নিজ গ্রাম আম্বালাঙ্গদায় টিভি সেটের সামনে বসে আছেন ১৫ বছর বয়সী দিনেশ চান্দিমাল। নিজের দলকে ১০০০০ কিলোমিটার দূরে তাসমান নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তুলোধুনো হতে দেখছিলেন। আগেরদিনই বাক্সপেটরা আর যাবতীয় ক্রিকেট সরঞ্জামাদি গুছিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ডাক পড়েছিলো শ্রীলঙ্কা অনুর্ধ্ব ১৫ দলের ট্রায়ালে। তার আজীবন লালিত স্বপ্নের পথে যা ছিলো একদম শুরুর দিকের একটা পদক্ষেপ।
সেদিন ছিলো ‘পয়া’ বা কৃষ্ণপক্ষের শেষদিন। তার মা ঘরদোর সাফ করছিলেন। ময়লা ফেলতে বাইরে বের হলেন। পরমুহূর্তে চান্দিমাল একটা চিৎকারের শব্দ শুনলেন, ‘আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম সাপ খোপ দেখেছেন হয়তো’, চান্দিমাল বলেন। কিন্তু আদতে তা ছিলো না, ছিল সুনামি, চান্দিমালের ভাষায় যা ‘শয়তান’।
আম্বালাঙ্গদা ছিলো সে সুনামির সবচাইতে বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। প্রলয়ঙ্করী সে সুনামির বিশাল জলরাশি যখন উপকুলে আঘাত হেনে সমুদ্রে ফিরে যাচ্ছিলো তখন পেছনে রেখে যাচ্ছিলো হাজারো বাস্তুহারা, আশাহত, ক্ষুধার্ত, ভয়ার্ত মানুষ। মৃতের সংখ্যাও নেহায়েৎ কম ছিলো না।
‘আমরা সেখানে গেলাম এবং দেখলাম, আমাদের গ্রামের এক চাচা এসে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পালাও!’ তারপর আমরা সম্ভবত ২০০-৩০০ মিটার দৌড়ে গিয়ে একটা পাহাড়ের উপরে উঠলাম। এবং সেখান থেকে দেখলামআমাদের ঘরবাড়িগুলো ফেনার মতো ভেসে যাচ্ছে।’
‘সুনামি শয়তানের মুর্তিধারণ করে এসছিলো’, সেদিনের ভয়াবহতার কথা মনে করে ব্যথাতুর কণ্ঠে বারবার একথাটাই বলছিলেন চান্দিমাল। সেদিনের আগ পর্যন্ত তিনি জানতেনও না সুনামি কি! সুনামি উপকুলে ছোবল মেরে বিধ্বস্ত এক জনপদ আর অনেক পরিচিত মুখের মৃতদেহরেখে যাচ্ছিলো। পাহাড়ের উপর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিচ্ছুটি করারছিলো না ছোট্ট চান্দিমালের।
সুনামির পরে চান্দিমাল বেরিয়েছিলেন তারক্রিকেট ব্যাগটা খুঁজতে। যা নিয়ে কলম্বোয় যাবার কথা ছিলো তার। খুঁজেওপেয়েছিলেন প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে, কিন্তু সুনামির ছোবলে সেগুলো আর কোনোকাজে লাগার মতো অবস্থায় ছিলো না।
সে সুনামি তার এবং তার পরিবারের মানসপটে এক গভীর দাগ কেটে গিয়েছিলো, যা সহজে মুছবার ছিলোনা, ‘সে স্মৃতিএখনো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়, এতোটাই যে, সেদিনের পরে আমরা আর সমুদ্রে গিয়েছিলাম মোটে দু’বার।’
২০০৪ সালের বক্সিং ডেতে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা চান্দিমালকে আরো শক্ত হতে সাহায্য করেছিলো। তার পরিবার তখন ছিলো বাস্তুহারা, পোশাকহীন, আর ক্ষুধার্ত। আর এ ব্যাপারটা তাঁকে তার লক্ষ্যে আরো মনোযোগী করে তোলে, ‘সুনামিতে আমরা আমাদের সবকিছু হারিয়েছিলাম। শয়তানটা সবকিছুতছনছ করে রেখে গিয়েছিলো। এটা আসলে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখতে, ভালো ক্রিকেটার হতে। সুনামির পরে এটাই ছিলো আমার শক্তি। এর আগে ভাবতাম আমাকে ক্রিকেটার হতে হবে, কিন্তু সুনামির পরে পুরো ব্যাপারটাই পাল্টে গেলো, আমি লক্ষ্য স্থির করেছিলাম- আমাকে এটা হতেই হবে।’
