শ্রীলঙ্কার ষষ্ঠ নাকি পাকিস্তানে তৃতীয় শিরোপা? এই মুহূর্তে এমনই এক ইতিহাসের সামনে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। মহাদেশীয় বিবেচনায় অবশ্য এশিয়ার সমর্থরাই এ ম্যাচ দেখার জন্য বেশি মুখিয়ে আছে। এশিয়া কাপের এ মহারণের অন্তিম লগ্নে কে জয়ী হচ্ছে, তা জানতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা। বাবর আজম আর দাসুন শানাকা, অধিনায়ক হিসেবে এ দুই অধিনায়কই নিজেদের প্রথম শিরোপা জেতার একদম দোরগোড়ায়।
শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তান- ফাইনালে ওঠা এ দুই দলেরই এবারের এশিয়া কাপ যাত্রা শুরু হয়েছিল হার দিয়ে। শ্রীলঙ্কা তো রীতিমত প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই লঙ্কানরাই আবার পরবর্তীতে ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসে। টানা ৪ ম্যাচ জিতে ফাইনাল আর সেই ফাইনাল খেলার পথে সুপার ফোরে তাঁরা ছিল একদম অপরাজেয়।
আর ভারতের কাছে প্রথম রাউন্ডে হারার পর পাকিস্তান সুপার ফোরে উঠেছিল দুর্বল হংকংকে হারিয়ে। অবশ্য সুপার ফোরের ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে ফাইনালের পথে এক পা দিয়েই রেখেছিল তারা। কিন্তু আফগানিস্তানের বিপক্ষে রীতিমত ঘাম ঝরিয়েই ফাইনালে উঠতে হয়েছে পাকিস্তানকে। আগেই ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায়, নিয়ম রক্ষার ম্যাচে অবশ্য শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান একটি ম্যাচ খেলেছিল। ফাইনালের আগে এমন গুরুত্বহীন ম্যাচে জয়টা গিয়েছিল লঙ্কানদের ঘরে।
মইন খানকে দিয়ে শুরু, এরপর দীর্ঘ ১২ বছর পর মিসবাহ উল হকের নেতৃত্বে আবারো এশিয়া কাপ শিরোপা। ইতিহাস বলে, পাকিস্তান তাদের খেলা এশিয়া কাপের ১৪ আসরের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দু’বার আর সমান সংখ্যকবার জুটেছে রানার আপ ট্রফি। ২০১২ এর পরে সেই পাকিস্তানের সামনে এখন তৃতীয় এশিয়া কাপ জয়ের সুযোগ। একই সাথে মঈন খান, মিসবাহ উল হকের পর তৃতীয় পাকিস্তানি অধিনায়ক হিসেবে বাবর আজমেরও সুযোগ রয়েছে দেশকে শিরোপা জেতানোর।
২০০০, এরপর ২০১২। পাকিস্তানের জেতা এ দুই শিরোপাতেই জড়িয়ে আছে ঢাকার নাম। কারণ দুই ফাইনালই গড়িয়েছিল ঢাকার মাটিতে। ২০০০ সালে মিরপুরের বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কাকে ৩৯ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ জিতেছিল পাকিস্তান। আর ২০১২ সালে মিরপুর শেরে বাংলা ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে সাকিব, মুশফিকদের কান্নায় ভাসিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়া কাপ জিতেছিল মিসবাহ উল হকের দল।
পাকিস্তানের অবশ্য এবারের ফাইনাল মরুর প্রান্তে, দুবাইয়ের মাটিতে। এ ফাইনালের গল্প গাঁথা রচিত হতে এখনো কিছু সময়ের অপেক্ষা। ততক্ষণে পাকিস্তানের আগের দুই ফাইনাল জেতার গল্প শোনানো যেতে পারে।
সাত জুন, ২০০০। এশিয়া কাপ ফাইনালে মুখোমুখি পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা। সাঈদ আনোয়ার, শহীদ আফ্রিদি, ওয়াসিম আকরামদের নিয়ে তারকা খচিত দল মঈন খানের পাকিস্তান। অপরদিকে, সনাথ জয়াসুরিয়া, জয়াবর্ধনে, চামিন্দা ভাস, মুরালিধরণদের নিয়ে নামের ভারে একটুও পিছিয়ে নেই শ্রীলঙ্কা। তাই দুই দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস আগেই ছিল।
