চঞ্চল একটা বাচ্চা। পড়ায় মন নেই। মন থাকে খেলার মাঠে। সারাদিন খেলতে হবে, বড় ক্রিকেটার হতে হবে। এটাই ধ্যানজ্ঞান। পড়ার টেবিলের অমনোযোগী শিশুটিই মাঠে গেলে খুব সিরিয়াস। ফলাফল যাই হোক, খেলতে হবে, নিজের সেরাটা দিতে হবে।
কি? গল্পটা মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথে মিলে যাচ্ছে তো? না, তিনি ধোনি নন। তবে, এটা ঠিক এতটুকু বয়সেই তিনিই ধোনিসুলভ নির্ভার মানসিকতটা ধারণ করতে পেরেছেন। তিনি হলেন ঈষাণ কিশান।
‘কয়েকটা ম্যাচ বা টুর্নামেন্ট খেলেই তুমি জনপ্রিয় হতে পারো, এটা তোমার ওপর চাপ বাড়াবে। তোমাকে শুধূ নিজের খেলাটা উপভোগ করতে হবে। অনুশীলনে যা রোজ করো সেটাই মূল খেলায় করতে হবে।’
– ঈশান কিষাণ ব্যাট করতে নামার আগে এই কথা গুলোই রাহুল দ্রাবিড় তাঁর কানে কানে বলতেন। যুব পর্যায়ে এই রাহুলই তো এখন ভারতের কান্ডারি, গড়ে তুলছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তাঁর হাত ধরেই আসছে ভারতের আগামী দিনের ধোনি-শচীনরা।
ঈশানের জন্ম বিহারের নোয়াডায়, বাবা প্রনব কুমার পান্ডে ও মায়ের নাম সুচিত্রা সিং, মাত্র সাত বছর বয়সেই ক্রিকেট শুরু করেন ঈশান কিষাণ। খুব অতিমানবীয় প্রতিভা থাকলেও ক্রিকেট নিয়ে তিনি খুব সিরিয়াস ছিলেন না। একদিন ঈশানের কোচ তাঁর বাবাকে বলেন, ‘আপনার ছেলের মধ্যে বিশেষ কিছু আছে। ওর উচিৎ অবশ্যই ক্রিকেটটাকে সিরিয়াস ভাবে নেওয়া।’
সেখান থেকেই তাঁর ক্রিকেটের সাথে পথচলা শুরু!
ঈশানের বড় ভাই রাজ তিনিও ক্রিকেট খেলতেন। তার বাবা ছিলেন ঠিকাদারি কাজের ব্যবসায়। ঝুঁকি থাকার কারণে তার বাবার আদেশ ছিলো দুই জনই ক্রিকেটার হতে পারবেন না। সে তাঁদের একজনকে সেটা বেছে নিতে বলেন। এরপর ঈশানের ভাই তার জন্য ক্রিকেট ছেড়ে দেন, যা ঈশানের জীবনে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
শৈশব থেকেই পড়াশোনায় মনযোগী ছিলেন না ঈশান। সারাদিন তাঁর বইয়ে ক্রিকেট মাঠের ছবি আঁকতেন তিনি। দর্শকরা ঈশান কিষানের নামে প্ল্যাকার্ড নিয়ে উল্লাস করছেন তেমন ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। ঈশানের নামে তাঁর বাবা মায়ের কাছে পড়ালেখার ব্যাপারে প্রচুর অভিযোগ আসতো নিয়মিত।
ঈশানের মা বিরক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কখনোই ঈশানের পরীক্ষার খাতা দেখতে পারতাম না। সেগুলো ও লুকিয়ে রাখতো অথবা বাসে আসার সময় বাইরে ফেলে দিতো। যখন বাসার সামনে ক্রিকেট খেলতো তখন মানুষের বাসার দরজা জানালায় বল মারতো। বাসায় আশেপাশের মানুষ অভিযোগ নিয়ে আসতো প্রচুর।
ঈশান প্রতিদিন পাটনার মঈন উল হক স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতে যেতেন। সেখানে উইকেটরক্ষকদের ডাইভ দেওয়ার বিষয়টা বেশ উপভোগ করতেন। ভাগ্যক্রমে, একদিন তাদের নিয়মিত উইকেটরক্ষক না থাকার ঈশান এই দায়িত্ব নিতে চায়! সে দুটি ক্যাচ নিয়েছিল, ভালো ফিল্ডিং করার পাশাপাশি একটি স্ট্যাম্পিংও করে ইশান। সেখান থেকে গ্লাভস হাতে তাঁর যাত্রা শুরু!
