একটা জয়ের জন্য আপনি কতদিন অপেক্ষা করতে পারেন? দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকতে পারেন, অপেক্ষা করতে পারেন কতদিনে আসবে সে জয়, গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে প্রতিপক্ষের ঘর। একসময় যে ঘর ছিল তাদের একান্তই নিজস্ব, সে ঘরে নগর প্রতিপক্ষের উল্লাস যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে। ২২ বছর অপেক্ষার পর অ্যানফিল্ডে নীল ঝাণ্ডা উড়োতে সক্ষম হলো ‘টফি’সরা।
এক শহরের দুই বড় ক্লাব, এই ম্যাচের পেছনে থাকে না কোনো বড় রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক রেষারেষি। তবু এই ডার্বির উত্তেজনা, জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে যায় সকলকিছুকে। কেনই বা হবে না। স্নায়ুক্ষয়ী যুদ্ধ জিতে যদি আপনাকে প্রতিপক্ষ খুঁজে পেতে সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিতে হয় তবে সেই আনন্দ কী আর একই রকম থাকে? তার চেয়ে ম্যাচ জিতে পাশের বাড়ির মানুষটাকে খোঁচানোর মতন আনন্দ আর কীসে? ম্যাচ জেতা মানেই বুক ফুলিয়ে শহরে ঘুরে বেড়ানোর ফ্রি লাইসেন্স। ‘ডার্বি’ মানে পাড়ায় পাড়ায় শত্রুতা। এক ঘরেই কেউ হয়তো লাল, কেউ আবার নীল। ডার্বি মানে নিখাদ প্রতিদ্বন্দ্বীতা, যার শেষটা সুন্দর।
মার্সিসাইডের লাল-নীল রাউভালরির গল্প আরো জটিল। রোমা-লাৎসিও, চেলসি-আর্সেনালরা মুখোমুখি হয় শহরের দুই প্রান্তের দুই স্টেডিয়ামে। আবার এসি মিলান-ইন্টার মিলানের ম্যাচে পুরো শহর একত্রিত হয় সান সিরোতে। কিন্তু এভারটন-লিভারপুলের ইতিহাস তাঁদের জন্ম থেকেই তৈরি করেছে একে অপরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।
মার্সিসাইডে প্রথম ক্লাব হিসেবে জন্ম হয়েছিল এভারটনের। ১৮৭৮ থেকে ভালোই চলছিল ইংল্যান্ডের অন্যতম ব্যস্ততম শহরের ক্লাবটি। লিভারপুল মূলত ছিল বন্দর নগরী, রেনেসাঁ চলাকালীন পুরো সময়ে ইংল্যান্ডের সব জাহাজ এসে ভিড়তো এখানে। আর সেখানেই কর্মীদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল এভারটন ফুটবল ক্লাব। তাদের হোম গ্রাউন্ডও ছিল জন্মের পর থেকে অ্যানফিল্ড। কিন্তু সেই অ্যানফিল্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ১৮৯২ সালে। যখন অ্যানফিল্ডের তৎকালীন মালিক জন হোল্ডিং বেঁকে বসেন। এভারটন বোর্ডের সাথে বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে সমস্যার ফলে সেখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেয় এভারটন। বসতি গড়ে গুডিনসন পার্কে। আর সেখানেই এভারটনের ফেলে রাখা মাঠে জন হোল্ডিং গড়ে তুলেন লিভারপুল ফুটবল ক্লাব।
এক কথায় বললে এভারটনের ধ্বংসাবশেষ থেকে গড়ে উঠেছে লিভারপুল। অথচ এখন দুই দলের দিকে তাকালে এই কথা কেউ স্বীকার করবে? সত্তরের দশক থেকে ইংলিশ ফুটবলে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠা লিভারপুক্লের সামনে এভারটন এখন চুনোপুঁটি। সর্বোচ্চ ইংলিশ লিগ, সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়নস লিগ, লিভারপুলের জয়জয়কার; এভারটন নেই কোনো খবরে। এমনকি নিজেদের পুরোনো মাঠেও কীনা জয় তুলে আনতে পারেনি ২২ বছরে। এর থেকে লজ্জার গল্প আর কী হতে পারে ‘দ্যা ব্ল্যাক ওয়াচ’দের কাছে?
