একটা হালকা শর্ট টপ স্পিন।
একজন কলার তোলা সাদা জার্সি পরে পা দুটো স্ট্রেচ করে মিড অন বরাবর যেই পাঠিয়ে দিলেন, বাউন্ডারি বরাবর সটান গিয়ে পড়ল মিশেল মার্শের হাতে। আউট। ব্যাটধারী মুষড়ে পড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন ক্রিজে। মনের মধ্যে অগোচরে কিছু চিন্তাভাবনা। হয়তো পুলটা না মারলেই হতো। আর তো কিছু রান বাকি ছিল। তাহলেই তো হতো ইতিহাস!
কিন্তু ক্রিকেট উইলোদেরকে তো বরাবর একটা সুযোগই দিয়ে এসেছে। ক্রিজে দাঁড়িয়ে হাঁটুটা আধমোড়া করে মাথাটা নিচে নামিয়ে থাকা মানুষটা আস্তে আস্তে ক্রিজটা ত্যাগ করেছিল সেদিন। জয়ের কাছে এসেও সেদিন জিততে পারেনি ভারত। অ্যাডিলেডের সাগরপেরোনোর ‘৪৮’ নটিক্যাল মাইল আগেই থেমে যায় শান্তিভূমির দেশ।
মহাজাগতিক শূন্যে অর্ধভাসমান একটা জাতি, যে জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহুকাল ধরে মিশে আছে অনুনয়-বিনয়ের ধর্ম, তাকে দ্বিতীয়বার ঝুঁকি নিয়ে সেই মহাজাগতিক আকাশে ‘বিরাট’ হবার স্বপ্ন বুনেছিল সাদা জার্সির এক স্পর্ধাপ্রেমিক।
চতুর্থ ইনিংস নামক নাটকে, যেখানে মুহুর্তে দিশেহারা হয় ব্যাটিং উপজাতি, সেই নাটকে বহির্বিশ্বের তিনশো তেষট্টিটা রান তাড়া করার ঝুঁকি নেবার জন্য একটা চিবুকের দরকার ছিল, আর কলার তোলা সেই চিবুকের নাম,জনসনকে ফ্লাইং কিসে পরপর ফেন্সে ঠিকানা ধরানো এক র্যোমান্টিক বীরের নাম ‘বিরাট’- বিরাট কোহলি।
সদ্য ০-৮ হারের লজ্জা স্থাপন করা একটা লাঠি যখন হাঁটতে ভুলে গিয়েছিল,মহেন্দ্র সিং ধোনির অবর্তমানে কেউ একজন শিখিয়ে এসেছিল স্লেজিং এর বদলে স্লেজিং, মারের বদলে মার, চ্যালেঞ্জের বদলে চ্যালেঞ্জ। আর তাই সেই দেশ ৩৬৩-এর বিশাল টার্গেটে ড্রয়ের শ্বেতবস্ত্র না পরিধান করে পরেছিল চ্যালেঞ্জ আর ঝুঁকির রঙচঙে পোশাক, যে পোশাকে রক্ত লাগে, ধুলো লাগে, কাদা লাগে।
রক্ত, ধুলো, কাদা – এগুলো বোধহয় লড়াইয়েরই প্রতীক। জয়-হারের তারামণ্ডলের পরোয়া না করে নিজেকে বিছিয়ে দাও স্পর্ধার মহাকাশে। ছোটো ছোটো হার জয়ে ডুবে থাকা মানুষ অনেকদিন স্পর্ধার ঝুঁকি নিতে শেখেনি আর তখন এক দিল্লীবাসী কলার তুলে ধরতে শেখায়। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারত হয়তো সিরিজ জিতেছিল ২০১৮ সালে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে এখনও লেগে আছে ২০১৪ এর বিরাট কোহলির মহাজাগতিক আকাশমেলা ৬৯৩ রানের সিরিজ।শান্তিভূমির দেশ অনেক অনেকদিন পর হার জিতের তোয়াক্কা না করে চোখে চোখ রেখে উঁচিয়ে ধরেছিল এক ‘লাঠি’ – সে লাঠি চিরন্তন বিপ্লব আর উঁচানো চিবুকের চিরকালীন প্রতীক।দিল্লীর রাজপুত্রের ব্যাটটাই শুধু সোজা ছিল না, ছিল একটা সোজা চিবুক, যে চিবুকে দেওয়ালের মতো ফিরে আসে স্লেজিংগুলো আর আছড়ে পড়ে ফেন্স পার হওয়া পাপড়ির মতো।