উইকেটরক্ষক হিসেবে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের স্লেজিং করতে ঈশান খুব ভালোবাসতেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি স্কুল ভিত্তিক বিশ্বকাপে তাঁর স্কুলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন, যা আলিগড়ে অনুষ্ঠিত হয়।
তাঁর স্কুলে নিয়মকানুন এবং উপস্থিতির ব্যাপারে বেশ কঠোর ছিলো। ঈশান সারাদিন ক্রিকেট খেলতো যার জন্য স্কুলে সে ঠিকমতো উপস্থিত থাকতো না। এক সময় তাঁকে স্কুল থেকে চলে যেতে বলা হয়। পরের দিনই ইশান স্কুল ছেড়ে দেন! শুধুমাত্র ক্রিকেট নিয়ে ভাবনা চিন্তায় থাকতেন ঈশান।
বইয়ের সাথে তখন থেকেই সম্পর্কটা ভাল নয় ঈশানের। আজো রাতে ঘুম না আসলে হাতে নাকি একটা বই নেন। তখনই নাকি ঘুম চলে আসে!
কিশোর বয়সে তাঁর বড় ভাই রাজ প্রস্তুতি নিচ্ছিলো অনূর্ধ্ব-১৪ স্কুল গেমস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (এসজিএফআই) হয়ে ট্রায়াল দেওয়ার। ঈশানও জিদ করেন, তিনিও ট্রায়াল দিতে চান। তাঁর বাবাও তাকে অনুমতি দেন। ভেবেছিলেন ঈশান ডাক পাবেন না, মজা করতে খেলে আসুক।
তবে, বাবার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করেন ঈশান। দুই-তিনটি দারুণ শট খেলে সেখানে নির্বাচিত হন ঈশান! এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন থেকেই তাঁর পরিচয় একটাই – ‘ছোটা ডায়নাইমাইট’!
এরপর ঈশান বেশ কিছু সময় বিহারের হয়ে খেলেন। কিন্তু বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সাথে বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) ঝামেলা হওয়ায় তাঁদের সাথে চুক্তি ছিন্ন হয়। এরপর কোচ, ভাই এবং সিনিয়রদের পরামর্শে ইশান ১৫ বছর বয়সে ঝাড়খণ্ডে চলে যান।
ধাপে ধাপে তিনি ওপরে উঠেন! প্রথমে সেইলের হয়ে খেলেন এরপর অনূর্ধ্ব-১৬ দলে সুযোগ পান। সেখান থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ এরপর বিজয় হাজারে ট্রফিতে দল পান এবং এরপর ডাক পান রঞ্জি ট্রফিতে৷ সেখান থেকে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) আর এরপরই স্বপ্নের জাতীয় দল! এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে তার বাবা-মা এবং ভাইয়ের সাপোর্ট পাওয়ায়।
স্বরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচে তার ব্যাটিং দেখার পর নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। ঝাড়খণ্ডের বিপক্ষে করা ২৭৩ রান আজও রঞ্জি ট্রফিতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড হিসেবে অক্ষুন্ন আছে। সেই ইনিংস খেলার পথে মোট ১৪টি ছক্কা মারেন তিনি।
অধিনায়ক হিসেবেও তিনি বেশ সফল বটে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তিনি ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে সেবার ভারত ফাইনাল খেলে, তবে ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে তারা পরাজিত হয়। তবু তার অধিনায়কত্ব নিয়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।
তিনি সবসময়ই মহেন্দ্র সিং ধোনিকে আদর্শ মানেন। ধোনি দেওয়া একটা উপদেশ তিনি সবসময়ই মনে রাখেন, ‘তুমি একজন আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান, কিন্তু যখন তুমি একটি ম্যাচে খেলবে তখন তোমাকে মাথায় রাখতে হবে কখন ডিফেন্স করবে আর কখন তুমি শট খেলবে।’
২০১৬ সালে গুজরাট লায়ন্সের হয়ে আইপিএলে অভিষেক হয় ঈশান কিষাণের। ২০১৭ মৌসুমেও একই দলের হয়ে খেলেন তিনি। ২০১৮ মৌসুমে আইপিএলের নিলামের ঠিক আগে ছেলের দল পাবার চিন্তায় ব্লাড প্রেশার বেড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ঈশানের বাবা! কিন্তু যখন তিনি শুনতে পান ঈশান বড় অংকে আইপিএলে দল পেয়েছেন, তা শুনে তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত হন।
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে ২০২১ আসরে ১৪ ম্যাচে ৫৭ গড়ে করেন ৫১৬ রান! ১৪৫-এর ওপরে স্ট্রাইক রেটের সাথে আছে চারটি ফিফটি। এই আইপিএলের পারফরম্যান্স তাঁর জন্য খুলে দেয় জাতীয় দলের দরজা। ছোট ডায়মাইটের শরীরে তাই এখন শোভা পাচ্ছে ভারতের জার্সি।
ঈশান কিষাণ বিচিত্র এক চরিত্র। এই চরিত্রে ‘কুসংস্কার’ও আছে। যখন মাঠে নামেন – আগে ডান পা দেন। লেগ স্টিকের আগে ব্যাট দিয়ে চারটা টোকা দেন, নন স্ট্রাইকার এন্ডে পা বাঁকা করে দাঁড়ান। তিনি কথা বলেন ব্যাটের সাথে, বিশেষ করে যখন বড় রান করে ফেরেন। সেকারণেই কি না, ব্যাটটাও তাঁর হয়ে কথা বলে!