ইংলিশ কন্ডিশন মানেই এই মেঘ তো, এই বৃষ্টি। তবে ন্যাটিংহামের ট্রেন্ট ব্রিজে সেদিন ছিলো রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ। বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাও ছিলো না। ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তানের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ। আকাশে কালো মেঘ না এলেও দর্শকপূর্ণ ট্রেন্ট ব্রিজে সেদিন পাকিস্তানের সামনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিলো ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা। ট্রেন্ট ব্রিজ সেদিন সাক্ষী হয় এক ঐতিহাসিক ম্যাচের!
৩০ আগস্ট, ২০১৬। সিরিজে ২-০ তে এগিয়ে থাকা ইংলিশরা টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। জনপ্রিয় ক্রিকেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফো বলছিলো শেষ ওয়ানডেতে জিততে ইংল্যান্ডকে অবশ্যই ২৪০ রানের মধ্যে আটকে দিতে হবে পাকিস্তানের। অবশ্য ট্রেন্ট ব্রিজের ওই ফ্লাট উইকেটে তাঁদের প্রত্যাশাও ছিলো প্রথম ইনিংসে ৩০০ বা তারও বেশি রান করবে ইংলিশরা।
তবে সকলের প্রত্যাশা ছাপিয়ে সেদিন ট্রেন্ট ব্রিজে ভয়ংকর তাণ্ড চালিয়েছিলো ইংলিশরা। ঝড়ের শুরুটা করেছিলেন ওপেনার অ্যালেক্স হেলস। শুরুটা অবশ্য মোটেও খারাপ হয়নি পাকিস্তানের জন্য। দলীয় ৩৩ রানে জেসন রয়কে তুলে নেন হাসান আলী। দ্বিতীয় উইকেটে হেলসের সাথে জুটি গড়েন জো রুট। পরের গল্পটা একদম নিজেদের মতো করেই সাজান দু’জনে। দু’জনেই দ্রুততার সাথে রান তুলতে থাকলেন। রুট কিছুটা ধৈর্য্য দেখালেও হেলস যেন ছুটছিলেন অদম্য গতিতে!
মোহাম্মদ আমির কিংবা হাসান আলীদের কোনো পাত্তাই দিচ্ছিলেন না দু’জনে। দ্রুতই গড়ে ফেলেন পঞ্চাশোর্ধ জুটি। দ্বিতীয় উইকেটে দু’জনের কাউকে আটকাতে ব্যর্থ হচ্ছিলো পাকিস্তানি বোলাররা। ওভার যতোই এগোচ্ছিলো রানের চাকা আরো সচল করতে লাগলেন দুই ব্যাটসম্যান। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ফিফটি তুলে নেন হেলস। এর কিছুক্ষণ বাদেই দু’জনে মিলে গড়েন সেঞ্চুরির জুটি। ধীরে ধীরে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠেন হেলস। হেলসের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে মুখ থুঁবড়ে পড়ে পাকিস্তানের বোলিং লাইন আপ।
এরপর দুর্দান্ত ব্যাটিং করে একপ্রান্তে ৮৩ বলে সেঞ্চুরি তুলে নেন হেলস। রুট তখন অপরাজিত ৪৪ রানে। দলীয় রান তখন ২৫ ওভার শেষে ১ উইকেটে ১৬৬! তখনো মনে হচ্ছিলো ৩৫০ এর আশেপাশেই রান করবে ইংলিশরা। সেঞ্চুরির পর ব্যাট হাতে আরো ভয়ংকর রুপ ধারণ করেন হেলস।
একপ্রান্তে সমানে বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই ফিফটি তুলে নেন রুট। একপ্রান্তে রুট যোগ্য সমর্থন দিচ্ছিলেন, আরেক প্রান্তে তান্ডব চালাচ্ছিলেন হেলস। ১১০ বলে ব্যক্তিগত দেড়শো পূর্ণ করেন হেলস! সেঞ্চুরির পর মাত্র ২৭ বলে বাকি ৫০ পূর্ণ করেন তিনি! সেই সাথে দু’জনে মিলে পূর্ণ করেন ডাবল সেঞ্চুরির জুটি!
