ধরুন আপনি ফুটবল দলের রক্ষণ সামলানোর দায়িত্বে আছেন। আপনাকে সেন্টার ব্যাকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, আপনি সেটা পালন করেছেন। সেই আপনাকেই আবার আরেকদিন রাখা হয়েছে ফুলব্যাকের পজিশনে। আপনি সেখানেই খেললেন সবটা দিয়ে। শেষমেশ ডিফেন্স লাইন থেকে তুলে আপনাকে মিডফিল্ডে জায়গা দেয়া হলো আপনিও সেখানেও খেললেন একেবারে দারুন।
খেলাটা ক্রিকেট হলে আপনাকে চোখ বন্ধ করে বলা যেত মিস্টার অলরাউন্ডার। কিন্তু খেলাটা ফুটবল, তাই বলতে হবে ‘ভার্সেটাইল প্লেয়ার’। আর এতক্ষণ যে আপনি’র কথা বলা হয়েছে তিনি ডেভিড ওলাতুকুনকো আলাবা। তর্ক ছাড়াই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সেরা ভার্সেটাইল ফুটবলারদের মধ্যে উপরের দিকেই থাকবেন এই অস্ট্রিয়ান।
নিজের প্রায় এক যুগের ফুটবল ক্যারিয়ারে লম্বা সময় খেলেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখে। বাভারিয়ানদের ডিফেন্স লাইনের বামপাশটা বরাদ্দ ছিল তরুণ আলাবার জন্য। লেফটব্যাক পজিশনে থেকে প্রায় দশ বছর দলটির হয়ে কৃতিত্বের সাথেই খেলেছিলেন তিনি। এরপর ২০২১ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে রিয়াল মাদ্রিদ তাকে দলে ভিড়িয়েছিল একজন সেন্টার ব্যাক হিসেবে।
না, আলাবা মোটেও ব্যর্থ হননি। বরং সার্জিও রামোস, ভারানেদের হারানো রিয়াল ডিফেন্সকে আগলে রেখেছেন তিনি। মেকশিফট ডিফেন্ডার হয়েও পারফর্ম করেছেন রক-সলিড। আরেক সেন্টারব্যাক এডার মিলিটাও-এর সঙ্গে জুটি গড়ে রিয়ালকে রক্ষা করেছেন বারবার।
লেফটব্যাক কিংবা সেন্টারব্যাক আলাবা যখন আবার নিজ দেশের জার্সি গায়ে জড়ান তখন কিন্তু ডিফেন্স লাইনে খেলেন না। অস্ট্রিয়ার হয়ে ডেভিড আলাবা মাঠে নামেন একজন মিডফিল্ডার হয়ে। সাধারনত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আর মাঝেমধ্যে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের ভুমিকায় দেখা যায় ৩০ বছরের এই তারকা’কে।
আক্রমনভাগের অনেককেই দেখা যায় এমন ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে খেলতে। একজন লেফট উইঙ্গারকে রাইট উইংয়ে দেখা যেতে পারে। একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার কখনো আবার বনে যেতে পারেন ফলস নাইন। কিন্তু গোল বাঁচানোর দায়িত্বে থাকা কেউ একজনও যে এভাবে মাঠের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াতে পারেন সেটি হয়তো কল্পনা করা সহজ নয়।
পজিশনের সামান্য ভুল, ছোটখাটো মিস পাস কিংবা ম্যানমার্কিংয়ে গড়বড়; এমন সূক্ষ্ম ভুলে যেখানে গোল হজম করতে পারে সেখানে একেকসময় একেক পজিশনে খেলেও নিজেকে ভরসাযোগ্য হিসেবেই প্রমান করে যাচ্ছেন আলাবা।
ডেভিড আলাবার জন্ম ১৯৯২ সালের ২৪শে জুন। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্বের অন্যতম সুন্দর শহর, আর এখানেই বেড়ে উঠেছিলেন আলাবা। সুন্দর শহরের শিশু আলাবা’র সাথে সখ্য গড়ে ওঠে ফুটবলের। অল্প বয়স থেকেই তাই ফুটবল খেলতে শুরু করেন তিনি। মাত্র ৯ বছর বয়সে স্বদেশী ফুটবল ক্লাব আসপার্নের যুব পর্যায়ের হয়ে খেলার মাধ্যমে ফুটবল জগতে প্রবেশ করেছিলেন আলাবা।
এর প্রায় ছয় বছর পরে ২০০৭/০৮ মৌসুমে, ‘অস্ট্রিয়া ভিয়েনা-২’ দলের হয়ে খেলার মাধ্যমে তিনি তার পেশাদার পর্যায়ের খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেছেন। অস্ট্রিয়া ভিয়েনা ২-এর হয়ে বছর দুয়েক খেলার পর, বায়ার্ন মিউনিখ ২-এ যোগদান করেন ডেভিড আলাবা। সেখানেও তিনি ২ মৌসুম কাটিয়েছেন, আর এর পরই ১৭ বছর বয়সে তিনি বায়ার্ন মিউনিখের মূল দলে যোগদান করেন।
