ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ইতিহাসে এবারই প্রথম নয়। সঞ্জয় বাঙ্গার, অনিল কুম্বলেরা আগে থেকেই ছিলেন। আর গত মৌসুমে অভিষেকেই গুজরাট লায়ন্সকে শিরোপা জিতিয়ে নিজের আগমণ জানান দিয়েছেন আশিষ নেহরা। তবে কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচ হিসেবে চন্দ্রকান্ত পন্ডিতের আবির্ভাব পাল্টে দিতে পারে আইপিএলে ভারতীয় কোচদের চেহারা। ঘরোয়া ক্রিকেটের সফল এই কোচ এবার আইপিএলের আঙিনায় পা রেখেছেন নিজের যোগ্যতার জানান দিতে।
আইপিএলে দলগুলো বিদেশি কোচপ্রীতি সেই শুরু থেকেই। গত মৌসুমেও দশ দলের মাঝে আট দলের প্রধান কোচই ছিলেন বিদেশি। তবে এই মৌসুমে থেকেই বোধহয় পরিবর্তিত হচ্ছে সেই, ভারতীয় কোচেই আস্থা বাড়ছে দলগুলোর। তাছাড়া বিদেশি কোচ আনতে হলে প্রচুর ঝামেলাও পোহাতে হয় দলগুলোও। প্রধান কোচের পাশাপাশি তাঁর পছন্দের সহকারী কোচসহ পুরো কোচিং স্টাফই থাকেন বিদেশি। ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের এই যুগে তাঁদেরকে বেশিদিনের জন্য পাওয়াটাও হয়ে দাঁড়ায় দু:সাধ্য।
অনেক বিদেশি কোচই তাঁর পুরো পরিবারসহ আসেন টুর্নামেন্টের সময় এবং তাঁদের খরচও বহন করতে হয় ফ্যাঞ্চাইজিকেই। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের মতো দলের জন্য এটা হয়তো কোনো সমস্যা না, কিন্তু বাকি দলগুলোর জন্য এটা একটা মারাত্নক সমস্যা। এছাড়া বিদেশি কোচদের বাহারী সব আবদারও মেটাতে হয় ফ্যাঞ্চাইজি ম্যানেজমেন্টকে। একবার এক বিদেশি কোচ টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে এক ‘বিশেষ পানীয়’ এর আবদার করেন। তার ভাষ্যমতে, তিনি কোভিড নিয়ে কড়াকড়ির কারণে হোটেলের বাইরে গিয়ে কিনে আনতে পারছেন না এবং হোটের পাঁচ তারকা বার থেকে তাঁর পক্ষে কেনা সম্ভব না। পরে সেই দলের কর্তৃপক্ষকেই তাঁর জন্য বিশেষ পানীয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
এছাড়াও বিদেশি কোচরা অনেক সময়ই ফ্যাঞ্চাইজির নানা কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না। এক কোচ ফ্যাঞ্চাইজির প্রচারণামূলক এক ক্যাম্পেইনে অংশ নিতে আলাদা অর্থ দাবি করেন। অথচ তাঁর চুক্তিপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে তিনি এর জন্য আলাদা কোনো অর্থ প্রণোদনা পাবেন না। বিদেশি কোচদের নেবার পেছনে সাধারণত মূল কারণ থাকে তারা ক্রিকেটের পাশাপাশি ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিংটা বেশ ভালো বোঝেন।
ধারাভাষ্যকাররা প্রায়ই মাঠ এবং মাঠের বাইরে তাদের নিয়ে আলোচনা করেন। ফলশ্রুতিতে দলগুলো হয়ে যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তাছাড়া বিদেশি খেলোয়াড়দের সাথে তাদের যোগাযোগও ভালো। একজন রবি শাস্ত্রী কিংবা রাহুল দ্রাবিড় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত; ভরত অরুণ, আর শ্রীধর, ভি রমণ, অমল মুজুমদাররাও হয়তো সেই ছোট তালিকাতেই থাকবেন, কিন্তু বাকি ভারতীয় কোচদের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি নেই বললেই চলে।
চন্দ্রকান্ত পন্ডিত অবশ্য নিজের পদ্ধতি অনুসরণ করেই সবার সাথে যোগাযোগ বজায় রাখেন। দলের বেশিরভাগ ভারতীয় ক্রিকেটারই ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর অধীনে খেলেছেন কিংবা তাঁর কোচিং পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন। অন্যদিকে বিদেশি ক্রিকেটার খেলানোর কোটা মাত্র চারজন হওয়ায় সাধারণত সেরা ক্রিকেটাররাই সুযোগ পান। তাঁদের আর আলাদা করে কোচিং করানোর প্রয়োজন পড়ে না। চন্দ্রকান্ত পন্ডিতকে যারা দেখেছেন, তারা জানেন তিনি মূলত তিনটি বিষয়ে জোর দেন।