৩৩তম ওভার শেষে দলীয় রান তখন ১ উইকেটে ২৩৮! ইতোমধ্যেই দু’জনে জুটি গড়েছেন ২০৫ রানের। পাকিস্তান অধিনায়ক আজহার আলীর চোখে মুখে যেনো চিন্তার কালো ছাপ। তাঁর কোনো অস্ত্রই এই জুটি দমাতে সফল হচ্ছিলেন না। ওয়াহাব রিয়াজ, মোহাম্মদ আমিররাও খাচ্ছিলেন বেদম মার! অপরদিকে, ইংলিশরা এগোচ্ছিলো পাহাড়সম সংগ্রহের দিকে।
পরের তিন ওভারে ৩৪ রান নেন দু’জনে! ৩৭ তম ওভারে দলের একমাত্র সফল বোলার হাসান আলীকে বোলিংয়ে আনেন অধিনায়ক। আর ওই ওভারেই ব্যাকফুটে থাকা দলকে আবারো উইকেট এনে দেন হাসান। ওভারের পঞ্চম বলে চার মেরে রবিন সিংয়ের রেকর্ড গুড়িয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডে ইতিহাসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ (১৭১) রানে পৌঁছে যান হেলস।
এরপর ওভারের শেষ বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে বিদায় নেন তিনি। দলীয় ২৮১ রানে পড়ে দ্বিতীয় উইকেট। মনে হচ্ছিলো রোহিত শর্মার করা ২৬৪ রানের রেকর্ডও ভেঙে দিবেন তিনি। তবে ডাবল সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ২৯ রান দূরে থাকতে বিদায় নেন হেলস।
পরের ওভারেই মোহাম্মদ নওয়াজের বলে সরফরাজকে ক্যাচ দিয়ে ব্যক্তিগত ৮৫ রানেই আউট হন রুট। মাত্র ১৫ রানের জন্য দেখা পাননি সেঞ্চুরির! ২৮৩ রানে তখন ইংলিশদের ৩ উইকেট। পর পর দুই ওভারে দুই উইকেট তুলে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলেন পাকিস্তানি বোলাররা। অবশ্য সেটি খুব বেশি সময় স্থায়ীও হয়নি! ইনিংসের বাকি ১২ ওভার। একদিকে ম্যাচে কামব্যাকের স্বপ্ন দেখছিলো পাকিস্তান। অপরদিকে, হেলস ঝড়ের পর আরেক কাব্য রচনায় ক্রিজে তখন জস বাটলার ও ইয়ন মরগ্যান। ইনিংসের বাকি অংশটায় ব্যাট হাতে ঝড় তুলেন দু’জনে মিলেই!
ঝড়ের শুরুটা নওয়াজকে এক ওভারে বাটলারের মারা তিন ছক্কা দিয়ে! ম্যাচে কিছুটা আশার আলো দেখা পাকিস্তানকে ছিটকে দেয় বাটলারের ঝড়ো ব্যাটিং। ৪২ তম ওভারে শোয়েব মালিককে এক ওভারে চার ছক্কা মেরে মাত্র ২২ বলে ব্যক্তিগত ফিফটি তুলে নেন বাটলার!
ইংল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডে ইতিহাসে দ্রুততম ফিফটির মালিক বনে যান তিনি। অবশ্য ট্রেন্ট ব্রিজের মাটিতে মরগ্যান ঝড় তখনো শুরু হয়নি! এর মাঝেই ব্যক্তিগত ১৪ রানে মরগ্যানের ক্যাচ মিস করেন ইয়াসির শাহ। এরপরই শুরু হয় তাঁর ব্যাটিং তান্ডব! ৪৪ ওভারে ইংল্যান্ডের রান ছিলো ৩ উইকেটে ৩৬৫! দু’জনে মিলে ৬ ওভারে জুড়ে দেন ৮২ রান!
মোহাম্মদ আমির কিংবা ওয়াহাব রিয়াজ কাউকেই সেদিন ছাড় দেননি বাটলার-মরগ্যানরা। ৪৭ তম ওভারেই দলীয় রান পৌঁছে যায় ৪০০ এর কোটায়! পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ইতিহাসের কোনো দলের প্রথম চারশো। ৪৮ তম ওভারের প্রথম বলে ওয়াহাব রিয়াজকে ছক্কা মেরে নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের দলীয় সর্বোচ্চ ৪০৮ রান টপকে যায় ইংলিশরা। ওয়াহাব রিয়াজের স্পেলের শেষ ওভারে ২৪ রান নেন দু’জনে মিলে! ২৪ বলে ব্যক্তিগত ফিফটি তুলে নেন মরগ্যান। সেই সাথে ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বোলিংয়ের তালিকায় নাম লেখান ওয়াহাব রিয়াজ!
১০ ওভারে ১১ ইকোনমিতে ১১০ রান দেন ওয়াহাব! ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বোলিং লিস্টের দ্বিতীয়তে আছেন তিনি। ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অজি পেসার মার্ক লুইস ১০ ওভারে ১১৩ রান দিয়ে এই তালিকায় সবার উপরে অবস্থান করছেন!
৪৮ ওভারে দলের রান ৩ উইকেটে ৪২৯! ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান টপকাতে দরকার ২ ওভারে আর মাত্র ১৫ রান। ৪৯ তম ওভারে আমির ৯ রান দিলে স্কোর দাঁড়ায় ৪৩৮! শেষ ওভারে বিশ্ব রেকর্ড গড়তে দরকার মাত্র ৬ রান। হাসান আলীর দুর্দান্ত বোলিংয়ে প্রথম ৫ বল থেকে নেন মাত্র ২ রান! রেকর্ড গড়তে শেষ বলে দরকার ছিলো ৪ রান। শেষ বলে চার মেরে ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দলীয় স্কোরে ইংল্যান্ডের নাম লেখান বাটলার!
