বিশ্বকাঁপানো এক হোটেল বেয়ারা

এতসব কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য নিজের প্রেমের জন্যও সময় বের করতেন দানি আলভেস। প্রেমটা ফুটবলের সাথে। জুয়াজেইরো শহরের এক কোনায় একটি মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন আলভেস। শুরুর দিকে স্থানীয় স্ট্রিট ফুটবলে তিনি ছিলেন রাইট উইঙ্গার, কিন্তু গোলটাই করতে পারতেন না। এই ‘না পারা’ তাকে ঠেলে দিয়েছে ডিফেন্সের দিকে, দানি আলভেস হয়ে উঠেছেন রাইট ব্যাক।

তাকে আটকে রাখা যায় না। তবে তিনি চাইলে আটকে দিতে পারেন যে কাউকে। বয়সটা প্রায় চল্লিশের ঘরে, তবু লক্ষ্য একটাই। ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ খেলতে চান তিনি। বয়স তাঁর জন্য সমস্যা নয় হয়তো। হয়তো তিনি মানেন, চাইলেই সব সম্ভব। সব কিছু সম্ভব করার এই মন্ত্র যিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন তিনি দানিয়েল আলভেস দা সিলভা।

দানি আলভেস নামে পরিচিত এই মানুষটা ১৯৮৩ সালের ৬ই মে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলো থেকে দুই হাজার কিলোমিটার উত্তরের এক জুয়াজেইরো শহরে জন্মেছিলেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান আলভেসকে ছোটবেলা থেকেই কাজ করতে হয়েছে খামারে। খামারের পাশাপাশি একটা হোটেলে বেয়ারার কাজও করতেন তিনি।

এতসব কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য নিজের প্রেমের জন্যও সময় বের করতেন দানি আলভেস। প্রেমটা ফুটবলের সাথে। জুয়াজেইরো শহরের এক কোনায় একটি মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন আলভেস। শুরুর দিকে স্থানীয় স্ট্রিট ফুটবলে তিনি ছিলেন রাইট উইঙ্গার, কিন্তু গোলটাই করতে পারতেন না। এই ‘না পারা’ তাঁকে ঠেলে দিয়েছে ডিফেন্সের দিকে, দানি আলভেস হয়ে উঠেছেন রাইট ব্যাক।

মাত্র তেরো বছর বয়সে ব্রাজিলের প্রদেশ বাহিয়ার একটি ফুটবল ক্লাবে সুযোগ পান আলভেস। কিন্তু আলভেসের জীবনে প্রথম বড় কিছু ঘটে ২০০২ সালে। সে-বছর স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়া বাহিয়া’র ক্লাব থেকে ডেকে নেয় আলভেসকে। পেশাদার ফুটবলে তাঁর পথ চলা শুরু হয় সেভিয়ার হয়ে।

সেভিয়ায় শুরুতে অবশ্য আলভেজ এসেছিলেন ধারে। একাদশে জায়গা পেতেন না ঠিকঠাক, বসে থাকতে হতো সাইডবেঞ্চে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে কষ্ট করে বড় হওয়া দানি আলভেস এমন কঠিন পরিস্থিতিতে হাল ছাড়েননি, নিজেকে গুটিয়ে নেননি। নিজের কাজটা মনপ্রান দিয়েই করে গিয়েছেন।

নিজেকে প্রমানের প্রথম সুযোগ দানি আলভেস পেয়েছিলেন ব্রাজিলের যুব দলের হয়ে। ২০০২ সালের নভেম্বরে ব্রাজিলের যুব দল জিতে নেয় বিশ্বকাপ, আর আলভেস নির্বাচন হলের টুর্নামেন্টের তৃতীয় সেরা খেলোয়াড়। এরপরই একেবারে পাকাপাকি সেভিয়া তাদের করে নেয় এই ব্রাজিলিয়ানকে।

পরের মৌসুমে লা লিগায় মোট ২৯ ম্যাচ খেলেছিলেন আলভেজ। সেবার থেকেই দলে নিয়মিত হয়ে যান তিনি। স্প্যানিশ কোচ হুয়ান্দে রামোসের অধীনে আলভেজ ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে। সেভিয়ার হয়ে দানি আলভেস খেলেছেন দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর। এ সময় তিনি খেলেছেন ২৩৩ টি ম্যাচ। একজন ডিফেন্ডার হয়েও অ্যাসিস্ট করেছেন ২৯টি আর নিজেই গোল করেছেন ১৫ বার।

২০০৮-০৯ মৌসুমে স্পেনের আরেকটি দল এফ.সি বার্সেলোনার তৎকালীন কোচ পেপ গার্দিওলা খুব আশাবাদী হয়ে দলে ভেড়ান আলভেস’কে। গার্দিওলা তখন বলেছিলেন যদি মেসির সঙ্গে আলভেসের সমন্বয়টা ভালো হয়- তাহলে নিশ্চিতভাবেই বার্সার রাইট ফ্ল্যাঙ্ক হবে বিশ্বের সেরা।

গার্দিওলা ঠিকই ভেবেছিলেন, আর সেটি প্রমান করতে আলভেসের বেশি সময় লাগেনি। আলভেসে’র আগমনের ফলে বার্সেলোনার রাইট ফ্ল্যাঙ্ক শুধু সেরাই হয়নি, ফুলব্যাকের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিলেন দানি আলভেজ। আর বার্সেলোনার সাফল্যের অনেকটা জুড়েই ওই ডান প্রান্তে মেসি-আলভেজের সমন্বয়।

