ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ইনিংস

ব্যাটারদের বিচরণের এই ক্রিকেট যুগে ‘অতিমানবীয়’ তকমা দিয়ে দেওয়া হয় যেকোনো ম্যাচ উইনিং ইনিংসকেই। পঞ্চাশ পেরোনো ইনিংস নিয়ে গল্প হয়, শতক নিয়ে তো গল্পের কলেবর হয় আরো বড়।

ব্যাটারদের বিচরণের এই ক্রিকেট যুগে ‘অতিমানবীয়’ তকমা দিয়ে দেওয়া হয় যেকোনো ম্যাচ উইনিং ইনিংসকেই। পঞ্চাশ পেরোনো ইনিংস নিয়ে গল্প হয়, শতক নিয়ে তো গল্পের কলেবর হয় আরো বড়। 

ম্যাক্সওয়েলের এমন ইনিংসকে ঠিক কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়? নিশ্চিতভাবেই ‘অতিমানবীয়’ বিশেষণের ঊর্ধ্বে। ছাপিয়ে যেতে পারে অভিধানের বিশেষণের তালিকাকেও। 

হ্যাঁ। একদম ঠিক তাই। ১২৮ বলে ২০১ রানের ইনিংসটার পাশে কোনো বিশেষণই যেন পূর্ণতা দিতে পারে না। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম ঠিক এমই একটা দ্বিশতকের স্বাক্ষী হলো। যেটা ইতিহাসের দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড না, ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসও না। কিন্তু এক বাক্য সমস্বরে সবাই মেনে নিতে বাধ্য হবে– ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসটা ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা ইনিংস। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরার স্বীকৃতি দিয়ে দিলেও অত্যুক্তি হয়তো হবে না।

কী ছিল না এই ইনিংসের চিত্রনাট্যে। ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়ার পথ হারানোর বিষণ্ন দৃশ্যায়ন। এরপর প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠা সমীকরণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জয়ের ফিনিশিং লাইন ছোঁয়ার রাজকীয় মুহূর্ত। 

আর সেই রাজকীয় মুহূর্তের মুকুটহীন রাজা হয়ে পুনের মাঠে নিজের একটা সাম্রাজ্যের গল্পই লিখেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। সেই পথযাত্রায় আফগান বোলারেদর বাঁধা ছিল, বিদ্রোহ করেছিল নিজের শরীর, অসাড় হয়ে এসেছিল নিজের পা-ও। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এইসব প্রতিকূলতা ডিঙিয়েই তো রাজ্যজয়ের গল্প লিখতে হয়। 

ম্যাক্সওয়েল বাস্তবে কোনো রাজ্যজয় করেননি। তবে বাইশ গজের একট ম্যাচকে যদি একটা রাজ্য সদৃশ ভবা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে সেখানে একটা বিজয়গাঁথা লিখলেন তিনি। 

মানুষ ‘অতিমানব’ হয়ে ওঠে শাব্দিক কারুকার্যে, দারুণ সব অর্জনের কারণে। কিন্তু এ দিন আক্ষরিক অর্থেই অতিমানব হয়ে উঠেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। অবর্ণনীয় ব্যথায় লুটিয়ে পড়েছেন।  ক্র্যাম্পিংয়ে কাতরানো ম্যাক্সওয়েলকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সব শেষ। কিন্তু এক কব্জির জাদুতেই মোহনীয় সব ছক্কা মেরে যে জয়ের পথে চোখ রাখা যায়, তার একটা প্রামাণ্য দৃশ্যের স্বাক্ষী হলো পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। 

ম্যাক্সওয়েল ঠিক কতটা ‘অতিমানব’ হয়ে উঠেছিলেন এ দিন? তাঁর ২০১ রানের ইনিংসটাই হয়তো একটা মানদণ্ড। কজনই বা ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। ম্যাক্সওয়েলকে দিয়ে সংখ্যাটা আট। তবে একটা পরিসংখ্যানে ম্যাক্সওয়েল প্রথম এবং এখন পর্যন্ত ‘একমাত্র’ হয়ে গেলেন। তাঁর হাত দিয়েই আসলো রানতাড়ায় ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।

৯১ রানে যখন ৭ অজি ব্যাটার সাজঘরে তখনও জয়ের জন্য প্রয়োজন ২০১। হারের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা দলটাকে এরপরই টেনে তোলেন ম্যাক্সওয়েল। প্যাট কামিন্সের সাথে গড়ে তোলেন ২০২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি। যেখানে মাত্র ১২ রান এসেছে কামিন্সের ব্যাট থেকে। বাকিটা সামাল দিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল। সেটারও প্রায় অর্ধেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে।

তিন অঙ্ক ছুঁতে ম্যাক্সওয়েল খরচ করেছিলেন ৭৬ বল। এরপর সেই শতক থেকে ১৫০ রানের মাইলফকে পৌঁছেছেন ১০৪ বলে।আর দুর্দান্ত দ্বিশতকের মুহূর্তে পৌঁছাতে তিনি পরে বল খরচ করেছেন মাত্র ২৪ টা। সবমিলিয়ে ১২৮ বলে ডাবল সেঞ্চুরির ফিগার ছোঁয়া হয় ম্যাক্সওয়েলের।

ছক্কা, ছক্কা, চার, ছক্কা—ডাবল সেঞ্চুরির পথে ম্যাক্সওয়েলের খেলা শেষ ৪ টা বলের ফল ছিল এমনই। বাউন্ডারি ছিল ৪ টিতেই, গ্যালারিতে বল আছড়ে পড়েছে ৩ টা। ব্যাট হাতে শুরুতে আফগান বোলারদের উপর পাল্টা আক্রমণের পুনরাবৃত্তি ম্যাক্সওয়েল যেন ঘটালেন অন্তিম লগ্নেও।

শরীর জুড়ে ক্র্যাম্পিংয়ের যে বিদ্রোহ, তারই যেন একটা আগ্রাসী উত্তর। যে আগ্রাসনে আফগানরা হয়ে গিয়েছিল নীরব দর্শক। আর গ্যালারি জুড়ে ছিল অবিশ্বাস্য দর্শনে উচ্ছ্বসিত উল্লাস।

ওয়ানডেতে ছয় বা এর নিচে নেমে খেলা সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর এত দিন ছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কপিল দেবের ঐ ১৭৫ রানের ইনিংস। ম্যাক্সওয়েল সেটিকে ছাড়িয়ে তো গেছেনই, মুজিবকে মারা সেই ছক্কায় ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ইনিংসের মালিক বনেও গিয়েছেন নিশ্চিতভাবেই।

তবে ম্যাক্সওয়েল কতটা দুর্দান্ত ছিলেন, তার ইনিংস কতটা চোখের জন্য শান্তির আর উচ্ছ্বাসের ছিল, তার প্রকাশভঙ্গি যেন সব কিছুতেই সীমাবদ্ধতার জালে আটকা থাকবে। সেই সীমাবদ্ধতা নাহয় থাকুক। তবে ‘চিরায়ত’ ইনিংসের রূপায়ণ হিসেবে সন্দেহাতীতভাবেই ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংস মানুষের মনে গেঁথে থাকবে অনেকদিন।

হয়তো সেটা যুগ পেরিয়ে শত বর্ষ পরেও। ক্রিকেটের আর্কাইভে এই ইনিংসের চিত্রায়ণ দেখে হয়তো তখনকার ক্রিকেটমোদীদের চোখ বিস্ময়ে ভাসবে। একটুও অত্যুক্তি হবে না এই ভাবনায়- এমন ইনিংসও খেলা যায়!

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link