২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ৪৪৩ রান করেছিলো শ্রীলঙ্কা। ১০ বছর বাদে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয় ইংলিশরা। বাটলারের অপরাজিত ৫১ বলে ৯০ আর মরগ্যানের ২৭ বলে ৫৭ রানে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৩ উইকেটে ৪৪৪ রান সংগ্রহ করে ইংলিশরা। পাকিস্তানের পক্ষে ১০ ওভারে ৭২ রানে ২ উইকেট নেন হাসান আলী।
সামনে পাহাড়সম রান! টপকানো অসম্ভবই প্রায়। তবু ওপেনিংয়ে একটা ফ্লাইং স্টার্ট দেন পাকিস্তানি ওপেনার শারজিল খান। একদিকে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দ্রুত রান তুলছিলেন শারজিল, আরেক দিকে থিতু হতে পারছিলেননা বাকিরা। দলীয় ২১ রানে ব্যক্তিগত ৮ রান করে বিদায় নেন সামি আসলাম। এরপর দলীয় ৫০ রান না পেরোতেই আউট অধিনায়ক আজহার আলী। একপ্রান্তে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে ফিফটি তুলে নেন শারজিল। ১০ ওভারের আগেই দলের রান ৮৩! দলীয় ৮৩ রানে ব্যক্তিগত ৩০ বলে ৫৮ রানে বিদায় নেন শারজিল। পাকিস্তানের প্রথম তিন উইকেটই শিকার করেন ক্রিস ওকস।
এরপর আসা যাওয়ার মিছিলে ছিলেন বাবর আজম, শোয়েব মালিকরাও। দলীয় ১০৮ রানেই দলের হাফ ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে! ম্যাচে বড় পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান। ষষ্ঠ উইকেটে নওয়াজকে সাথে নিয়ে ৪৭ রানের জুটি গড়েন সরফরাজ। দলীয় ১৫৫ রানে ব্যক্তিগত ৩৮ রানে বিদায় নেন সরফরাজও! এরপর হাসান আলী দ্রুত ফিরলে দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ১৬৪ রান। সেখান থেকে দলীয় ১৮০ রানে ব্যক্তিগত ৩৪ রানে ফেরেন নওয়াজও!
৩১ ওভারে দলের অবস্থা তখন ৮ উইকেটে ১৮০! ১৯ ওভারে ২ উইকেটে প্রয়োজন ২৬৫ রান। তখনো ওয়ানডে ইতিহাসে রানের দিক থেকে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের (চতুর্থ) সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান। নবম উইকেটে ইয়াসির শাহের সাথে ১৯ রানের জুটির পথে ওয়াহাব রিয়াজ ফেরেন ১৪ রানে। ১৯৯ রানে তখন ৯ উইকেট। শেষ উইকেট পড়াটা তখন সময়ের ব্যাপার। শেষ উইকেটে ইয়াসির শাহের সাথে জুটি গড়েন মোহাম্মদ আমির। ম্যাচের শুরুটা যেমন সবার প্রত্যাশা ছাপিয়ে যায়, তেমনি শেষটাও ছিলো অবিশ্বাস্য আর অসাধারণ!
হটাৎ ট্রেন্ট ব্রিজে শুরু হলো আমির ঝড়। না বল হাতে নয়; তান্ডব চালালেন ব্যাটসম্যান আমির! ২৮ বলে ৫ চার আর ২ ছক্কায় ৫৮ রানের এক ঝড়ো ইনিংস উপহার দেন আমির! আদিল রশিদকে তিন বলে তিন ছক্কা হাঁকানোর পথে মাত্র ২২ বলে রেকর্ডগড়া ফিফটি করেন আমির। পাকিস্তানের হয়ে ওয়ানডেতে দ্রুততম ফিফটির মালিক হন তিনি। ব্যক্তিগত ৫৮ রানে ক্রিস ওকসের বলে আমির আউট হলে ২৭৫ রানে থামে পাকিস্তানের ইনিংস। ফ্লাড লাইটের আলোয় ম্যাচের শেষ ঝলকটা দেখান আমির!
পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫৮ রান করেন আমির। অপরদিকে, ইংলিশদের পক্ষে ক্রিস ওকস ৪১ রানের বিনিময়ে শিকার করেন ৪ উইকেট। ইংলিশরা জয় পায় ১৬৯ রানের বিশাল ব্যবধানে! সেই সাথে ৩-০ তে হোয়াইটওয়াশ হয় পাকিস্তান।
সেদিন ট্রেন্ট ব্রিজে ক্রিকেট দুনিয়া সাক্ষী হয় এক ঐতিহাসিক ম্যাচের! চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে ওয়ানডে ম্যাচেও টি-টোয়েন্টির মতো ব্যাটিং উপভোগ করে ক্রিকেট ভক্তরা।