তো, যখনই সুযোগ এলো তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাকে পরের স্তরে নিয়ে যাবার, তিনি তা লুফে নিলেন। তিনি তার কলেজ ধর্মশোকা কলেজের গুরুত্বপুর্ণ খেলোয়াড়ছিলেন, ব্যাটিং আর কিপিং দুইদিক থেকেই, ‘আমার কিপিং তখন দারুণ ছিলো, ক্যাচগুলো ধরতে দারুণ ডাইভ দিতাম। কোনো ভুল হতোনা।’, হাসতে হাসতে বলেন চান্দিমাল।
আনন্দ কলেজের বিপক্ষে যখন দল মাত্র ১২০ রানে গুটিয়ে গিয়েছিলো সে ইনিংসে তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি লড়াই করেছেন। ব্যাট হাতে সেদিন খেলেছিলেন ৭৭ রানের ইনিংস। আনন্দ কলেজের কোচ উদয়ানন্দপেরেরা তার বাসায় গিয়ে বুঝান আটকে কলম্বো পাঠাতে।
‘বাবা মা চাইছিলো আমাকে কলম্বো পাঠাতে, কিন্তু আমি চাইছিলাম না। বাবা বলেন, ‘যদি তুমি কলম্বোযাও তাহলে তুমি আর কিছু না হোক, অন্তত ভালো চাকরি পাবে।’ পরিবারের কথাভেবে পরে আমি সায় দেই।’
আনন্দ কলেজ পুরোপুরি তার কম্ফোর্ট জোনের বাইরেছিলো। পরিবারের অভাব, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা, খাবারে অরুচি তারজীবন দুর্বিসহ করে তুলছিলো। তারপরও তিনি তা বাসায় জানান নি।
‘কলম্বোয় কাউকে চিনতাম না, হোস্টেলে থাকা, সেখানের খাবার খাওয়া সহজ ছিল না কিছুই। কখনো বাবা মা জিজ্ঞেস করতেন সবকিছু ঠিক আছে কিনা, কখনো কখনো সেখানকার খাবার মুখে রোচতো না। সকালের খাবার না খেয়ে থাকতাম প্রায়ই কারণ সেটা তেমন ভালো ছিল না। তারপরও বাসায় কিছুই জানাতাম না। বলতাম সবকিছু ঠিক আছে।’
তবে সে সময়টা যে কেবল দুঃখেই কেটেছে চান্দিমালের তা কিন্তু নয়। কলেজের সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে তার। ভালো ব্যবহার দিয়ে তিনি কলেজে খুব সহসাই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন।
সেখানের কাজের লোকদের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। তারা খুব সাহায্য করতেন আমাকে। কখনো আমার প্র্যাকটিস সেশন থাকলে তারা আমার খাবার রান্না করে রাখতেন, হোস্টেলে যখন ফিরতাম তখন তারা আমার রুমে খাবার নিয়ে আসতেন। তারা আমার খুব যত্নআত্তি করতেন। ভালো মানুষদের সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগতো। আমার ধারণা একারণেই তারা আমাকে এতো ভালোবাসতেন।
প্রাণ বাঁচানোর লড়াই থেকে জাতীয় দলে আসা, তারপর জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা, এ পর্যন্ত পথটা এতো মসৃণ ছিল না চান্দিমালের, ‘শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হওয়াটা সম্মানের, একই সাথে গৌরবেরও। খুব প্রতিকূল পরিবেশে ছোট থেকে বড় হয়েছি আমি। পাশাপাশি ভালো সময়ও পার করেছি অনেক। অধিনায়ক এবং একজন খেলোয়াড় হিসেবে আমি দলের খেলোয়াড়দেরকে ভালো কিছু দিতে চাই। আমি তাদেরকে আমার ভাইয়ের মতো যত্ন নিতে চাই। বাইরের কোনো কিছু যদি খেলায় বাগড়া দিতে আসে, দলপতি হিসেবে আমি তা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। তরুণদেরকে খেলার স্বাধীনতাটা দিতে চাই।’
