১৯৭০ সালটা ব্রাজিল ফুটবলের জন্য ছিল অন্যতম স্মরনীয় সময়। বলা যায়, রীতিমত বৈপ্লবিক সময়ই। পেলে, জর্জিনহো, কার্লোস আলবার্তোরা তখন ব্রাজিলের হয়ে বিশ্ব ফুটবলে একক আধিপত্য সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন বিশ্বকাপের ফাইনালে জয়ী হয় ব্রাজিল। আর সেই বিশ্ব জয়ের দিনেই সাও পাওলোতে জন্ম হয় আরেক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির; তিনি মার্কোস ইভানজেলিস্তা ডি মোরাইস কাফু।
অন্য অনেক ব্রাজিলিয়ান শিশুর মতোই কাফুর বেড়ে ওঠা দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায়। কথায় আছে, ব্রাজিলের রাস্তাতেও নাকি অনেক নামি ফুটবল একাডেমির চেয়েও ভাল খেলোয়াড় তৈরি করে! আর সেই রাস্তাতে ফুটবল খেলা শুরু হয় কাফুর। এরপর মাত্র আট বছর বয়সে স্থানীয় যুব একাডেমিতে যোগ দেন।
আশির দশকের শুরুর দিকে ফ্লুমিনেন্স, ফ্রিগুয়েরেন্স, বাহিয়া, পালমেইরাসের মত ক্লাবগুলোতে ট্রায়াল দেন তিনি। তবে ভাগ্যের খাতা খোলেনি, কোন ক্লাবই ভর্তি করা হয়নি তাকে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে দলে ভেড়ায় ব্রাজিলেরই আরেকটি ক্লাব সাও পাওলো। ক্লাবটির যুব একাডেমিতে কাফু বেড়ে উঠেছিলেন একজন মিডফিল্ডার হিসেবে।
তবে মাঝমাঠে খুব একটা অসাধারণ খেলা খেলতে পারতেন না তিনি কিন্তু কাফুর জীবনে ব্রেক থ্রু নিয়ে আসেন বিখ্যাত কোচ টেলে সান্তানা। সান্তানা তাঁকে মাঝমাঠ থেকে নিয়ে আসেন রাইটব্যাক পজিশনে। এরপর কাফু বা সাও পাওলো, কাউকেই পেছনে তাকাতে হয়নি।
১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে টানা দুবার লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের আসর কোপা লিবার্তাদোরেস জিতে নেয় সাও পাওলো। এমন জয়ে কাফু একেবারে সামনে থেকে অবদান রেখেছিলেন। বিশেষ করে ১৯৯৩ এর ফাইনালে নিজে একটি গোল করেছিলেন এবং বাকি তিনটি গোলেও সরাসরি কাফুর অংশগ্রহন ছিল।
এসময় লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন কাফু। একজন ডিফেন্ডারকে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার জেতাটা ছিল আশ্চর্যেরই বটে কারণ লাতিন আমেরিকায় তখন শুধু আক্রমণকেই খেলার মূল আলোচ্য হিসেবে ধরা হত।
এমন অবিশ্বাস্য প্রতিভা চোখ এড়ায়নি ইউরোপীয় ক্লাব সমূহের। স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল জারাগোজায় যোগ দেন কাফু। কিন্তু জারাগোজায় এসে আচমকা নিজেকে হারিয়ে বসেন তিনি। হতাশাজনকভাবেই শেষ করেন নিজের অভিষেক মৌসুম। বাধ্য হয়েই ফিরতে হয় ব্রাজিলে। এবার গন্তব্য পালমেইরাস, পালমেইরাসের হয়ে আবারও ট্র্যাকে ফিরে আসেন কাফু। দলটির হয়ে ব্রাজিলিয়ান কাপ ও প্রাদেশিক পাউলিস্তা কাপ জিতে নেন তিনি।
আবার ডাক আসে ইউরোপ থেকে। এবার ইতালিয়ান জায়ান্ট রোমার হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন কাফু। ততদিনে একটা সমালোচনা শুরু হয়েছিল যে ব্রাজিলিয়ান কাফু হয়তো ইউরোপে খেলার যোগ্য নন। কিন্তু রোমায় হয়ে খেলতে নেমে মাঠেই জবাব দিতে থাকেন কাফু, রোমার তৎকালীন কোচ জিম্যানের অধীনে নিজেকে আরও জ্বালিয়ে তোলেন তিনি। কাফুর আগমনের আগে দীর্ঘ ১৮ বছর লিগ শিরোপা জিততে পারেনি রোমা। সেই দলটিই এরপর ২০০১ সালে জিতে নেয় ইতালিয়ান সিরি আঁ। পারফরম্যান্স দিয়ে কাফু হয়ে ওঠেন রোমার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
চিরাচরিত লাতিন রাইটব্যাকদের মতই কাফু ছিলেন প্রচণ্ড গতিশীল ও দক্ষ খেলোয়াড়। খুব সংকীর্ণ জায়গা থেকে মাপা ক্রস দিতে পারতেন। উপরে উঠে যেমন আক্রমণে অংশ নিতেন আবার নিচে নেমে ডিফেন্স সামলাতেন খুবই দ্রুত। অন্যদিকে, তাঁর ফিটনেসও ছিল ইউরোপিয়ানদের মতই। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে পারতেন এক ছন্দে। সব মিলিয়ে রোমাতে কাফু পরিণত হন দলের এক স্তম্ভে।