স্কোরবোর্ডে বড় রান করে শ্রীলঙ্কাকে স্নায়ুবিক আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে টসে জিতে প্রথমেই ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন মইন খান। সে পরিকল্পনার ছিটে ফোঁটা অবশ্য মাঠে প্রথমদিকে মেলেনি। মন্থর গতিতে সে ম্যাচে ১১৫ বলে ৮২ রান করেছিলেন সাইদ আনোয়ার। তবে শেষ দিকে ইনজামাম ৬৬ বলে ৭২ রান আর অধিনায়ক মইন খানের ঝড়ো ৩১ বলে ৫৬ রানের ইনিংসে ২৭৭ রানের বেশ বড় সংগ্রহই পায় পাকিস্তান।
জবাবে ৪৬ রানেই শ্রীলঙ্কা হারিয়ে ফেলে তাদের প্রথম তিন ব্যাটারকে। তবে এক প্রান্ত উইকেট আগলে রেখে খেলে যাচ্ছিলেন মারভান আতাপাত্তু। ব্যক্তিগত সেঞ্চুরিও পেয়ে যান তিনি। কিন্তু সেঞ্চুরির পর তিনি আউট হয়ে গেলে আর কোনো ব্যাটার সেভাবে রান করতে পারেননি। প্রায় ব্যাটারই উইকেটে যাওয়া আসার মিছিলে সঙ্গী নয়। তাই লক্ষ্যের পথে থাকলে নির্ধারিত ৫০ ওভারের ২৮ বল বাকি থাকতেই ২৩৮ রানে অলআউট হয়ে যায় লঙ্কানরা। পাকিস্তান জয় পায় ৩৯ রানে। আর এর মধ্য দিয়ে প্রথম বারের মতো এশিয়া কাপ শিরোপা যায় পাকিস্তানের ঘরে। ফাইনালের সে ম্যাচে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন অধিনায়ক মঈন খান।
পাকিস্তানের দ্বিতীয় এশিয়া কাপ শিরোপা এসেছিল ২০১২ সালে। প্রথম শিরোপার ঠিক এক যুগ পর। তবে এবার প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদশে। সেবারের ফাইনালে শুরুর চমকটা বাংলাদেশেরই ছিল। ২৩৬ রানেই পাকিস্তানকে আটকে দেয় তাঁরা। তবে ২০৬ রানে ৯ উইকেট পড়ার পরও শেষ উইকেটে পাকিস্তানের ৩০ রানের জুটিই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
এরপরও জবাবের শুরুটা বাংলাদেশের ভালই ছিল। প্রথম জুটি থেকেই আসে ৬৮ রান। তবে ছন্দপতন হয় মিডল অর্ডার ব্যাটারদের ব্যর্থতায়। এরপরও খেলা গড়ায় টান টান উত্তেজনায়। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানের ম্যাচে মিরপুরের গ্যালারি যেন সেদিন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।
একটা সময়ে এসে বাংলাদেশের দরকার ছিল শেষ ওভারে ১০ রান। কিন্তু আইজাজ চিমার সে ওভারে বাংলাদেশ তুলতে পেরেছিলেন ৭ রান। শেষ বলে ৪ রানের সমীকরণে সেদিন ব্যাটে বলেই করতে পারেননি শাহাদাত হোসেন। বাংলাদেশ সে ফাইনাল হেরে যায় ২ রান। এতো কাছে গিয়ে শিরোপা স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় টাইগারদের। তাই ম্যাচ চেষে চোখে জল নেমে এসেছিল সমর্থক থেকে ক্রিকেটারদেরও। মুশফিক, সাকিবদের অশ্রুতে যেন সেদিনের মিরপুর এক খণ্ড বিষাদরূপ নিয়েছিল। তবে পাকিস্তান ঠিকই মেতেছিল শিরোপা জয়ের উচ্ছ্বাসে। আর সে ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছিলেন শহীদ আফ্রিদি।
এক দশক পরে আজ আবারও কি শিরোপা জয়ের উচ্ছ্বাসে মাতবে পাকিস্তান? ২০১৪ এশিয়া কাপে এই শ্রীলঙ্কার কাছে ফাইনাল হেরেছিল পাকিস্তান। তাই আপাতত প্রতিশোধের মঞ্চায়ন হিসেবে লঙ্কানদের হারানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেই পারে পাকিস্তান।