ক্রিকেটের আনন্দ মানুষের জীবনে আর নাই

ক্রিকেট আমার কাছে দারুণ উপভোগ্য একটা খেলার নাম। আমার কৈশোরের বেশিরভাগ সময় কাটছে খিলগাঁও গভমেন্ট স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেইলা।

এছাড়া আমরা দুই একদিন ম্যাচ খেলতাম বেড়াভাঙ্গা স্কুলের মাঠে, আর শেষের দিকে সৃজনী ক্লাবের মাঠে। এমনকি বাড়ির গ্যারেজের ফাঁকা জায়গাতে; ইভেন, শুক্রবারসহ অন্যান্য ছুটির দিনে নাইলে হরতালে বাসার সামনের রাস্তায় সকাল সকাল দুই ইটের চিপায় স্ট্যাম্প গাইড়া ক্রিকেট খেলতে নামতাম আমরা। সেই আমলে হরতাল হইতো খুব, তখন স্কুলে না গেলেও হইতো।

আমি প্রায়ই গর্বের সাথে বলি, আমাদের খিলগাঁও মাঠের দুই দুইজন খেলোয়াড় জাতীয় টিমের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিলেন। অথচ সেই মাঠে কমপক্ষে ৩০/৩৫টা দল একসাথে ক্রিকেট খেলতো। বাউন্ডারির কোন হিসাব নাই। মাঝে মাঝে ঠিক হইতো যে, ছয় মারতে হইলে গার্লস স্কুলের দোতালার বারান্দায় বল পাঠাইতে হবে। আর নাইলে সব চাইর। যার যেইখানে খুশি স্ট্যাম্প পুইতা খেলা শুরু কইরা দিতেছে।

টেপ টেনিসে খেলা চলতো তখন। আর প্রফেশনাল ক্রিকেটাররা মাঠের এক কোনায় নেট ঝুলাইয়া প্যাড পইরা ক্রিকেট বলে দিনভর প্র্যাকটিস করতো। কারও কোন সমস্যা হইতো না।

তো, ক্রিকেট বিষয়ক এই স্মৃতিচারনের কারণ, কিছুদিন আগে সাতক্ষীরায় গেছিলাম ন্যাশনাল টিমের বোলার মুস্তাফিজের বাড়িতে বেড়াইতে। সেইখানে, সেই মফস্বলেও বড় বড় বেশ কয়েকটা মাঠ। প্রতিটা মাঠেই শ’ খানেক কিশোর ব্যাট বল প্যাড হেলমেট নিয়া আছে।

অথচ, সেই কিশোরদের কেউ একজনও ক্রিকেট খেলতেছে না।

তাদের জন্য কোচ আছেন, এবং তাদের প্রত্যেকেই প্রফেশনাল ক্রিকেট প্র্যাকটিস কইরা যাইতেছে। মফস্বলের সেই মাঠে মাকড়শার মতো জাল জড়াইয়া ব্যাট প্যাড আর ক্রিকেট বল নিয়া জাতীয় টিমে ক্রিকেট খেলতে চায় তারা। মাশরাফি সাকিব মুস্তাফিজ ছাড়া আর কিছু হইতে চায় না তারা। তাদের চোখভরা স্বপ্ন। কিন্তু, খেলার আনন্দ তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র নাই।

খেয়াল করলে দেখা যায়, জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় আসতেছে খুলনা বিভাগীয় অঞ্চলের দিক থেকে। ফলে অনুমান করা যায়, সেই অঞ্চলের আর কোন মাঠ খেলার জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা না! সবখানেই প্র্যাকটিস!

অথচ আমাদের ঢাকার মাঠের অবস্থাও তার থেকে বেশি ভাল নাই। যেই অল্প কয়টা মাঠ আছে, সেইগুলা সব বাউন্ডারি দিয়া দেয়া হইছে। খোলা মাঠ বইলা কোন কিছুর আর অস্তিত্ব নাই মনে হয় আর এই শহরে। মাঠের চারদিকে দেয়াল। সেই দেয়ালের পাশে সন্ধ্যার পরে যখন অন্ধকার হয়, তখন নেশাখোর লোকেরা আইসা বসে। তাদেরকে ঠেকাইতে এখন গেট বানাইয়া সন্ধ্যার পরে তালা মাইরা রাখা হয় মাঠগুলা। আর দিনের বেলায় প্র্যাকটিস।

কিছু মাঠ আবার মহল্লার ডায়বেটিকগ্রস্থ লোকেরা সিনিয়রিটির প্রভাব খাটাইয়া চারদিকে সিমেন্ট ঢালাই দিয়া ওয়াকওয়ে বানাইছেন। সকালে সন্ধ্যায় ‘ভোরের আলো’ লেখা সাদা গেঞ্জি আর কেডস পইরা তারা হাটে। সকলে গোল হইয়া দাড়াইয়া থুতনিতে চিবি দিয়া হো হো কইরা হাসে। তাতে তাদের হার্টের উপকার হয়। সেইসব মাঠে আবার বাচ্চাদের খেলাধূলা নিষিদ্ধ। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকে, ওয়াকওয়েতে কুকুর বিড়াল এবং গৃহভৃত্য নিয়া হাটা নিষেধ।

মোট কথা, আনন্দের জন্য খেলার প্র্যাকটিসটাই উইঠা যাইতেছে। কমবয়সীদের খেলার জায়গা নস্ট কইরা বুইড়া বয়সে ট্রাউজার পইরা দৌড়ানোর দিকে যাইতেছে আমাদের সামাজিক জীবন। ক্ষমতার জোরে ছোটদের খেলার মাঠ বন্ধক নিয়া দৌড়াবে বুইড়ারা, আর অভিযোগ করবে এখনকার ছেলেপেলেরা তো কম্পিউটার ইন্টারনেট ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝেনা!

ফলে, খেলার আনন্দ মানুষের জীবনে আর নাই। খেলা হইয়া উঠতেছে দিনে দিনে জাতীয়তাবাদ কলোনিয়ালিজম ইত্যাদি প্রয়োগজনিত এক হীনম্মন্য আবেগের গ্যাসচেম্বার। দিনে দিনে ক্রিকেট একটা খেলা হিসেবে উপভোগের জায়গা থেকে সরতে সরতে লড়াইয়ের অস্ত্র হইয়া উঠতে পারতেছে তা পরিস্কারই দেখতে পাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link