বিশ্বকাপ বিজয়ের ভারতীয় টেমপ্লেট!

সমর্থন বলুন বা ফ্যানডম, মানুষকে কিছুটা অন্ধ করে দেয়। ভালোবাসায়, ক্ষোভে, দুখে। কালকের খেলার পরে আমি দুটো পোস্ট করি যে আমার সেঞ্চুরির জন্য ওরকম আদেখলামো পছন্দ হয়নি। অনেকেই তার বিরোধিতা করেছেন। তা করতেই পারেন, গণতন্ত্রে অন্যের পছন্দের সঙ্গে নিজেকে মেলাতেই হবে এই দায় কারুর নেই।

সমর্থন বলুন বা ফ্যানডম, মানুষকে কিছুটা অন্ধ করে দেয়। ভালোবাসায়, ক্ষোভে, দুখে। কালকের খেলার পরে আমি দুটো পোস্ট করি যে আমার সেঞ্চুরির জন্য ওরকম আদেখলামো পছন্দ হয়নি। অনেকেই তার বিরোধিতা করেছেন। তা করতেই পারেন, গণতন্ত্রে অন্যের পছন্দের সঙ্গে নিজেকে মেলাতেই হবে এই দায় কারুর নেই।

কিন্তু এটায় ভুল কোথায় বলুন তো? ভারতীয়রা (কিছুটা সানি এবং অনেকটাই দ্রাবিড় ছাড়া প্রত্যেকেই। এমনকি এমএসডিও মনে হয় ঠিক সময়ে ছাড়েননি।) রেকর্ডের জন্য খেলে তো বটেই। কটা বিশ্বকাপ জিতেছি সেটা বড় কথা নয়, কটা সেঞ্চুরি করলাম কত উইকেট নিলাম সেটা বড় হয়ে দাঁড়ায়।

এ তো গেল আমার কৈফিয়ত। তাহলে বিরাট? রান তাড়া করার ক্ষেত্রে বিরাট বিভান, মাহি সবার আগে চলে যাবেন। অন্তত: সাদা বলের ক্রিকেটে। কালও খুব সাধারণ ফিলজফি নিয়ে ব্যাট করেছেন। টেক ইট টু দ্য ডিপ। ঠিক যে দর্শন মাহি প্রয়োগ করতেন সেটাই। চান্সলেস ক্রিকেট, ব্রিলিয়ান্ট প্লেসমেন্ট সেন্স, এবং রানিং বিটুইন দ্য উইকেট।

প্রথমার্ধের সঙ্গে দ্বিতীয়ার্ধের উইকেটে ফারাক কোথায় ছিল? বিশেষজ্ঞরা অনেক ভালো বলতে পারবেন, কিন্তু আমার মনে হয়েছে পরের দিকে উইকেট গ্রিপ করছিল অনেক বেশি। অপর দিকে শিশিরের সমস্যা ছিল।

ভারত তার সেফটি ফার্স্ট অ্যাপ্রোচ ছেড়ে শামিকে দলে নিয়েছিল। পরিষ্কার হিসাব। চার ব্যাট, দুই অলরাউন্ডার চার বোলার। নিউজিল্যান্ডও তৈরি হয়েই এসেছিল এই ম্যাচে। কুলদীপকে প্রথম থেকেই আক্রমণ করতে শুরু করেন রবীন্দ্র এবং ডারেল মিচেল। রবীন্দ্র বোধহয় নিউজিল্যান্ডের সবথেকে ক্লাসিকাল বাঁহাতি ব্যাট।

যতটা পিছনে যেতে পারি, ব্রুস এডগার, জন রিড, জন রাইট, স্টিফেন ফ্লেমিং, মার্ক গ্রেটব্যাচ, মার্ক রিচার্ডসন, জেসি রাইডার, টম ল্যাথাম। নিউজিল্যান্ডের বাঁ হাতি ব্যাট তো কম নেই। কিন্তু দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং বলতে একমাত্র ক্রিস হ্যারিসের কভার ড্রাইভ আর কিছুটা স্টিফেন ফ্লেমিং মনে পড়ে।

রবীন্দ্র কিন্তু অনেকটাই ক্লাসিকাল মোডের ব্যাট। উপ মহাদেশে শিকড় থাকার জন্যই বোধহয়, আমার ওর ব্যাটিং দেখলে কুমারা সাঙ্গাকারার কথা মনে পড়ে।

আর ড্যারিল মিচেল, নিউজিল্যান্ড মিডল অর্ডারের লক্ষ্মণ, নিঃশব্দে কাজ করে যান। অসম্ভব ভালো ফুটওয়র্ক, ব্যাকফুট বা ফ্রন্টফুট, দুটোতেই সমান স্বচ্ছন্দ। স্পিন হাত বুঝে খেলেন, পা ব্যবহার যথাযথ। কাল ধারাভাষ্যের সময় বলা হয়েছে। ওঁকে দেখলেই রিকি পন্টিং-এর কথা মনে পড়ে।

