যেমন খেলায়, তেমন ব্যবসায়

রজার ফেদেরারকে ভালবেসে তার ভক্তরা ’ফেড এক্সপ্রেস’ নামে ডেকে থাকেন। কোর্টে অনেকটাই অদম্য এই টেনিস কিংবদন্তি এখনো খেলে যাচ্ছেন। তবে বর্তমানে ইনজুরির কারণে কোর্টের বাইরে থাকলেও মাঝে মধ্যেই সংবাদের শিরোনাম হয়ে যান।

এবার যেমন কোর্টের বিষয় নিয়ে নয়, বাইরের বিষয় নিয়ে আবার খবর প্রকাশিত হয়েছে ফেদেরারকে নিয়ে। এবার ব্যবসায়ী হিসেবে দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। আর সেটি তুলে এনেছেন জো পনপ্লিয়ানো। ফেদেরারের ব্যবসায়িক বিচক্ষণতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে আবারো আলোচনায় উঠে এসেছেন খেলার দুনিয়ার ব্যবসা ও আর্থিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করা এই ওয়েবসাইট।

মূলত খেলা নিয়ে সময় পার করা এই মাধ্যমটি প্রতিদিন খেলার দুনিয়ার কোনো না কোনো চমকপ্রদ আর্থিক গল্প তুলে ধরেন তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে। এবার সেখানেই রজার ফেদেরারের আর্থিক বিচক্ষণতার বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। কিভাবে বার্ষিক ১ কোটি ডলার আয়ের চুক্তি করতে না পারা ফেদেরার ৬০ কোটি ডলারের নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা করলেন, সেই দুর্দান্ত গল্পটাই তুলে আনা হয়েছে এবার।

তিন বছর আগে ২০১৮ সালে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল ফেদেরারকে। বিশ্বের অন্যতম ক্রীড়াসামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নাইকির সঙ্গে ২০ বছরের বেশি চুক্তি ছিল তার। কিন্তু ২০১৮ সালে যখন স্পনসরশিপের চুক্তিটাকে নবায়ন করতে গেলেন, তখন বাধলো ঝামেলা।

ব্যাপারটা তখন থেকেই একটু জটিল হতে শুরু করলো। স্পনসরশিপের দুনিয়ায় অলিখিত একটি নিয়ম রয়েছে, খেলোয়াড়দের পৃষ্ঠপোষকতার পেছনে কখনো আয়ের ১০ শতাংশের বেশি খরচ করা যাবে না, তাহলে ঝুকি থাকে। যদিও ‘চতুর’ নাইকি নিজেদের সে সীমা অতিক্রম করেনি। তখনি ৩৬ বছর বয়সী ফেদেরারের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দিল নাইকি, কারণ কোর্টের খেলায় এখন আর আগের মতো সফল নন তিনি।

ফলাফল কি হলো, ফেদেরার সবাইকে চমকে দিয়ে পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইউনিক্লোর সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করলেন। ১০ বছরের জন্য ৩০ কোটি ডলারের চুক্তি। নাইকি বছরে যে এক কোটি ডলার দিত, আর এখানে তার তিন গুণ! কিন্তু গল্পের বাকি যে এখনো অনেকটা রয়েছে।

ইউনিকলোর সঙ্গে চুক্তিতে আবার বিশেষ দুটি শর্ত ছিল। এক নাম্বারে, এখানে কোনো অবসরের শর্ত ছিল না। মানে অবসর নিয়ে ফেললেও সমস্যা নেই, বয়সসীমা ৪৬ বছর পর্যন্ত বছরে ৩ কোটি ডলার পাবেন ফেদেরার। আর দুই নাম্বারে ছিল, চুক্তি শুধু কাপড়ের জন্য ছিল, তাতে জুতার কোনো উল্লেখ করা ছিল না। জুতার কোনো স্পনসর না থাকার কারণে ফেদেরার নাইকিই পরতেন।

কিন্তু এরপর একদিন অনুশীলনে ‘অন রানিং’ ব্র্যান্ডের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় তার। ফেদেরার একটা বড় বাজি ধরার অকল্পনীয় সিদ্বান্ত নিয়ে নেন। নিজের দেশ সুইজারল্যান্ডের এই ব্র্যান্ডের শুধু শুভেচ্ছাদূতই হলেন না, এর মালিকানারও কিছুটা কিনে নিয়ে নিলেন। সবকিছু মিলিয়ে এই ব্র্যান্ডের ৩ শতাংশের মালিক বনে গেলেন রজার ফেদেরার। এর ঠিক দুই বছর পরই এই ব্র্যান্ড শেয়ার মার্কেটে চলে আসার পর বর্তমানে এই ব্র্যান্ডের বাজারমূল্য এক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি।