প্রথম মৌসুমে সম্ভাব্য সব শিরোপা জিতে নেয় বার্সেলোনা। এরপর থেকে ইউরোপের ফুটবলে বার্সেলোনার যে দাপট সৃষ্টি হয়েছিল তার অনেকটা কৃতিত্ব আলভেসকে দিতেই হবে। সেসময় বার্সেলোনায় ৩৯১ ম্যাচে ১০১ অ্যাসিস্ট আর ২১ গোল করেন আলভেস।

কিন্তু শুধু সংখ্যায় আলভেসের গুরুত্ব বোঝা যায় না, বোঝা যায় যখন আলভেস পরবর্তী বার্সেলোনার রাইট ব্যাক পজিশনের দিকে তাকানো হয়। নেলসন সেমেদো কিংবা সার্জিও রবার্তো কেউই পারেনি দানি আলভেসের শূন্যস্থান পূরন করতে।

ফুলব্যাক পজিশনের ধারণা বদলে দিয়েছিলেন আলভেজ। ডান দিক দিয়ে বার্সেলোনার বেশিরভাগ আক্রমণেই থাকতেন আলভেজ। আলভেজ মেসিকে পাস দেবেন, মেসি গোল করবেন- এমনটা লা লিগায় একটা সময় নিয়মিত দৃশ্য হয়ে উঠেছিল। নিজে গোল না করে আলভেজ কতশত বার মেসির পায়ে বল ঠেলে দিয়েছেন গোল করার জন্য তার ইয়ত্তা নেই। মেসির গোলে অ্যাসিস্ট করেই খুশি আলভেস।

আক্রমণের সঙ্গে ট্র্যাকব্যাক করার দারুণ ক্ষমতা, গেম রিড করতে পারা আর প্রখর মনোযোগ- এই তিনের মিশেল আলভেজ আর বার্সেলোনাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন বহুদূর। বার্সা অধ্যায়ে সম্ভাব্য সবকিছু জিতেছেন, ট্রেবলের মত মূল্যবান অর্জনের অংশীদারও ছিলেন। বার্সেলোনার ৮ বছর দানি আলভেজ নিজেকে বিশ্বের সেরা রাইটব্যাকে পরিণত করেছিলেন।

বার্সেলোনা ছাড়ার পর খেলেছেন জুভেন্টাসে, প্যারিস সেন্ট জার্মেই এর মত ইউরোপের সেরা ক্লাবে৷ এই দুইটি ক্লাবের হয়ে মোট ১০৬ ম্যাচ খেলে আলভেস গোল করেছেন ১৪ টি, আর গোল করিয়েছেন ২৪টি। এরপরই ইউরোপীয় ফুটবল ছেড়ে আলভেস ফিরে গিয়েছিলেন নিজের স্বপ্নের ক্লাব সাও পাওলোতে৷

আন্তজার্তিক ক্যারিয়ারে দানি আলভেস একটুও কার্পন্য করেননি নিজেকে উজাড় করে দিতে। ব্রাজিলের হয়ে ১২২ টি ম্যাচ খেলেছেন আলভেস। অধিনায়কত্বও করেছেন কয়েক ম্যাচে। জিতিয়েছেন, জিতেছেন কোপা আমেরিকা, কনফেডারেশন কাপের মত ট্রফি।

ট্রফির কথা যখন আসেই, তখন লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নয়। বিশ্ব ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় দানি আলভেস। সব মিলিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে জিতেছেন ৪২টি শিরোপা, আর কোন খেলোয়াড় পারেননি এতবার শিরোপা উদযাপন করতে। যেখানে খেলেছন আলভেস, সেখানেই দুইহাত ভরে জিতেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা, লিগ ওয়ান, সিরি এ, ফিফা ক্লাব কাপ, স্প্যানিশ কাপ, ফ্রেঞ্চ লিগ কাপ, ইতালিয়ান লিগ কাপ, উয়েফা সুপার কাপের মত সব বড় বড় ট্রফি আছে দানি আলভেসের ক্যাবিনেটে।

সবাই হয়তো ধরেই নিয়েছিল সাও পাওলো’তে খেলা শেষে আলভেস হয়তো তুলে রাখবেন নিজের বুটজোড়া। কিন্তু আলভেস তো সাধারণ কেউ নয়। সাও পাওলো অধ্যায় শেষে কিছুটা সময় বিরতি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আবার ফিরেছেন ফুটবলে। একেবারে নিজের সবচেয়ে প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনাতে।

তবে কোন কিছু প্রমাণের জন্য নয়, আলভেস ফিরেছেন নিজের ভালবাসার ক্লাবটিকে দুর্দশা থেকে টেনে তুলতে। বার্সাতে আলভেসের বেতন সপ্তাহে মাত্র এক ইউরো। অবিশ্বাস্য এই বেতনে শুধু একজন দানি আলভেসই খেলতে পারেন বার্সেলোনার হয়ে। তিনি যে বার্সেলোনার শুধু খেলোয়াড়ই নয়, তিনি তো কাতালোনিয়ার ক্লাবটির একনিষ্ঠ একজন গুণমুগ্ধ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...