আমি অনেকটা পথ হেঁটেছি পৃথিবীর পথে

স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় ইয়ন মরগ্যানের ইংল্যান্ড যখন পৌঁছাল, তখন তারা বিশ্বের সেরা একদিনের আন্তর্জাতিক দল। সামনে দ্বিতীয় সেরা দল ভারতের বিপক্ষে সিরিজ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পরের বছর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। তাই প্রতিবেশীদের বিপক্ষে নিয়মিত মুখ বেন স্টোকস, জস বাটলার, ক্রিস ওকসদের বিশ্রাম দিলো ইংল্যান্ড।

মুখে যতোই বলুন না কেন, ইয়ন মরগ্যানরা স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাকে নিয়েছিলেন হালকাভাবেই। কিন্তু স্কটিশদের মর্যাদার লড়াইয়ে একচুলও ছাড় দিলো না স্বাগতিকরা। প্রথমে ব্যাট করে স্কটল্যান্ড করে ৩৭১। ইংল্যান্ডের বিধ্বংসী ব্যাটিং সত্ত্বেও ছয় রানে ম্যাচ জিতে নেয় স্কটল্যান্ড। ম্যাচের নায়ক ৯৬ বলে অপরাজিত ১৪০ রান করা ক্যালাম ম্যাকলিওড।

ম্যাকলিওড ক্রিকেটপ্রেমীদের নজরে আসেন মূলত এই ইনিংস দিয়েই। সেবছর আইসিসির সহযোগী সদস্যদের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন তিনি। ক্যারিয়ারের আট সেঞ্চুরির তিনটিতেই পেরিয়েছেন দেড়শো রান।

কিন্তু স্কটল্যান্ড দলের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ ম্যাকলিওড ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন পুরোদস্তুর ফাস্ট বোলার হিসেবে। আন্তর্জাতিক অভিষেকে তিনি ব্যাটিং করেছিলেন ১১ নম্বরে। নবম উইকেটের পতনের পর নিজের পুরোনো প্লাস্টিক হেলমেটটা পরতে গিয়ে দেখলেন এর খানিকটা ভেঙে গেছে। ভাঙা হেলমেট পরে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান ম্যাকলিওডকে সেদিন মোকাবেলা করতে হয়েছিলো অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফকে। বেচারা ম্যাকলিওড লজ্জায় ভাঙা হেলমেটের কথা কাউকে বলতেও পারেননি।

আপনি খুব কম সংখ্যক ক্রিকেটারকেই পাবেন যিনি বিশ্বকাপে নিজ দলের হয়ে ব্যাটিং ও বোলিং উভয়টাই উদ্বোধন করেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ব্যাটিংটা একদমই আয়ত্ত করতে পারেননি, ফলাফল- স্কটল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি ‘হাঁসের’ মালিক ম্যাকলিওড।

গ্লেন ম্যাকগ্রা-ড্যারেন গফদের আদর্শ মেনে বেড়ে ওঠা ম্যাকলিওড ফাস্ট বোলার হিসেবে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে খেলার সময় কাজ করার সুযোগ পান অ্যালান ডোনাল্ডের সাথে। কিন্তু ২০১০ সালের ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের সময় অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের দায়ে নিষিদ্ধ হন ম্যাকলিওড। ব্যাটিংটা আক্ষরিক অর্থেই ছিলো বাজে, এখন বোলিংটাও প্রশ্নবিদ্ধ। ওয়ারউইকশায়ার যখন তাকে ছেড়ে দেয়, তখন ক্যালাম ম্যাকলিওড না বোলার, না ব্যাটসম্যান!

এরপরের লড়াইটা ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান থেকে স্কটল্যান্ডের পক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান হওয়ার। পরের চার বছরে নিজেকে পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। পেছন ফিরে তাকিয়ে ম্যাকলিওড এই সময়টুকুকে বলেন, ‘The best thing that ever happened to me.’

২০১৫ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের আগে স্কটল্যান্ডের সহকারী কোচ হিসেবে আসেন পল কলিংউড। কলিংউড তাকে ডারহাম কাউন্টির মাসব্যাপী ট্রায়ালে অংশ নিতে বলেন। সেখানে অনবদ্য ব্যাটিং করে জায়গা করে নেন ডারহামের মূল দলে। সেবছরের রয়্যাল লন্ডন কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ডারহাম, যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো ম্যাকলিওডের।

ম্যাকলিওডের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিলো আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২০১৯ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। আফগানিস্তানের বিপক্ষে স্পিনিং উইকেটে ২৫৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২১ রানের দুই উইকেট হারায় স্কটল্যান্ড।

চার নম্বরে নেমে ম্যাকলিওড গড়লেন ইতিহাস। ১৪৬ বলে অপরাজিত ১৫৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান তিনি। সময়ের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার রশিদ খানকে ক্রমাগত সুইপ শট খেলে ভড়কে দিয়েছিলেন, ম্যাচে ৯ ওভারে ৬৮ রান খরচায় কেবল একটি উইকেটই পেয়েছিলেন তিনি।

ফিরে আসি সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটায়। বিশ্বের সেরা দলকে হারানোর পরও সেবছর আর কোনো একদিনের ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি স্কটল্যান্ডের, খেলা হয়নি বিশ্বকাপও। সেই ম্যাচের পর মাত্র দশটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে স্কটল্যান্ড, জিতেছে চারটি। ১০ ম্যাচের কেবল দুইটি ছিলো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে (শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান)। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রায় জিতেই গিয়েছিলো স্কটল্যান্ড, শেষমেশ হার মেনে নেয় ২ রানে।

৩২ বছর বয়সী ম্যাকলিওডের স্বপ্ন স্কটল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলা। সে স্বপ্ন আপাতত বেশ দূরের পথ বলেই মনে হয়। তবে অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের দায়ে নিষিদ্ধ হওয়া থেকে স্কটল্যান্ডের ব্যাটিং ভরসা হয়ে ওঠা- ক্যালাম ম্যাকলিওড হ্যাজ কাম আ লং ওয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link