এর মানে দাড়াল, এই কোম্পানিতে ফেদেরারের যে অংশীদারিত্ব, তার মূল্য এখন ৩০ কোটি ডলারেরও বেশি! অর্থাৎ ২০১৮ সালে নাইকির সঙ্গে ফেদেরারের চুক্তি ছিল বছরে মাত্র ১ কোটি ডলারের। সেখানে প্রত্যাশামতো চুক্তি না হওয়ায় ফেদেরার এমন দুটি সিদ্ধান্ত নিলেন, যার বর্তমান মূল্য ৬০ কোটি ডলারেরও বেশি হয়ে গেছে। বাংলাদেশি মূল্যমানে হিসাব করলে যা দাড়ায় ৫ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এই কাজটি করার মাধ্যমে খেলোয়াড়ি দুনিয়ায় অনন্য এক ব্র্যান্ড সৃষ্টি করেছেন ফেদেরার। গত বছর মাত্র একটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম টুর্নামেন্ট খেলেছেন ফেদেরার, তবু এই বছরে ৯ কোটি ডলার আয় করেছেন তিনি।

অনেকের কাছে যা স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু ফেদেরার যা করে দেখালেন সেটি বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই, ভবিষ্যতের জন্যও একটা শিক্ষা হয়ে থাকবে। আয়ের দিক মিলিয়ে পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে সব ধরনের খেলা মিলেই ফেদেরারের চেয়ে বেশি আয় করেছেন মাত্র ছয়জন। আশ্চয্যের বিষয় হচ্ছে, এই ৯ কোটি ডলারের মাত্র ৩ লাখ ডলার হচ্ছে টেনিস থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে।

খেলার পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র ছয়জন খেলোয়াড় ক্যারিয়ারে ১০০ কোটি ডলার আয় করেছেন। টেনিস থেকে সে কাজ প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে করেছেন রজার ফেদেরার। অথচ ২০১৮ সালের পর থেকেই কোনো গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের রেকর্ড নেই তার। লড়াই করছেন নানা রকম ইনজুরির সঙ্গে। ইনজুরিতে পড়ার কারণে গত ২ বছর সব কটি গ্র্যান্ডস্ল্যামও খেলা হয়নি তার। কিন্তু আয়ে এর কোনো প্রভাবই যে পড়েনি! কীভাবে পড়বে, আয় তো কমছেনা। যার সিংহভাগই মাঠের বাইরে থেকে প্রাপ্ত।

ফেদেরারের প্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাইকির সঙ্গে সেরেনা উইলিয়ামস থেকে শুরু করে রাফায়েল নাদাল, মারিয়া শারাপোভা ও নিক কিরিয়সের মতো পরিচিত সব নামই চুক্তিবদ্ধ রয়েছেন। তার এমন আর্থিক দূরদর্শিতা অবশ্য মানুষের উপকারে লাগছে বেশ। শুধু আফ্রিকাতে ৮০টির বেশি স্কুল খুলতে এরই মধ্যে দেড় কোটি ডলারের বেশি খরচ করেছেন তিনি। করোনার সময়টায় ৬৪ হাজার আফ্রিকান শিশু যেন ক্ষুধার্ত না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে ১০ লাখ ডলারও ব্যয় করেছেন ফেদেরার।

তার যা আয় তাতে ৪০ বছর বয়সী একজন খেলোয়াড় বিবেচনায় মন্দ নয়! খেলোয়াড় দুনিয়ায় অনন্য এক ব্র্যান্ড সৃষ্টি করে ইতিহাস গড়েছেন ফেদেরার। হয়তো ভবিষ্যতে আরও কিছু দেখার কিংবা পাওয়ার অপেক্ষা করতে হবে। সেটি অবশ্য ফেদেরারের ভাবনার মধ্যে নয়, যা হবে সময়ের প্রয়োজনেই করবেন তিনি, এর বাইরে কিছু নয়। তবে এবার যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে সেটি অনুকরণীয় হয়ে থাকবে অনেকের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link