নিজের অজান্তেই বাইচুং হতে চাওয়ার রাতগুলো

সেই বৃষ্টির রাতগুলোতে যে রাতগুলোয় আমি বাইচুংকে দানাদার খাওয়াতে চাইতাম,সুরকুমারের গাল টিপতে চাইতাম, মামারবাড়ির বারান্দাকে দিল্লীর স্টেডিয়াম বানাতে চাইতাম। যে রাতগুলোতে হয়তো নিজেই অজান্তে বাইচুং হতে চাইতাম।

লোডশেডিং। আকাশেও,কলকাতায়ও। বাড়িতে হ্যারিকেন নিভু নিভু। কেরোসিন শেষ। নিভু হলদেটে আলোয় এগিয়ে ধরলাম খবরের কাগজটা। কেউ একজন লিখেছে সেখানে, ‘সিরিয়াকে হারানো শক্ত জানি, কিন্তু সিরিয়াকে হারাতে ভারত আজ ব্রাজিল হয়ে উঠুক একবার।’

হ্যারিকেনের হলদেটে ভাব আরেকটু কমলো। কেরোসিন আর কতোই বা টেনে খেলাবে মান্ধাতা ঝুরঝুরে হ্যারিকেনটাকে। মনটা একটু উড়ুউড়ু হতেই বাবার ধমক খেলাম, ‘পড়া না করতে পারলে কিন্তু কারেন্টও আসবেনা।’ এইরে মরেছে, জোরকদমে শুরু করলাম সমুদ্রগুপ্তকে ভারতের নেপোলিয়ন বলবার কারণগুলো।

কিন্তু..কিন্তু ওরা যে বললো ‘ভারত আজকে ব্রাজিল হয়ে উঠুক!’ সুব্রত পাল কি একটা গোল খেয়ে গেছে? আমার দাদুভাই যে বলেছিলো, ‘সুব্রতটার নিজের জীবনের ভয় নেই!’ বাইচুং কি আজ দানাদার খেয়েছে? আমি দানাদার খেতে একদম ভালোবাসতাম না।

মামারা বলতো, বাইচুংও নাকি দানাদার খায়,তাই ওরকম গোল করে। স্টিফেনটা বুঝি এই বল নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।ধুসস্,কারেন্টটা কখন যে আসবে। বাবা যে বললো, পড়া করলে কারেন্ট চলে আসবে। পড়া তো সেই কখন শেষ। সমুদ্রগুপ্ত,অববাহিকা,ব-দ্বীপ,গ.সা.গু সব শেষ। মা মুড়ি মেখেছে চানাচুর দিয়ে।

মা কে একটা দানাদার চাইলাম। বাইচুং না গোল করলে ভারতটা আজ ব্রাজিল হবেই বা কি করে। আকাশ-কুসুম ভাবতে ভাবতে কারেন্ট এলো। দৌড়ে গিয়ে ২৪ ঘন্টায় মুখ বাড়ালাম। খেলা যে শেষ। কিন্তু তলায় লিখে দিয়েছে, ‘এন পি প্রদীপের গোলে নেহেরু চ্যাম্পিয়ন ভারত।’ এই প্রদীপটা কে? যেই হোক,ভারতকে ব্রাজিল করেছে তো,তাহলেই হবে।

বছরটা কেটে গেলো। আমিও মায়ের কি একটা কাজে মামারবাড়ি গেলাম। অনেকদিন ছিলাম। মামাবাড়িতে বেশ একটা কালার টিভি ছিল। ওখানে ভারত খেললে নীল-নীল দেখায়। আমাদের বাড়িতে ভারত খেললে কালো-কালো দেখায়। মামাবাড়িতেও নীল ভারত খেলছে, আমার ব্রাজিল খেলছে।

ছোড়দাদুর সাথে আমার গভীর আলোচনা চলছে, সুনীল মাথায় ওরকম ব্যান্ডেজ বেঁধে গোল কিভাবে করলো দাদু?তাও আবার দুদুটো টোকা মেরে।মনে পড়ছে দিনকতক আগের ২৪ ঘন্টা চ্যানেলের শো। কে একজন ফোন করে বলছিলো, ‘দিল্লির ছেলে কাল জান লড়িয়ে দেবে,মাথা ফাটিয়ে ভেবেছে কি ওরা, আমাদের থামাতে পারবে?’, শো-এর সঞ্চালিকা সেই সময় তাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আপনি একটু বেশি আবেগী হয়ে পড়ছেন।’

আচ্ছা ছোড়দাদু, সুনীল কোন মিষ্টি খায় গো? মামারবাড়িতে কিন্তু লোডশেডিং হয়নি। হাত গুণতে হয়নি নীল ভারতের ভবিষ্যতের আশঙ্কায়।দেখলাম, নীল রঙের ভারত খেলছে। আমার ব্রাজিল খেলছে।

সুনীল,বাইচুং,ক্লাইম্যাক্স,স্টিফেন,সুব্রত সবাই খেলছে। আরে সুনীল যে হ্যাট্রিক করে ফেললো ছোড়দাদু। তাজিকিস্তান, তু উড় যা। মেরা ভারত ব্রাজিল হে।সবাই উড়েছিলো সেদিন। হাউটন, ভুটিয়া, ডায়াস, লরেন্সরা তেরঙ্গা নিয়ে জড়াজড়ি করছিলো। আমিই তো শুধু উড়তে পারলাম না। ভারত না হয় ব্রাজিল হয়ে উঠুক। কিন্তু আমার বারান্দাটা কবেই বা দিল্লীর স্টেডিয়াম হয়ে উঠবে। কবেই বা বাইচুংকে গিয়ে বলবো,এই নাও তোমার জন্য দানাদার এনেছি।

একচটকায় বাজ পড়ে ভাবনাটা ওলট-পালট করে দিলো।বছর চোদ্দ বড়ো হয়ে গেছি।ভুলে গিয়েছিলাম সব। বৃষ্টি মনে পাড়িয়ে দিলো। হাউটনের গোল গোল চোখ সেই বৃষ্টির রাতগুলোতে ভারতকে ব্রাজিল করিয়ে দিতো। সেই বৃষ্টির রাতগুলোতে যে রাতগুলোয় আমি বাইচুংকে দানাদার খাওয়াতে চাইতাম,সুরকুমারের গাল টিপতে চাইতাম, মামারবাড়ির বারান্দাকে দিল্লীর স্টেডিয়াম বানাতে চাইতাম। যে রাতগুলোতে হয়তো নিজেই অজান্তে বাইচুং হতে চাইতাম।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...