স্পিনের বিরল বাদশাহ

সবুরে মেওয়া ফলে, এই কথাটা সম্ভবত বেশি প্রযোজ্য হয় ইংলিশ ক্রিকেটার গ্রায়েম সোয়ানের ক্ষেত্রে।

গ্রায়েম সোয়ানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ২০০০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্লুমফেইন্টনে। মাত্র এক ম্যাচ খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দীর্ঘ এক বিরতিতে পড়েছিলেন তিনি।

কাউন্টি ক্রিকেটে নর্দাম্পটনশায়ার এবং নটিংহামশায়ারে দীর্ঘ আট বছর খেলার পর ২০০৮ সালে টেস্ট অভিষেক ঘটে সোয়ানের। ভারতের বিপক্ষে চিদাম্বরাম স্টেডিয়ামে টেস্ট ক্রিকেটে আসেন তিনি। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই তাঁকে। হয়েছেন ইংল্যান্ডের ওইসময়ের সেরা স্পিনার।

গ্রায়েম সোয়ান ক্যারিয়ারে ৬০ টেস্টে খেলেছেন। এই সময়ের মধ্য নিয়েছেন ২৫৫ উইকেট। উইকেট প্রতি প্রায় ৩০ রান করে দিয়েছেন তিনি। পাঁচ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারী বোলার। এমনকি ঐ সময়ে খেলা জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড এবং ডেল স্টেইনের থেকেও বেশি উইকেট ছিলো তাঁর। যখন সোয়ান তার ক্যারিয়ার শেষ করেন তখন তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডে টেস্ট ইতিহাসের ষষ্ঠ সর্বোচ উইকেট শিকারী। ইংল্যান্ডের কোনো স্পিনারের জন্য এ বিরল এক সম্মাননা।

ইংলিশ স্পিনার হিসেবে তাঁর চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছন একমাত্র ডেরেক আন্ডারউড। যিনি কিনা নিয়েছিলেন ২৯৭ উইকেট। সোয়ান বেশ ভালো ভাবে ম্যাচে মানিয়ে নিতে পারতেন। যখন ইংল্যান্ডের চার পেসারকে বিশ্রাম দিয়ে স্পিনার নিয়ে আসার প্রয়োজন হতো, তখন তিনি বেশ দুর্দান্ত ভাবে বল করতে পারতেন।

সোয়ান ছিলেন ইংলিশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। মাঠ এবং মাঠের বাইরে বেশ দুর্দান্ত ছিলেন। সহজেই মানিয়ে নিতে পারতেন মাঠের ক্রিকেটের সাথে। তিনি দুর্দান্ত একজন স্পিনারের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত স্লিপ ফিল্ডার।

সোয়ান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যখন নিয়মিত হতে শুরু করেন তখন একটা যুগের সূচনা হয়েছিলো। সেখানে অফস্পিনাররা টিকে থাকতে পারছিলো না। সেখানে সবচেয়ে ব্যাতিক্রমধর্মী একজন অফ স্পিনার ছিলেন গ্রায়েম সোয়ান। তিনি দুসরা করতে পারতেন না। তবে বেশ চাতুর্যতার সাথে বলে ফ্লাইট এবং টার্ন দিতে পারতেন।

বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য যমদূত ছিলেন গ্রায়েম সোয়ান। প্রযুক্তির অনেক উন্নতির কারণে খালি চোখে আম্পায়াররা যেসব আবেদন নাকচ করে দিতেন এই সব উইকেট তিনি রিভিউ নিয়ে পেয়েছেন। তাঁর ২৫৫ উইকেটের মধ্যে ৭০ উইকেট ছিলো বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে লেগ বিফোরের মাধ্যমে।

যেখানে জিম লেকার ১৯৩ উইকেটের মধ্যে মাত্র ৩২ উইকেট পেয়েছেন। আগে ধারণা করা হয়েছিলো জিম লেকারের বাঁহাতিদের বিপক্ষে এলবিডাব্লিউ এর এই রেকর্ড ভাঙতে পারবে না। তবে সে রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন গ্রায়েম সোয়ান। গ্রায়েম সোয়ান মোট ১২১ উইকেট নিয়েছেন বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে।

চেন্নাইয়ে তাঁর অভিষেক ম্যাচের প্রথম ওভারেই দুই উইকেট নেন তিনি। এই দুই উইকেটে ছিলো তাঁর দক্ষতার পরিচত। বেশ কয়েক মাস দূর্দান্ত পারফর্মেন্সের মাধ্যমে মান্টি পানেসারকে ইংল্যান্ড দলের মূল স্পিনার হিসেবে সরিয়ে দিতে বাধ্য করে। মন্টি পানেসারের জায়গায় আবির্ভূত হন তিনি নিজে।

ক্যারিয়ারের শুরু দিকে তিনি একজন ড্রেসিং রুম জোকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু আসলে মাঠে তিনি ছিলেন বেশ কার্যকর একজন বোলার। তিনি মাঠে প্রচুর প্রতিদ্বন্দ্বীতার মনোভাব নিয়ে মাঠে নামতেন। আর সাথে তাঁর কাজের সেরা কারিগর ছিলেন তিনি নিজে।