এঁরা দুজনেই মিডল ওভারে কুলদীপকে আক্রমণ করলেন। ফল হল, মিডল ওভারে বল করার জন্য বুমরাহকে ২০-৩০ ওভারের মধ্যে ডাকতে হল। আসলে শার্দূল ঠাকুরকে মূলত মিডল ওভারসের বল করার জন্য এবং লোয়ার মিডল অর্ডারে ২০-২৫ রান দেবার জন্য রাখা হয়েছিল।

কিন্তু, সেটা অনেকটাই সেফটি ফার্স্ট অ্যাপ্রোচ। শামি প্রথম বলে উইকেট নেবেন, স্লগে এসে উইকেট নেবেন, পার্টনারশিপ ভাঙবেন। কিন্তু মাঝের ওভারগুলিতে রান আটকে চাপ দেওয়ার কাজটা করবেন না। তবে কালকের ম্যান অব দি ম্যাচ পারফরমেন্সের পর আর কোনও কথা হবে না।

যদিও আমার মনে হয়েছে, উইকেট অনুযায়ী জাদেজা একটু জোরে বল করেছেন। তবে এটা হতেই পারে যে অপর দিকে কুলদীপকে যখন সেটল হতে দিচ্ছেন না রবীন্দ্র এবং মিচেল, তখন রান আটকে ওভার শেষ করার দিকে অনেক বেশি নজর ছিল রবীন্দ্র জাদেজার।

আর যশপ্রীত বুমরাহ! উফ কী বলি আর! সেদিন সিদ্ধার্থ মোঙ্গাই বোধহয় লিখলেন, হি ইজ টু প্রাউড টু টেক উইকেটস। স্লো উইকেট, জোরে বোলারদের বল ব্যাটে আসছে, সেট ব্যাটসম্যান। এই অবস্থাতেও ক্রমাগত চাপ দিয়ে গেলেন, অপর দিকে শামি সেটা ক্যাপিটালাইজ করলেন। লেন্থ, গতি এবং ট্র্যাজেক্টরির পরিবর্তন মাশাল্লাহ!

শামির কথা অবশ্যই বলতে হয়। চারটে ম্যাচ না খেলেও নিজেকে একদম টপ অব দ্য ব্যক্স তৈরি রাখা এবং যে কাজের জন্য দলে নেওয়া সেই কাজ করাটা মুখের কথা নয়। ব্রিলিয়ান্ট সিম পজিশন, ক্রিজের ব্যবহার এবং উইকেট আক্রমণ করে বল করা। ম্যান অব দ্য ম্যাচ পারফরম্যান্সই বটে!

রবীন্দ্র আউট হতে কেউ আর থিতু হতে পারল না। মিচেল হয়তো আরেকটু আক্রমণত্মক হতে পারতেন। যেখানে পিচ এবং আউটফিল্ড কন্ডিশন খুব ভালো করে বুঝে গেছেন তিনি।

ভারতের রান তাড়ার ক্ষেত্রে টিম ম্যানেজমেন্ট কিছু কিছু টেম্পলেট সেট করেছে। রোহিত শুরুটা আক্রমণ দিয়ে করবেন, গিল তাতে জয়েন করবেন, বিরাট নোঙর ফেলবেন, শ্রেয়স ভয়ডরহীন ব্যাটিং করবেন, রাহুল অবস্থা বুঝে নোঙর ফেলবেন অথবা শট মেকিং-এ যাবেন। ওভার যদি বেশি থাকে তাহলে সূর্য সিঙ্গলস-ডাবলসে যাবেন এবং শেষে ঝড় তুলবেন অথবা ঈশান শ্রেয়সের টেম্পলেটই মেনে চলবেন। মাঝখান থেকে জাদেজার ব্যাটিং না পাওয়াটা চিন্তার কারণ ছিল। কালকের পর আর সেই ভয় নেই।

দ্বিতীয়ার্ধে, ব্যাটিং অনেকটা সহজ হয়ে গেছিল। কিন্তু নিউজিল্যান্ড সমানে চেষ্টা করে গেছে। হেনরি বিশেষ করে। চতুর্থ স্টাম্পের একটা নাছোড়বান্দা লাইন রেখে গেছেন সর্বক্ষণ। ব্যাটের ধার পায়নি হয়তো, কিন্তু পরে পাবে না এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। মিচেল স্যান্টনার এই বিশ্বকাপের সেরা স্পিনার। মাঠের শিশির তাঁর ক্ষমতাকে কোনোভাবেই কম করতে পারে না। বাঁ হাতি স্পিনারের স্পিনিং ফিঙ্গার হয় মধ্যমা।