এভারটন সমর্থকদের কাছে অবশিষ্ট কিছুই ছিল না। অ্যানফিল্ডে জয় দূরে থাক, লিভারপুলের বিপক্ষে জিততেই ভুলে গিয়েছিল তারা। এমনকি স্বরণকালের সবচেয়ে বাজে সময়টা যখন কাটছহিল ‘অল রেডস’রা, তখনও ‘মার্সিসাইড ডার্বি’ হারেনি তারা। সেই ২০১০ সালে একবার গুডিনসন পার্কে টিম কাহিল আর আর্টেটার গোলে। সেই স্মৃতি মনে ধরেই গত ১১ বছর বেঁচে ছিল তারা। লিগ ম্যাচে অ্যানফিল্ডে জয় তো এই শতাব্দীতে আসেনি। সেই ১৯৯৯ সালে শেষবার। সেদিন কেভিন ক্যাম্পবেলের গোলে মার্সিসাইড হয়েছিল নীল। সেবার অ্যানফিল্ডে উৎসবের রং হয়েছিল নীল। লাল কার্ড দেখেছিলেন লিভারপুল কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ড ও গোলরক্ষক স্যান্ডর ওয়েস্টারভেল্ড।
কোচ কার্লো আনচেলত্তি আবার এসব ব্যাপারে খুবই সিদ্ধহস্ত। ক্যারিয়ারে যেখানেই গিয়েছেন আক্ষেপ মিটিয়েছেন। এসি মিলান, পিএসজি, রিয়াল মাদ্রিদ; বড় ট্রফির আক্ষেপ থাকলে সেখানেই আশার আলো জ্বেলেছেন। কখনও মুখে সিগার নিয়ে, কখনও হাতে কফি নিয়ে। আনচেলত্তির জন্য এসব তেমন বড় বিষয় নয়। তার জন্য মূখ্য ২২ বছরের অপ্রাপ্তি আর যন্ত্রণার শেষ টানা।
সেটাই টানলেন। ৩০ বছরের অপেক্ষা মিটিয়ে লিভারপুল যখন আকাশে, সমর্থকেরা যখন নিজের দলকে সর্বেসর্বা ভেবে উড়ে বেড়াচ্ছে, তখন নগর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই তাদের টেনে নামালেন কার্লো আনচেলত্তি। ২২ বছর পর অ্যানফিল্ডকে রাঙালেন নীলে। ‘অল রেড’দের হোম হয়ে উঠল বেদনাসিক্ত নীলাভ! ক্যাম্পবেলের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করলেন রিচার্লিসন আর সিগুর্ডসন।
সত্যি বলতে লিভারপুলেরও তেমন কিছু করার ছিল না। জোড়াতালি দিয়ে হয়তো ছাতার ছোট্ট একটা ফুটো ভরাট করা যায়, বাঁধ নয়। নিজেদের মাঠে টানা চার ম্যাচে হার যেন সেটারই প্রমাণ। জোড়াতালি ডিফেন্সের প্রথম ফুটো আবিষ্কৃত হয়ে যায় ম্যাচের তিন মিনিটেই। সাবেক রিয়াল মিডফিল্ডফার হামেস রদ্রিগেজের ডিফেন্সচেড়া পাসই লিখে দেয় ম্যাচের চিত্রনাট্য। আর সেখান থেকেই দলকে এগিয়ে নেন রিচার্লিসন। গত ২২ বছরে প্রথম মার্সিসাইড ডার্বিতে লিড পেয়েছিল এভারটন। শেষ যেবার এমন হয়েছিল সেবার জয় নিয়েই মাঠে ছেড়েছিল এভারটন। এবারও যেন তেমনটাই লেখা ছিল।
ভাগ্য লিভারপুলকে সাহায্য করেনি বিন্দুমাত্র। চোটে জর্জর লিভারপুলের দুর্ভাগ্য হয়ে আসল আবারও ইঞ্জুরি। এবার অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন। নিয়মিত মিডফিল্ডারকে জোড়াতালি দিয়ে ডীফেন্স সাজিয়েছিলেন ক্লপ। লাভের লাভ হয়নি কিছুই। চোট পেয়ে মাঠ ছাড়লে সে জায়গায় আসেন ন্যাট ফিলিপস। ওজান কাবাক আর ন্যাট ফিলিপস ভালোই সামলাচ্ছিলেন, কিন্তু ডিফেন্সের সাথে সাথে আক্রমণেরও এমন শোচনীয় অবস্থা হবে এমনটা কেউই ভাবেননি। সালাহ-মানে-ফিরমিনহো ছিলেন সম্পূর্ণ নিষ্প্রভ।
আর ম্যাচের শেষ দিকে বিতর্কিত এক পেনাল্টিতে নিজেদের ব্যবধান বাড়ায় এভারটন। দুর্দান্ত এক কাউন্টার অ্যটাক অ্যালিসন থামিয়ে দিলেও ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ডের মাথায় পা লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান ইংলিশ স্ট্রাইকার ডমিনিক কালভার্ট-লুইন। প্রথজমে কথা উঠলেও পরে ‘ভিএআর’-এর সাহায্য নিয়ে ঠিকই পেনাল্টি দেন রেফারি। সেখান থেকেই গোল করে দলকে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে দেন সিগুর্ডসন।আর তাতেই ২২ বছরের অতৃপ্তি মিটে এভারটনের।
শুধু অতৃপ্তি মিটেছে বললে হবে না, লিভারপুলকে লজ্জার মুখেও ফেলেছে তারা। গত ১০০ বছর আগের রেকর্ডের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাদের। সেই ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে ঘরের মাঠে টানা চার ম্যাচ হেরেছিল লিভারপুল। আর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরের মৌসুমে নিজেদের মাঠে টানা চার ম্যাচ হারার ‘কৃতিত্ব’ছিল শুধু এভারটনেরই। সেই রেকর্ডে আরকজনকে ভাগীদার করতে পারা কী কম আনন্দের কিছু? আর সেটা যদি হয় নগর প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে তো কথাই নেই। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এর আগে টানা ২৪ ম্যাচে এভারটনের বিপক্ষে অপরাজিত ছিল লিভারপুল। এই হারে সেই রেকর্ডও ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।
ক্লপবাহিনীকে এই লজ্জায় ফেলার পেছনের কারিগর কার্লো আনচেলত্তির রেকর্ডও কম কিছু নয়। প্রথম কোচ হিসেবে পাঁচ-পাঁচটি ‘ডার্বি’ জেতার অদ্ভুত রেকর্ড এখন তার। ‘মিলান ডার্বি’, ‘লন্ডন ডার্বি’, ‘মাদ্রিদ ডার্বি’, ‘নেপলেস ডার্বি’ আর সবশেষে ‘মার্সিসাইড ডার্বি’; ইতালিয়ান ডন ঘুরতে ঘুরতে পুরো পৃথিবী জয় করার দ্বারপ্রান্তে। ড্রেসিং রুমের ঠাণ্ডা মাথার মানুষটার মতো আনদিত মানুষ বর্তমানে খুব কমই আছে।