২০০৩ সালে ইতালি’র আরেকটি ক্লাব এসি মিলানে যোগ দেন ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাক। মূলত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার জন্যই তিনি রোমা ছেড়েছিলেন। মিলানে তখন ছিলেন মালদিনি, ইনজাঘির মত লিজেন্ড। ২০০৪ সালে মিলানের হয়ে আবার ইতালিয়ান লিগ জেতেন।
২০০৫ এ বাঘা বাঘা ইউরোপিয়ান দলগুলোকে হারিয়ে মিলান উঠে যায় ফাইনালে। কিন্তু ২০০৫ এর সেই ঐতিহাসিক ফাইনালে প্রথমার্ধে ৩-০ তে এগিয়ে থেকেও লিভারপুলের দুর্দান্ত এক কামব্যাকের কাছে হেরে যায় মিলান। সেবার ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের খুব কাছ থেকেই ফিরতে হয়েছিল কাফু’কে।
কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার স্বপ্ন পুনরায় মিলানের ২০০৭ এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে নিয়ে আসে। এবারও মিলানের সাথে দেখা হয় সেই লিভারপুলের। এবার আর হতাশ হতে হয়নি ইতালিয়ান জায়ান্টদের। কাকা ও ইনজাঘির নৈপুণ্যে মিলান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে নেয়। নিজের মিলান অধ্যায়ে একেবারে সামনে থেকেই পারফর্ম করেছিলেন কাফু।
অবশ্য ক্লাব ক্যারিয়ারের চেয়ে ব্রাজিলের জার্সিতেই বেশি উজ্জ্বল এই কিংবদন্তি রাইটব্যাক। শুরুটা হয় ১৯৯৪ সালে। সে বছরের বিশ্বকাপ দলে কাফু ডাক পেলেও দলের প্রথম পছন্দের রাইটব্যাক ছিলেন না। তবে ইতালির বিপক্ষে ফাইনালে মাত্র ২১ মিনিটের সময় নিয়মিত রাইটব্যাক জর্জিনহো ইনজুরিতে পড়লেও মাঠে নামতে হয় কাফুকে। এরপর থেকে ম্যাচের শেষ পর্যন্ত মোট ১০০ মিনিট সামলেছেন ইতালির ব্যাজ্জিও, বারেসিদের নিয়ে গড়া আক্রমণভাগ। ব্রাজিলও ২৪ বছরের খরা কাটিয়ে জিতে নেয় শিরোপাটি।
পরের বিশ্বকাপে অবশ্য কাফু ছিলেন দলের প্রথম পছন্দের রাইটব্যাক। কিন্তু যে রোনালদোর কাঁধে চড়ে ফাইনালে এসেছিল ব্রাজিল তিনিই ফাইনালের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ রোনালদোর অফফর্ম আর ফ্রান্সের জিনেদিন জিদানের অতি মানবীয় পারফরম্যান্সে সেবার মাথা নিচু করেই ফিরতে হয়েছিল কাফুদের।
তবে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় ২০০২ সালে। বিশ্বকাপের আগে অধিনায়ক এমারসন ইনজুরিতে পড়েন আর্মব্যান্ড আসে কাফুর হাতে। সেই বিশ্বকাপে বিশ্ব দেখে এক অদম্য ব্রাজিলকে। জার্মানিকে হারিয়ে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের যে আইকনিক ছবিটি আছে, সেটির কেন্দ্রেই আছেন মাঠ এবং মাঠের বাইরের নেতা কাফু।
কাফু সাও পাওলোর হয়ে টানা দুবার লাতিন শ্রেষ্ঠত্ব, রোমার হয়ে ১৮ বছর পর ঘরোয়া লিগ, মিলানের হয়ে লিগ, কাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ব্রাজিলের হয়ে দুবার বিশ্বকাপ, দুবার কোপা আমেরিকা ও একবার কনফেডারেশন কাপ জিতেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে। অপূর্ণতা ছিল না তার। সাও পাওলো, রোমা, মিলান ও ব্রাজিলের হল অব ফেমেও জায়গা করে নিয়েছেন এই কিংবদন্তি। ব্রাজিলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তাঁর।
যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেন ফুটবলই বেছে নিয়েছেন কাফু, তখন খুব সহজে উত্তর দিয়েছিলেন, তার জন্মটা ১৯৭০-এ তাই। ‘১৯৭০ সাল’ ব্রাজিলকে একটা বিশ্বকাপ দিয়েছে, আর দিয়েছে একজন ফুটবলার যিনি নিজের প্রতিভা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে বদলে দিয়েছেন ফুলব্যাকের সংজ্ঞা। বিশ্বের সর্বকালের সেরা রাইটব্যাকদের ইতিহাসের পাতায় নিশ্চিতভাবেই উপরের দিকে রাখতে হবে এই সেলেসাও কিংবদন্তিকে।