ম্যাচের আগে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নাও, মাঠে নিজের সেরাটা দাও এবং নিয়মানুবর্তিতা মেনে চল। নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপারে তিনি বরাবরই কঠোর, ম্যাচ পরবর্তী করমর্দন থেকে শুরু করে সবকিছু করেন নিয়ম মেনে। এমনকি খেলোয়াড়রা কে কোথায় কিটব্যাগ রাখবেন সেটাও ঠিক করে দেন তিনি। তবে এরকম কড়া নিয়মকানুন তারকা ঠাসা আইপিএল ড্রেসিংরুমে প্রয়োগ করতে পারেন সেটা একটা চিন্তার বিষয়। নাইট রাইডার্সের কোচ হিসেবে ড্রেসিংরুমে প্রভাব বিস্তার করাটাই হবে তাঁর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
‘কলকাতাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবার পথে চান্দুকে কোচ হিসেবে পেয়ে আমরা আনন্দিত। ক্রিকেটের প্রতি তাঁর আত্নত্যাগ আর ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর সাফল্যের রেকর্ড, ভালো দিনেরই ইংগিত করছে। আশা করছি আমাদের তরুণ অধিনায়ক শ্রেয়াস আয়ারের সাথে তার জুটিটা ভালো জমবে’, চন্দ্রকান্ত পন্ডিতকে কোচ হিসেবে পেয়ে নিজের উল্লাস প্রকাশ করেন কলকাতার সিইও ভেংকি মাইশোর।
চন্দ্রকান্ত পন্ডিত নিজেও মুখিয়ে আছেন আইপিএলে নিজের সামর্থ্য বোঝানোর। ‘কলকাতার দায়িত্ব পাওয়া দায়িত্বের পাশাপাশি আমার জন্য ভীষণ সম্মানের। আমি খেলোয়াড় এবং দলের বাকিদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি তাঁরা সাফল্যের জন্য কতটা মুখিয়ে আছেন। অসাধারণ একটা দলের অংশ হতে পেরে আমি সত্যিই ভীষণ আনন্দিত’, কলকাতার দায়িত্ব পাবার পর এভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। কলকাতা অবশ্য তাঁকে আইপিএলের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে মধ্যপ্রদেশের হয়ে কোচিং চালিয়ে যাবার অনুমতি দিয়েছে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে সাফল্য পন্ডিতকে ধরা দিয়েছে দুহাত ভরে। ছয়বার রঞ্জি ট্রফির শিরোপা জিতেছেন। এরমাঝে তিনবার জিতেছেন মুম্বাইয়ের হয়ে, দুবার বিদর্ভ আর একবার জিতেছেন মধ্যপ্রদেশের হয়ে। ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট সকলেই কোচ আইপিএলে তাঁর আগমণকে স্বাগত জানিয়েছেন।
চান্দু একজন অসাধারণ কোচ। তাঁকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কলকাতা ম্যানেজমেন্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। মুম্বাইতে থাকার সময়ে আমিই চান্দুকে কোচ বানানোর ব্যাপারে বলেছিলাম এবং তাঁর কোচিংয়েই আমরা শিরোপা জিতি। আইপিএলের দলগুলোর উচিত ভারতীয় কোচ এবং কোচিং স্টাফদের উপর ভরসা রাখা। ভারতে প্রতিভার কোনো অভাব নেই, ‘বলেছিলেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক এবং প্রধান নির্বাচক দিলীপ ভেংসকার।
আইপিএলের আরও কয়েকটি দল এখনও কোচের সন্ধানে রয়েছে, যেমন পাঞ্জাব কিংস। অনিল কুম্বলের সাথে তিন বছরের চুক্তি শেষ হবার পর আর নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তাঁরা এর মাঝেই তাদের পরবর্তী কোচ খোঁজার কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। ইয়ন মরগ্যান, ট্রেভর বেইলিসসহ বেশ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল কোচের কাছে ইতোমধ্যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। হয়তো এদের মাঝেই কেউ কোচ হবেন, আবার হয়তোবা নতুন কাউকে নেয়া হবে।
আগামী দুয়েকসপ্তাহের মাঝেই তাদের নতুন কোচ ঘোষণা দেবেন বলে জানিয়েছেন পাঞ্জাব কিংসের একজন টিম অফিশিয়াল। এর বাইরে হায়দ্রাবাদের সাথে টম মুডির চুক্তি শেষ হয়ে গেলেও দলটি এখনও তাদের ভবিষ্যতের কোচ নিয়ে ভাবেনি। পাঞ্জাব কিংবা হায়দ্রাবাদ যাকেই কোচ হিসেবে নিয়োগ দিক না কেন, চন্দ্রকান্ত পন্ডিতের আইপিএলে কোচ হিসেবে আবির্ভাব বাকি ভারতীয় কোচদের জন্য খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার দ্বার।