তখন কত বয়স হবে তাঁর?
বারো, কী তেরো ছুঁই ছুঁই।
চোখ দুটো বড় বড়। কঙ্কালসার একটা বেটে শরীর। মাথায় কিঞ্চিত লম্বা চুল। চোখেমুখে দূরারোগ্য এক রোগে ভোগার আতঙ্ক। মনে দেশ ছেড়ে এই সুদুর স্পেনে এসে সক্কাল বেলায় মাঠে আসার অস্বস্তি।
সবকিছু ছাপিয়ে তার চোখে মুখে অবশ্য খেলা করছে তখন এক চরম বিষ্ময়ের অনুভূতি। এতো বড় বড় ক্লাব বিল্ডিং, এতো বড় ফুটবল মাঠ! আহা, এখানে যদি খেলা যেত!
ভাবতে না ভাবতেই একজন কোচ গলায় বাশি ঝুলিয়ে এসে বললেন, মাঠে নামতে। পাশে থাকা বাবার দিকে চেয়ে সে মাঠে নামলো মৃদু পায়ে। মাঠে নামতেই সব অস্বস্তি দূর হয়ে গেলো। মুহুর্তে শুরু হয়ে গেলো বল নিয়ে কারিকুরি। বাইরে দাড়িয়ে থাকা কর্মকর্তারা ভুলে গেলেন, তারা ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ছেলেটির ট্রায়াল দেখছেন। মনে হচ্ছে, টিভিতে কোনো এনিমেশন ছবি দেখছেন; যেখানে নায়ক ছেলেটি বল নিয়ে যা খুশি করতে পারে।
ঘোরটা কেটে যেতেই স্পোর্টিং ডিরেক্টর কার্লেস রেক্সাস বললেন, ‘এখনই ওকে চুক্তি করাতে হবে।’
তখন ইউরোপের দলগুলো ছোটদেরও চুক্তি করাতে পারতো। কিন্তু এই ট্রায়াল মাঠে কাগজ-কলম কোথায় পাওয়া যাবে? দরকার নেই। রেক্সাসের পকেটে টিস্যু পেপার ছিলো। তাতেই ছেলেটিকে দিয়ে সই করিয়ে নিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে অমূল্য বন্ধনগুলোর একটা লেখা রইলো টিস্যু পেপারে।
এই বন্ধনের ফল কালক্রমে বিশ্ব দেখেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সফল ক্লাব-খেলোয়াড় বন্ধন তৈরি হয়েছিলো সেখানে। একের পর এক সাফল্য, সোনালী দিন এসেছে এই বন্ধনের পথ ধরে। অবশেষে সময় এলো। অবশেষে সময় এলো সব গাটছড়া কেটে বেরিয়ে যাওয়ার।
টিস্যু পেপারের সেই চুক্তি এখন কোটি টাকার দলিলে হয়েছে। তারপরও টিকলো না আর সম্পর্কটা। অবশেষে বার্সেলোনা ক্লাবই জানিয়ে দিলো, তাদের সাথে আর থাকছেন না লিওনেল মেসি। ভেঙে গেলো দুই দশকের এক সম্পর্ক।
কেবলই সম্পর্ক? ভেঙে তো গেলো আসলে একটা পরিবারের গল্প।
মেসি আর বার্সেলোনার সম্পর্ককে আপনি খেলোয়াড় আর ক্লাবের সম্পর্ক দিয়ে মাপতে পারবেন না। এটা আর দশটা যান্ত্রিক সম্পর্কের মত ছিলো না। মেসির জন্য এটা আক্ষরিক অর্থেই নিজের বাড়ি ছিলো। যে সময় তার পরিবারের তার হরমোন সমস্যার চিকিৎসা করানোর উপায় ছিলো না, সেই সময় তাকে নতুন জীবন দিয়েছে এই ক্লাব।
বিনিময়ে মেসি তাঁদের বছরের পর বছর লিগ শিরোপা, চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা এনে দিয়েছেন। একে একে ভরে দিয়েছেন বার্সেলোনার শোকেস। মেসির নিজের শোকেসও কম ভর্তি হয়ে ওঠেনি। একটার পর একটা শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি মিলেছে তার এই ক্লাবে থেকে।
সম্পর্কটা এক বছর আগেই বড় তিক্ততার ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।
তখনকার সভাপতি বার্তেমেউয়ের সাথে মেসির সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলো। কার্যত সব খেলোয়াড়ের শত্রু হয়ে পড়েছিলেন বার্তেমেউ। মেসি একেবারে স্বভাববিরুদ্ধভাবে সংবাদ মাধ্যমে বললেন, তিনি আর ক্লাবে থাকতে চান না; এই নেতৃত্বের অধীনে। তাকে মিথ্যে বলে আটকে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করলেন। তখন মেসির ক্লাব ছাড়াটা সময়ের ব্যাপার ছিলো।
কিন্তু সময়টা বদলালো।
মেসির এই অভিযোগের পথ ধরেই নির্বাচনে হারলেন বার্তেমেউ। আবার প্রেসিডেন্ট হলেন হুয়ান লাপোর্তা। ফিরেই মেসির জন্য স্বচ্ছন্দ পরিবেশ তৈরী করলেন। মেসি আবার খুশি। ক্লাব-খেলোয়াড়ের আচরণই বলে দিলো, মেসি ক্লাব ছাড়ছেন না।
এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটলো।
মেসির একটা চিরকালীন দু:খ ছিলো জাতীয় দলের হয়ে কিছু জিততে না পারা। অবশেষে কোপা আমেরিকা জিতে ক্লাবে ফিরে এলেন। সুখী মানুষের সুখের ছাপ পড়ছিলো সব জায়গায়। ক্লাবের টাকার সংকট। তাই অর্ধেক বেতন ছেড়ে চুক্তি করতে রাজী হলেন বার্সেলোনার সাথে।
কিন্তু হায়!
এই সংসার যে নিয়তিই ভেঙে দেবে বলে ঠিক করে রেখেছে। ইউরোপিয় ক্লাব পরিচালনার আইনেই বার্সেলোনা আর কিছুতেই মেসিকে চুক্তি করাতে পারছে না। অনেক চেষ্টা হলো, অনেক ছোটাছুটি। কিন্তু মেসিকে রাখা অসম্ভব। অবশেষে বাধ্য হয়ে বার্সেলোনা জানিয়ে দিলো, বন্ধনটা এখানেই শেষ।
ক’মাস আগেই পিএসজি আর ম্যানচেস্টার সিটিকে ‘না’ করে দিয়েছেন মেসি। এখন তিনি কোথায় যাবেন, বলা খুব মুশকিল। নতুন কোথাও যেতেই হবে। নতুন কোনো সংসারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই হবে।
এবার আর বার্সেলোনা সমর্থকরা কারো বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পারবেন না। এবার আর ক্ষোভ করতে পারবেন না। কেবল গুমরে কেঁদে বলবেন – হে বন্ধু, বিদায়।