কখনও ধূসর, কখনও রঙের হোলি খেলা

অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়! ঠিক এমনই সব প্রতিশব্দ প্রতিধ্বনিত হয়েছে গুজরাটের নরেন্দ্র মোদি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। প্রায় এক লাখ মানুষ উপভোগ করেছে ভুবন ভোলানো এক দৃশ্য। এই দৃশ্যের অবতারণা এর আগেও হয়েছে। তবে ম্যাচ পরিস্থিতি বিবেচনায় পেছনের সব স্মৃতি যেন এক লহমায় উবে গেছে। নতুন করে রোমাঞ্চকর এক যাত্রার গল্প লিখেছে রিঙ্কু সিং।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের জনপ্রিয় কেন এত! এই বিস্ময়ের জবাবটা যেন বিস্ময় আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে হয়, তাতেই বোধহয় আইপিএলের সৌন্দর্য বাড়ে। ক্রিকেটের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে শতভাগ। একটা ম্যাচে যা কিছু হওয়া সম্ভব, তার সবটুকু হয়েছে। একটা ম্যাচ ঠিক যতটুকু বিনোদনের বিস্তার ঘটাতে পারে, তাঁর সবটুকুই ঘটিয়েছে গুজরাট টাইটান্স আর কলকাতা নাইট রাইডার্সের মধ্যকার ম্যাচ।

বিজয় শঙ্কর ২৪ বলে ৬৩ করল। ছক্কা মারল মোট মিলিয়ে পাঁচ খানা। দর্শকরা ভেবে নিল এই বুঝি শেষ দিনের সকল আনন্দ। তবে ক্রিকেট বিধাতা যেন দু’হাত ভরে তৈরি ছিল আজ। তিনি আহমেদাবাদের প্রতিটা মানুষকে ক্রিকেটকে আরও একবার নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে বাধ্য করলেন। পূজনীয় ক্রিকেটটা ঠিক আরও একবার সর্বেসর্বার আসনে।

অধিনায়কের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া রশিদ খান, তুলোধুনো হলেন বল হাতে। আইপিএলে আসার আগে টানা ১০০ বলে বাউন্ডারি হজম না করা রশিদ যেন হারিয়ে গেলেন। প্রথম তিন ওভারে ৩৫ রান হজম করলেন। না, সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এই তবে সময়ের সেরা লেগ স্পিনারের দশা! রশিদ যেন ব্রত নিলেন, নিজের ঘূর্ণি জাদুর মোহনীয় প্রভাব তিনি ছড়িয়ে দেবেন সর্বত্র। তিনি তাই করলেন, তিনি কব্জির মোচড়ে এক এক করে তুলে নিলেন টানা তিন উইকেট।

এও কি সম্ভব! উইকেট নিলেন তো নিলেন, বাঘা বাঘা সব ব্যাটাররা মুখ থুবড়ে পড়ল ঝড়ে রাতে গাছপালার মতো। অ্যান্দ্রে রাসেন, সুনীল নারাইন, আর আগের দিন দ্রুত গতিতে হাফসেঞ্চুরি করা শার্দুল ঠাকুর। সবাই এলেন আর চলে গেলেন। চোখের পলক ফেলা অবধিও ঠাঁই হয়নি তাদের বাইশ গজে। আর ঠিক কিভাবে বিনোদিত করা যায়!

ও হ্যাঁ, কলকাতার হয়ে ভেঙ্কেটেশ আইয়ারের ইনিংসটি তো ভুলে যাওয়ার নয়। রশিদ তাণ্ডবের আগে দমকা হাওয়ার মত রান তুলেছেন ভেঙ্কেটেশ। তিনিও তাঁর ইনিংসে মেরেছেন পাঁচ খানা ছক্কা। ৪০ বলে ৮৩ করে থেমেছেন। একটা দিন, একটা ম্যাচ আর কিছু দিতে পারে না। অলৌকিক কিছু হওয়া চাই। সেই অলৌকিকতার দেখা মেলে ম্যাচের শেষ ওভারে।

কলকাতার জয়ের জন্য চাই ২৯ রান। যত যাই হোক! কলকাতা আর পারবে না। স্ট্রাইকে উমেশ যাদব। পাঁচ খানা ছক্কা, তাও এক ওভারে! ওসব সম্ভব না। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করাই যেন রিঙ্কুর কাজ। কিন্তু রিঙ্কুর তো তখন অপরপ্রান্তে। উমেশ যাদব বুদ্ধিমান বৈকি! একটা সিঙ্গেল নিলেন। না, পরাজয়ের দায় কাঁধে নেওয়া যায় না। নিলেন না তিনি। তবে রিঙ্কু চোয়াল ঝুলিয়ে দিল সবার। আনকোড়া বোলার যশ দয়ালের গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে হিমশীতল তরল।

স্তম্ভিত গোটা নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম, স্তম্ভিত সকলে! টানা পাঁচ ছয়! টানা! পাঁচ বলে! এত চাপ সামলে কি করে পারলেন রিঙ্কু! তাঁর বোধহয় স্নায়ুচাপ বলতে নেই কিছু। তাঁর ধমনীতে বরফ গলা জলের সমাহার। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাবটা রিঙ্কুর শিরায় শিরায় বহমান। রিঙ্কু শেষ হাসি হাসলেন। চোখ ছানাবড়া করে দিয়ে তিনি উন্মাদ নৃত্যের আসর বসালেন। তিনি বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়লেন।

তবে গাব্বার পারলেন না। তিনি ‘লোন ওয়ারিওর’ হয়ে হেরে গেলেন। সেনাপতি শিখর ধাওয়ান একাই লড়ে গেলেন। তাঁর তরবারি যেন থামল না। এক এক করে সহযোদ্ধাদের প্রস্থান। ধাওয়ান অবিচল, অনড়। তিনি খুঁটি গেড়ে লড়াই চালিয়ে গেলেন। যে লড়াইয়ের শেষটায় কেবলই আক্ষেপ। রিঙ্কু যখন তাঁর দলকে নিয়ে আনন্দ উৎসবের আয়োজনে মশগুল, তখন ধাওয়ান খুঁজে বেড়াচ্ছেন একটু খানি আশার আলো।

সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ ধাওয়ানের স্বতন্ত্র রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে তুলে নেয় নিজেদের প্রথম জয়। কি হতো, যদি ধাওয়ানই জিতে জেত! ক্রিকেটা বিধাতা ৯৯ রানে আটকে দেয় ধাওয়ানকে। দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেও পরাজয়ের বিষাদ গ্রাস করে নিল। আক্ষেপের আগুন ততক্ষণে হৃদয়কে করেছে কয়লা।

একই দিনে, দু’টি ভিন্ন ম্যাচে, ক্রিকেট নিজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলল। রঙ-তুলির আঁচড়ে বিস্ময় আর বিষাদের অদ্ভুত মেলবন্ধন। ক্রিকেট ঠিক কতটা বৈচিত্র্যময়, এর থেকে ভাল উদাহরণ আর হয় না। ক্রিকেট একদিকে কাঁদাবে,  আবার একদিকে অট্টহাসির যোগান দেবে। বিউটিফুল ক্রিকেট!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link