বলছিলেন, ‘অধিনায়ক হিসেবে আমি চাই দলের দায়িত্বশীল খেলোয়াড়টা হতে, কিংবা হারের সব দায় মাথা পেতে নিতে। খেলোয়াড়দের উপর কোনোপ্রকার চাপ দিতে আমি রাজি নই। অধিনায়ক হিসেবে আমি এইই চাই। কারণ আমি জানি খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটা কেমন। অধিনায়ক হবার পরপরই আমি তাদের বলেছি ‘আমি প্রথমেই যে বিষয়টা চাই সেটা হচ্ছে একটা, তারপর অ্যাটিচিউড, দলের প্রতি নিবেদন, নিয়মানুবর্তিতা’ আমি দলের সবার সাথে এসবই আলোচনা করি সবসময়।’
পরিবারে যেমন পরিবারের চাওয়াটাই প্রাধান্য দেন, দলেও ঠিক তাই। ২০১৩ সালে প্রথমবার যখন অধিনায়ক হন তখনো তাই করেছিলেন, ‘সত্যি বলতে কি, আগেরবার প্রচণ্ড চাপে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর এর থেকে শিক্ষা নিয়েছি। কীভাবে খেলোয়াড়দের বুঝতে হয়, তাদের সেরাটা বের করে আনতে হয়। এখন আমি আরো চাপ নিতে শিখেছি, খেলোয়াড়দের আরো স্বাধীনতা দিতে শিখেছি। ২০১৩ এ সময়টা খুব কঠিন ছিলো। কারণ দলে তখন তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেল ছিলো। কিন্তু আমার মনে হয় আমি ভালো সামলেছিলাম দলকে। খেলোয়াড় হিসেবে পারফর্ম করতে না পারার কারণ হিসেবে আমি বলবো ৬ এ ব্যাট করার কথা। টি টোয়েন্টিতে ৬ এ ব্যাট করলে ২-৩ ওভারের মতো বাকি থাকে। বড় রান করা সম্ভব হয়না। যেহেতু অধিনায়ক আমি ছিলাম, চাইলেই ওপেন কিংবা ৩ এ ব্যাট করতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি কারণ তা দলের ভারসাম্য নষ্ট করতো। দলে তখন কুশল পেরেরা ছিলো। দারুণ খেলছিলো। লেফট-রাইট কম্বিনেশনের কথা ভেবে আমি তাকে উপরে ব্যাট করতে বললাম। তারপর মহেলা, সাঙ্গাকারা, এঞ্জেলো। অভিজ্ঞদেরকে প্রথম ১০-১৫ ওভারে খেলাতে চাইছিলাম আমি। তারপর ৬ এ আমি। নিজের কথা ভাবিনি, দলের চাহিদাই আমার কাছে আগে ছিলো, কীভাবে ভালো খেলা যায়, বিশ্বকাপটা জেতা যায়। এইই আমার প্রথম ক্যাপ্টেন্সির অভিজ্ঞতা। খেলায় হারলে কষ্ট হবেই, প্রশ্ন থাকবেই। কিন্তু যখন আপনি জিততে থাকবেন তখন জয়টা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।’
‘এই সামাজিক মাধ্যম কিংবা ইন্টারনেটের যুগে যখন আপনি আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় খেলছেন তখন মানসিক দৃঢ়তা খুবই প্রয়োজন। কেউ আপনাকে পছন্দ করছেনা, সোশাল মিডিয়ায় আপনাকে নিয়ে লিখে দিলো, এসব থেকে দূরে থেকে, নিজের খেলাটা ঠিক রাখতে এটা খুবই জরুরি।’
২০০৪ এ মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, দেখেছিলেন নিজের মাথা গোঁজার ঠাইকে তুলোর মতো উড়ে যেতে। তারপর তিনি তার পরিবারের জন্য লড়াই শুরু করেন, আর তিনি তা করেছিলেন ক্রিকেটের মাধ্যেমে। এখনো তিনি যখন বাবা মায়ের সাথে কথা বলেন, তখন তারা তাকে তাদের হারানো বাসস্থান ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রাপ্য কৃতিত্ব দেন, ‘এখন আমরা ভালো অবস্থানে আছি, এটা তোমার কারণেই সম্ভব হয়েছে। আমি বলি, না, শুধু আমার কারণে নয়, আমরা সবাই আমাদের কঠোর পরিশ্রমগুলো একজোট করতে পেরেছিলাম বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।’
শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন। ক্যারিয়ারের যে কক্ষপথে ছিলেন – সেটাও হারিয়েছেন। যে প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন কাজে লাগাতে পেরেছেন সামান্যই। দলে জায়গাটাও স্থায়ী নয়। তারপরও দিনেশ চান্দিমাল লড়াই ছাড়াই হাল ছাড়তে শেখেননি। ওটা তাঁর মধ্যেই নেই।