সোয়ানের রেকর্ড এটাই বলে যে ঘরোয়া ক্রিকেটে উন্নতি করাটা কতটা জরুরী। তিনি অনেক দ্রুতই জাতীয় দলে এসেছিলেন। তবে যত দ্রুত তিনি জাতীয় দলে এসেছিলেন ঠিক ত্ত দ্রুতই তাকে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরিয়ে নিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখনকার ইংলিশ কোচ ডানকান ফ্লেচার তাকে ঘরোয়া ক্রিকেটে পাঠিয়ে দিয়ে বেশ বুদ্ধিমান এক কাজ করেছেন। না হলে হয়তো অপরিণত বয়সেই হারিয়ে যেতে পারতেন তিনি।

ঘরোয়া ক্রিকেটে দূর্দান্ত পারফর্ম করার পর তিনি টেস্টে পরিণত হয়েছিলেন একজন ম্যাচ জেতানো ক্রিকেটার হিসেবে। এছাড়াও ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি দলেও বেশ নিয়মিত সদস্যে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এক সফল সফর শেষে ২০০৯ সালে অ্যাশেজ সিরিজের লর্ডস এবং ওভালে ম্যাচ জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন সোয়ান।

পরবর্তী বছরগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ডারবানে, বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রামে এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে এডবাজস্টন এবং লর্ডস, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডিলেড, শ্রীলংকার বিপক্ষে কার্ডিফ, ভারতের বিপক্ষে ওভাল, শ্রীলংকার বিপক্ষে কলম্বো টেস্ট জয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন তিনি।

২০১২ মৌসুমে ঘরের মাঠে তাঁর ক্যারিয়ারের স্বর্নালী সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। এই সময়ে ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা হাশিম আমলা তাঁর বিপক্ষে বেশ খাবি খেয়েছিলেন। এই সময়েই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বারের মত টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েন সোয়ান। হেডিংলি টেস্ট কুখ্যাত ছিলো একটি বার্তার জন্য যেখানে ইংলিশ ব্যাটসম্যান কেভিন পিটারসেন জড়িত ছিলেন।

এরপরেও শীতে আবারো দলে ফিরে আসেন গ্রায়েম সোয়ান। দলে ফিরেই ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের ভারতের মাটিতে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ে ভূমিকা রাখেন তিনি। সোয়ান এবং পানেসার দুইজন মিলে ভারতের ২০ উইকেটের মধ্যে ১৯ উইকেট শিকার করেন। খ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান  তাঁকে তখন ‘ধূলিকনার অধিপতি’ হিসেবে ডাকা শুরু করে।

পুরো ক্যারিয়াজুড়ে তিনি কনুইয়ের ইনজুরি নিয়ে খেলেছেন। ২০১৩ সালে সোয়ান শল্যবিদের ছুরির নিচে বাধ্য হন। এরপর থেকেই ইংল্যান্ড দল তাকে ছাড়াই দল ভাবতে শুরু করেছিলো। যদিও তিনি আবারো ফিরে এসেছিলেন অ্যাশেজ সিরিজে। ঘরের মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজে ২৬ উইকেট শিকার করে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ফিরতি অ্যাশেজে সিরিজই হয়েছিলো সোয়ানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ।

অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্টে তিনি খেলে ফেলেন তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। এই টেস্টে নিজের করা শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান শেন ওয়াটসনের কাছে বেধড়ক মার খান সোয়ান। শেষ ওভারে রান দেন ২২ রান। এই সিরিজে মাত্র ৭ উইকেট এবং ৮০ রান তাঁর ক্যারিয়ারকে শেষ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

প্রথম তিন টেস্ট হারার মাধ্যমে অ্যাশেজ সিরিজ হেরে গিয়েছিলো ইংল্যান্ড। বক্সিং ডে টেস্টের চার দিন আগে নিজের অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। অনেক আশা নিয়ে এই সফর শুরু করেছিলো ইংল্যান্ড কিন্তু এই সফর শেষে এটা হয়ে দাড়ায় ব্যর্থতার এক সিরিজ। দীর্ঘদিন তিন নাম্বার অবস্থানে স্থায়ী থাকা জোনাথান ট্রট মানসিক অবসাদের কারণে জাতীয় দল থেকে বিদায় নেন।

সোয়ানের এই অবসর নিয়ে অনেকেই স্বার্থপরতার বিষয় ভেবেছিলো। যদিও সে নিজে তাঁর এই কনুইয়ের সমস্যার কারণে খেলতে পারছিলেন না। সোয়ান জানান তিনি যখন অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নেন সেটা ছিলো তাঁর জন্য ভয়ংকর এক বিষয়। তিনি তাঁর পুরো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে জানান, ‘কোনো সন্দেহ নেই আমি লটারি জেতার মত অনুভব পাচ্ছি।’

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link