রানসংখ্যা তো অনেক আছে,তবুও হিমশীতলতার সাথে কেউ যে এমন স্লেজিংকে পেট্রোল করে বহ্নির ব্যাপ্তি ছড়াতে পারে তা বিরাট ছাড়া আর সম্ভব নয়। হ্যাঁ, অনেকে তাঁর টেম্পার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, স্লেজিং এর জবাবে চার-ছয় মারতে গিয়ে যে একবারও ভুল শট খেলে না, অন্তত তাঁর ব্যাটিং মননের বিশেষণ ‘হিমশীতল’ই। আর আপনারা যাকে আগুন বলেন, সেটা আসে ভিতর থেকে। উইলো কাঠ আর চামড়া জড়ানো মাথায় বোধহয় বরফটাই থাকে।
বিরাট কোহলি মানে শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড ভাঙতে যাওয়া কোনো পূজনীয় মূর্তি নয়, বিরাট কোহলি মানে আমাদের মনের ভিতর প্রবলভাবে কাঙ্খিত কতকগুলো স্পর্ধাফুলকির সমষ্টি যেগুলো আমরা চাইলেও করতে পারিনা, কিন্তু কেউ একজন সেই বিপ্লবী মননের অবয়ব হয়ে বারেবারে করে আসে সেগুলো লর্ডস থেকে অ্যাডিলেড। রানসংখ্যা তো কেউ আসবে, কেউ ভেঙে যাবে।
কিন্তু অক্ষত থাকবে চিবুকের জোরটা যেটা ওয়াহাব রিয়াজ-মোহাম্মদ আমিরকে বাউন্ডারির হ্যাটট্রিক ধরাতে পারে,ত্রি দেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তিনশোর বেশি টার্গেট চল্লিশ ওভারের আগেই ছুঁতে পারে, জনসনের স্লেজিংকে ফ্লাইং কিস দিয়ে ফেন্সের ঠিকানা ধরাতে পারে আর পারে স্যুইংয়ের বাতাস কিংবা সবুজাভ বিষাক্ত পিচে সব্যসাচী হয়ে তলোয়ার চালাতে। যে পিচে সবাই ব্যর্থ, সে পিচে কলার তোলে একজনই।
নেভিল কার্ডাস যথার্থই বলেছিলেন – ‘স্কোরবোর্ড একটা গাধা’। তাই তো ‘বিরাট’ শুনলেই, রানের পাহাড় সরিয়ে মনের অবয়বে গঠিত হয় চাপদাঁড়িওলা একটা প্রতীকি, চিবুকটা সোজা, আর স্পর্ধার কলারটা তোলা। সেই অবয়বে থাকেনা কোনো দশ হাজার রানের উপমিত রূপকথা, থাকে একটা শক্ত চোয়ালের বাস্তবিক প্রবন্ধ।
চোকার নামক ট্রলে জর্জরিত সোনাহীন একটা হৃদয়ের বারেবারে লৌহমানব হয়ে বাইশ গজে একা দাঁড়িয়ে থাকা শিরদাঁড়ার নাম বিরাট কোহলি। শিরদাঁড়া সোনার হয় না, লোহার হয়। রক্ষণশীলতার কূপমণ্ডুকতাকে সরিয়ে তারাদের পিছনে পাখা মেলে উড়ে যায় একটা মহাজাগতিক আকাশ, একটা ‘বিরাট’ আকাশ। সেই আকাশের সোনার দরকার নেই, ট্রফির দরকার নেই।
রেকর্ড ভাঙবে-গড়বে। ধ্রুবক থাকবে শুধু চিবুক আর শিরদাঁড়াটা।