স্যান্টনারের আঙুল অনেক বেশি লম্বা বলে উনি তর্জনী দিয়ে বল স্পিন করান, বুড়ো আঙুল ব্যবহার না করেও প্রথম দুই আঙুলে বল ছোট স্পিন করাতে পারেন এবং অবশ্যই আর্ম বল এবং ক্যারম বল। বাঁ হাতি স্পিনারের ক্যারম খুবই অপ্রতুল। স্যান্টনার পারেন, করেনও।

তবে, কাল পিচ বুঝে বল একদম গুডলেন্থে রেখে যাচ্ছিলেন এবং সময় সময় বল সামান্য ফ্লাইট দিচ্ছিলেন। ফ্লাইট দেবার মজা হল তাতে ঘুর্ণন বা রেভোলিউশন বেশি হয়, পিচে বল গ্রিপ করার সময় পায় এবং টার্ন পাওয়া যায়। সেটা বুঝেই টম ল্যাথাম রবীন্দ্রকে দিয়েও বল করিয়ে গেলেন, টানা।

এবং বিরাট বিরাট বিরাট! পচা শামুকে বারবার পা কাটে বলে বেশি প্রশংসা করব না। কিন্তু এই যে ঝট করে পিচ বুঝে যাওয়া, বিপক্ষের আক্রমণ বুঝে যাওয়া এবং সেই অনুযায়ী নিজের ব্যাটিংএ সামান্য পরিবর্তন করা খেলার মধ্যেই। এ ক্ষমতা সচিনের ছিল। বিরাটের আছে। কালকের পরিবর্তন দেখুন, অনেক বেশি অফ স্টাম্পের উপর চলে এসে খেলেছেন, যাতে সামান্য টার্ন, স্যুইং বা সিম মুভমেন্ট সামলে দিতে পারেন।

এই নিউজিল্যান্ড দলের অসুবিধা হল, বলের গতি হেরফের করার মতো জোরে বোলার নেই। কাল নিউজিল্যান্ড সাউদিকে মিস করেছে। হেনরি, ফার্গুসন ভালো বোলার কিন্তু গতির হেরফের করাটা সমস্যা। বোল্ট অবশ্যই অন্যতম সেরা, কিন্তু স্যুইং না হলে বা সেটা নেগেট করার জন্য রোহিত, গিল দু পা হেঁটে এলে বোল্টের কাছে উত্তর নেই। এই অবস্থায় ঠুকে ঠাকে বাউন্সার বা স্যান্টনারের উপর ভরসা করা ছাড়া যাবার নেই কোথাওই। বিরাট এটা বুঝেছেন, ভারত এটা বুঝেছে। আর সেই ভাবেই খেলেছে।

তবে শেষ প্রান্তে এসে সিঙ্গল না নেওয়াটা আমার সত্যিই ঠিক লাগেনি।অস্ট্রেলিয়া বা গতবারের ইংল্যন্ড এ বিষয়ে অনেক বেশি রুথলেস ছিল, এবারের দক্ষিণ আফ্রিকাও। ভারতেরই এই জায়গাটাই আমার সমস্যা লেগেছে। সারা ম্যাচ দলগতভাবে খেলে এসে হঠাৎ রেকর্ডের জন্য গিয়ার পরিবর্তন।

এই দলের যিনি কোচ, তাঁরও দুই ফরম্যাটে দশ হাজার রান এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৮টা সেঞ্চুরি আছে। কিন্তু তিনিও ব্যক্তিগত রেকর্ডের থেকে দলের জয়কেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারত সেই ক্রিকেটই খেলছে। কিন্তু লোকেশ রাহুলের সেঞ্চুরি হারানোর হতাশা, বিরাটের এই ম্যাচে সিঙ্গল না নেওয়া। লক্ষ্য নড়িয়ে দেবে না তো? পচা শামুকে অনেকবার পা কেটেছে ভারতের। ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি চিন্তা করুন। সারা টুর্নামেন্টে কেউ দাঁড়াতে পারল না, কিন্তু ফাইনালে নিজেরাই।

আশা করি ভারত নিজের টেম্পলেটে খেলেই ২০১১’র পুনরাবৃত্তি করবে, ঠিক সময়ে পিক করার সুযোগটা নেবে। কাল তো জাদেজাও ঠিকঠাক ব্যাট করে নিলেন, যেটা টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডারের ধারাবাহিকতার ফলে হচ্ছিল না। কিন্তু এই ব্যক্তিগত অ্যাচিভমেন্টের জন্য ছোটাছুটিটা আমার অস্বস্তি লাগছে। আপনার নাই লাগতে পারে, তাতে সমস্যা নেই কিছু। আমি আমার মতো করে বললাম, আপনি আপনার মতো করে ভেবে নিন না হয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...