শুরুর দিকে বেঞ্চে বসেই কাটাতে হতো তাকে, এসময় ধারে আরেক জার্মান ক্লাব ‘১৮৯৯ হফেনহাইম’ এ চলে যান তিনি। এর পরের বছরই পুনরায় থেকেই বায়ার্ন মিউনিখের শিবিরে নিয়ে আসা হয় তাকে। ২০১০ সাল থেকেই ধীরে ধীরে দলের সেরা একাদশের নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠেন আলাবা।
২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর বাভারিয়ানদের হয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, এইসময়ে তাদের হয়ে মোট ৪৩০ টি ম্যাচ খেলেছিলেব আলাবা। ৩৩টি গোলের পাশাপাশি ৫৫টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন তিনি। নিজের দীর্ঘ এক বায়ার্ন অধ্যায়ে কখনোই লিগ শিরোপা হাতছাড়া করেননি আলাবা। দশটি বুন্দেসলিগা ছাড়াও দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিলেন এদের হয়েই। এছাড়া উয়েফা সুপার কাপ এবং জার্মান সুপার কাপও পেয়েছেন ডেভিড আলাবা।
২০২১ সালে নতুন রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে জার্মানি ছেড়ে স্পেনে চলে আসেন অস্ট্রিয়ান সুপারস্টার। বাৎসরিক ১১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পাঁচ বছরের চুক্তি করেন রিয়াল মাদ্রিদের সাথে। সার্জিও রামোসের ফেলে যাওয়া আইকনিক চার নাম্বার জার্সিটি তখন লস ব্ল্যাঙ্কোসরা তুলে দেয় আলাবার গায়ে। সেই থেকে রামোসের মতই নেতার ভুমিকায় আছেন আলাবা।
মাঠে খেলা চলাকালীন আর্মব্যান্ড হাতে থাকে না ঠিকই, কিন্তু সামনে থেকে পারফর্ম করে দলের রক্ষন দুর্গ ঠিক রাখেন তিনি। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে রিয়াল জিতেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা আর স্প্যানিশ সুপার কাপ। রিয়ালের এই জয়জয়কার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ডেভিড আলাবা। এখন পর্যন্ত সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে অল হোয়াইটদের হয়ে ৪৬ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। গোল করেছেন তিনটি আর করিয়েছেন আরো চারটি।
অন্যদিকে জাতীয় দলে ডেভিড আলাবার অভিষেকটা সেই ২০০৯ সালেই। বর্তমানে দলটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। এছাড়া ২০২১ সালের ইউরোতে দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আলাবা আর তার নেতৃত্বেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত টুর্নামেন্টের নক আউট পর্বে উঠেছিল অস্ট্রিয়া৷ নিজ দেশে ডেভিড আলাবা কতটা সেরা তা আসলে একটি পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। ২০১১ থেকে ২০২১ এই এগারো বছরে আটবারই অস্ট্রিয়ার ফুটবলার অব দ্য ইয়ারের পুরস্কার জিতেছেন এই মাদ্রিদ তারকা।
মাদ্রিদের হয়ে নিজের পাঁচ বছরের চুক্তির প্রথম বছরেই ভক্তদের মন জয় করেছেন, জয় করেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর লা লিগাও। ৩০ বছর বয়সী এই ফুটবলার নিশ্চয়ই খুব করেই চাইবেন মাদ্রিদের ইতিহাসে নিজের নামটা কিংবদন্তির কাতারে লিখতে। তার জন্য সামনে লম্বা পথ বাকি। তবে এখন পর্যন্ত যেভাবে মাদ্রিদের সফেদ জার্সিতে পারফরম্যান্স করেছেন আলাবা, সেটি ধরে রাখতে পারলে ইচ্ছেপূরন করাটা মোটেও কঠিন হবে না তার জন্য।
আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম বাদে মাদ্রিদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো রামোস, মার্সেলো’দের সাথে ডেভিড আলাবার নামটাও শোনা যাবে। কারো হয়তো স্মৃতিতে ভেসে উঠবে আলাবা’র আখ্যান আর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের সবুজ ঘাসে নিবেদিত এই আত্মার গল্প।