মেলবোর্নের সেই রাত। ঘরোয়া লিগে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দুর্দান্ত এক জয় ভিক্টোরিয়ার। জয়টা উদযাপন করতে পুরো বাহিনী নিয়ে মেলবোর্নের বেশ নামকরা এক হোটেলে উদযাপন করতে গেলেন ভিক্টোরিয়ার কোচ ডেভিড হুকস। সবার উদযাপনের মাঝেই হঠাৎ হোটেলের বাউন্সারের সাথে কথা-কাটাকাটি হুকসের। সেখান থেকে ব্যাপারটা হাতাহাতির পর্যায়ে। হঠাৎ হুকসে সজোরে এক ঘুষি বাউন্সারের! মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন হুকস, জ্ঞান হারালেন। আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। এক ঘুষিতেই আকস্মিক এক মৃত্যু!
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অবস্থা। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ পরিচিত মুখ তখন হুকস। অস্ট্রেলিয়ার এক মারকুটে তারকা। ব্যাট হাতে ঝড় তোলাটা ছিল এক প্রকার অভ্যাস। অভিষেকটাও ছিল স্মৃতিমধুর। নিজের ব্যাটিং শৈলীতে দ্রুতই ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ নাম ডাক হয় এই তারকার। ধারাবাহিক রান, সেঞ্চুরি-ফিফটির ফোয়ারা ছুটিয়ে ডাক পেলেন জাতীয় দলে।
নামের সাথেই হুক শব্দ ছিল। আর হুক শটটাও খেলতেন বেশ ভাল। মিডল অর্ডারে ছিলেন অন্যতম ভরসা। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটের ফর্ম কিংবা ধারাবাহিকতা কোনোটিই টেনে আনতে পারেননি জাতীয় দলে।
১৯৭৭ সালে টেস্ট ইতিহাসের একশো বছর পূর্তি। সাদা পোশাকের একশো বছরে পা দেওয়ায় উদযাপনের জন্য অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের সিরিজ আয়োজন করা হল। ওই সিরিজেই অভিষেক হয় হুকসের।
অভিষেকে মাঠে নামার আগে ইংলিশ অধিনায়ক টনি গ্রেগ হুকসকে উদ্দেশ্যে করে বলছিলেন, ‘না, আরেকজন বাঁ-হাতি ব্যাটার যে ব্যাট করতে পারে না।’ উত্তরটা সাথে সাথেই দিয়েছিলেন ২১ বছর বয়সী তরুণ হুকস। প্রতিত্তোরে বলেন, ‘অন্তত আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান, কোনো আমদানিকৃত কিছু না।’
প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৭ রানেই ফিরলেন হুকস। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামার পর বল হাতে আসলেন গ্রেগ। লক্ষ্য হুকসকে আউট করে বল হাতেই জবাবটা দেওয়া। কিন্তু এমন এক চিত্র দেখা গেল যা গ্রেগ নিজেও হয়ত ভাবেননি। এক ওভারে পাঁঁচ বাউন্ডারি হাঁকিয়ে গ্রেগকেই মাত দিলেন হুকস। অভিষেকেই পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলেন হুকস। ওই ম্যাচ শেষে গ্রেগ বিয়ারের আমন্ত্রণ জানান হুকসকে!
অভিষেকের পর সেই ফর্মটা অবশ্য আর ধরে রাখতে পারেননি হুকস। ন্যাচারালি স্ট্রোকমেকার ছিলেন। কিন্তু নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। অভিষেকের পরের বছরই যোগ দেন আলোচিত-সমালোচিত ক্যারি প্যাকারস সিরিজে। এরপর তিন বছর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি। ১৯৮০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক টেস্টে ফিরলেও দুই ইনিংসেই ব্যর্থতায় বাদ পড়েন তিনি। পরের দুই বছরে আর সাদা পোশাক গায়ে জড়াতে পারেননি তিনি।
১৯৮২ সালে অজি ক্রিকেটার ডেভিড হুকস ৩৪ বলে ১০২ রান করেন! প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে এটাই দ্রুততম সেঞ্চুরি। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েন সাবেক এই লেফটি! ওই মৌসুমে তাঁর অধীনেই ছয় আসর পর শেফিল্ড শিল্ড ট্রফি জেতে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া।
সেখান থেকে আবার জাতীয় দলের টেস্ট দলে জায়গা পান। এরপর টানা কয়েক বছর মোটামুটি দলে নিয়মিত ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের মত রানবন্যা আর দেখা যায়নি হুকসের ব্যাটে। যদিও রান খরার মাঝেও ছিলেন না। পঞ্চাশোর্ধ কিংবা এর আশেপাশেই থাকতেন তিনি। ওই সময়ের হিসেবে বেশ ভালই বলা চলে। ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে চার টেস্টে চার ফিফটি করেন। পরের বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ১৪৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। ওই সিরিজে অবশ্য সহকারী অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
অধারাবাহিকতায় টেস্ট ক্যারিয়ার থমকে গেছে মাত্র ২৩ টেস্টে। সাদা পোশাকে ২৩ টেস্টে ৩৪ গড়ে করেছেন ১৩০৬ রান। ৮ ফিফটির সাথে করেছেন মাত্র এক সেঞ্চুরি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শুরুটাও ছিল বেশ সাদামাটা। প্রথম পাঁচ বছরে খেলেন মোটে ৬ ম্যাচ। রঙিন পোশাকেও নিজের নামটা উজ্জ্বল করতে পারেননি হুকস। ৩৯ ম্যাচে ২৪ গড়ে ৫ ফিফটিতে করেছেন মাত্র ৮২৬ রান। ৮৩ এর বিশ্বকাপে সুযোগ পেলেও ব্যাট হাতে ছিলেন চরম সাদামাটা।
হুকস অবশ্য কখনো হতাশ হতেন না কিংবা হতাশা প্রকাশ করতেন না। বরং সব সময়ই চাইতেন নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে নিজেকে শীর্ষে নিয়ে যেতে। গ্যাবায় একবার এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ছক্কা ১৫টি। এই রেকর্ডটা আমি ভাঙবো।’ পরবর্তীতে তিনি এক ইনিংসে দশ ছক্কা হাঁকান। দশ ছক্কায় নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে খেলেন ২৪৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস।
বাংলাদেশের সাথে অবশ্য হুকসের সম্পর্কটা মোটেও ভাল নয়। ২০০৩ সালে বাংলাদেশকে কটাক্ষ করে হুকস বলেছিলেন, ‘এই দলকে একদিনেই হারানো যাবে।’
ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ ভিক্টোরিয়ার হয়ে কাজ করছিলেন কোচ হিসেবে। হয়তো কোচ হিসেবে আরও বড় স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। কিন্তু এই মারকুটে তারকার জীবনটা থেমে গেল আকস্মিক এক দূর্ঘটনায়! ৪৮ বছর বয়সেই পাড়ি জমালেন পরপাড়ে।