ধ্রুব পান্ডব; মাত্র ১৮ বছর বয়সী একজন ব্যাটসম্যান। যিনি কিনা মাত্র ১৮ বছর বয়সেই পাঁচ বছর ধরে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। বলা হচ্ছিল, পাঞ্জাবে এমন এক প্রতিভাবান ক্রিকেটার এসেছেন যিনি কালক্রমে শুধু ভারত নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেও রাজত্ব করবেন।
কিন্তু বিধিবাম। তাঁকে নিয়ে যখন ভারতের ক্রিকেটাঙ্গন থেকে শুরু করে বিশ্ব ক্রিকেটে আলোচনার ঝড়, তখনই তিনি চলে গেলেন আড়ালে। শুধু ক্রিকেট নয়, একদম জীবনেরই আড়ালে চলে গেলেন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই পাড়ি জমান ওপারে।
১৯৯২ সালের দূর্ভাগ্যজনক রাত ছিলো, বাড়িতে ফেরার জন্য গাড়িতে চড়েছিলেন ধ্রুব পান্ডব। দেওধর ট্রফিতে দক্ষিণ জোনের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ করে সম্বলপুর থেকে বাড়িতে ফেরার জন্য গাড়ি ভাড়া করেছিলেন তিনি। সে চেতন শর্মার পরামর্শে বড় ম্যাচ খেলার ম্যাচ ফি লেগ গার্ডের মধ্যে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। অর্থ পেয়ে উৎফুল্ল বালক আম্বালা থেকে পাতিয়ালা যাওয়ার প্রথম ক্যাবে উঠে পড়েন। কিন্তু তিনি আর বাড়িতে ফিরতে পারেননি। ক্যাবের ড্রাইভারের অসাবধানতার কারণে আর বাড়িতে ফেরা হয়ে উঠেনি ধ্রুব পান্ডবের।
ভারতের কিংবদন্তী স্পিনার অনিল কুম্বলে তাঁকে শেষ ম্যাচে বল করেছিলেন। ধ্রুব পান্ডব ওপারে পাড়ি জমানোর পর জানান, ‘আমার মনে আছে সে বেশ ভালো ব্যাট করেছে। সে ছিলো একজন প্রতিভাবান উদীয়মান ক্রিকেটার। আর সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে।’
ধ্রুবর পাঞ্জাব দলের সতীর্থ বিক্রম রাঠোর তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। তিনি জানান, ‘সে বেশ পরিনত ছিলেন এবং দায়িত্ব নিতে পারতো। ক্রিকেট মস্তিষ্ক ছিলো বেশ ভালো। ক্রিকেটে তাঁর ভালো ভবিষ্যত ছিলো।’
রাজদ্বীপ কালসি; তিনি নিজেও একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছিলেন। ধ্রুব পান্ডবের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ধ্রুব ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটার হিসেবে বেশ উন্নতি করেছিলো। সে বোলারদের লাইন-লেন্থ অনেক দ্রুত বুঝতে পারতো এবং খেলার জন্য বেশ সময় পেত। এই সময়ে তাঁকে বেশ ভালো বোলারকে সুন্দরভাবে মোকাবিলা করতে দেখেছি।’
ধ্রুব পান্ডব সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে রঞ্জি ট্রফিতে এক হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। তিনি যখন এক হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তখন তাঁর বয়স ছিলো ১৭ বছর ৩৪১ দিন। এতো কম বয়স সত্বেও বেশ ভালো ক্রিকেট বুঝতেন এবং ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে খেলতে পারতেন। দলের জন্য বেশ ভালো করে খেলতেন তিনি।
ধ্রুব পান্ডবের অধিনায়ক এর জন্য বেশ স্বাধীনতা দিতেন। অজয় জাদেজা ভারতের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। অনুর্দ্ধ ১৫ দলে ধ্রুব পান্ডবের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। অজয় জাদেজা জানান, ‘ধ্রুব ছিলেন বেশ মনোযোগী। তার মধ্যে সাহসী একটা বিষয় ছিলো। এতো কম বয়সী কাউকে আমি দেখি নাই যে এতো সাহসী। বেশ ভয়ডরহীন ব্যাট করতো সে। ধ্রুব যে কাউকে বেশ ভালো খেলতে পারতো। তাঁর লড়াই করার সাহস ছিলো সবার জন্য সংক্রামক।’
অন্য ক্রিকেটারদের থেকে দেখে শেখার একটি বিষয় কাজ করে ক্রিকেটে। কিন্তু ধ্রুব পান্ডব কখনো তার সিনিয়রদেরকে তাঁর থেকে দেখে শেখার কোনো সুযোগ দেয়নি। সাবেক ভারতীয় দলের নির্বাচক ভুপিন্দর সিং জানান, ‘ও জানতো যে বড় ক্রিকেটার হতে যাচ্ছে। এর জন্য তিনি নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। তাঁকে কখনো ছাড়িয়ে যাওয়া হয়নি কারো। সে যেভাবে রান করেছিলো এবং বিপক্ষ দলকে ধাক্কা দিচ্ছিলো – সে বিষয়টি আমার বেশ ভালো লেগেছিলো। মাঠের মধ্যে অনেক কিছুই করতো, খুব ভাল ভাবে জানতো কি করে রান করতে হয়।’
মাত্র ১৪ বছর বয়সের আগেই রঞ্জিতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ধ্রুব পান্ডবের। অভিষেক ম্যাচে হিমাচল প্রদেশের বিপক্ষে ৯৪ রানের একটি দূর্দান্ত ইনিংস খেলেন ধ্রুব। এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান বয়সভিত্তিক দলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আর এর ফলেই খুব কম বয়সেই এতো বড় আসরে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ধ্রুব ক্যারিয়ারে মোট ২৩ টি প্রথম শ্রেণির মযাচ খেলেছেন। এই ২৩ ম্যাচে করেছিলেন দুইটি শতক। কিন্তু তাঁর প্রতিভার জন্য বিপক্ষ দলের ক্রিকেটাররা তাঁকে বেশ নজরে রাখতো।
ধ্রুব পান্ডবের বাবা মহেন্দর পান্ডবও ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার। ধ্রুব পান্ডব ছিলেন একজন ওপেনার ব্যাটসম্যান। ধ্রুব ক্যারিয়ারে মোট রান করেছেন ১০৯০ রান। তাঁর ক্যারিয়ার সেরা রান ছিলো ১৭০। তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেছেন সম্বলপুরে দেওধর ট্রফিতে দক্ষিণ জোনের বিপক্ষে। এই ম্যাচে তিনি করেছিলেন ৭৩ রান। ম্যাচ শেষ হবার তিন দিন পরেই ওপারে পাড়ি জমান ধ্রুব পান্ডব।
ধ্রুব পান্ডব মারা যাওয়ার কয়েকদিন ধ্রুব পান্ডবের বাড়ি পাতিয়ালাতে যান চেতন শর্মা। সেখানে গিয়ে ধ্রুবর কিট ব্যাগটি দেখতে চান তিনি। চেতন শর্মা কিট ব্যাগে ধ্রুবর প্যাডের ভিতরে থাকা অর্থ অক্ষত অবস্থাতেই পান।
এক ড্রাইভারের অসচেতনাতেই ক্রিকেট বিশ্ব হারিয়ে ফেলেছে এক প্রতিভাবান ক্রিকেট তারকাকে।