দুর্বিনীত যুবক বিজ্ঞাপনের ছদ্মবেশে বলে যাচ্ছেন…

‘টেস্ট’ ক্রিকেটের নাম ‘টেস্ট’, তার একটা কারণ আছে। ভিতরের মানুষটার অন্তর্লীন চরিত্রের দৃঢ়তা, শ্রমের ইচ্ছা, নিষ্ঠা, মনোসংযোগ, অকম্পিত সাহস ও অনন্ত ধৈর্যের যে পরীক্ষা আমাদের জীবন নিয়ত নিয়ে চলে, সেই একই পরীক্ষা নেয় এই ফরম্যাটটি, মাঠের মধ্যে, পাঁচদিনে। পরীক্ষা, তাই টেস্ট!

প্রথমদিনের শেষে বলেছিলাম, খেলাটা পাঁচদিনের। আমি এই ভারতীয় টিমের কাছে ধন্যবাদার্হ যে আমার কথাটিকে তাঁরা সত্যি প্রমাণ করেছেন। সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও খেলাটিকে তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে শেষ হতে দেননি। সারা শরীর খাদে ঝুললেও, দাঁত দিয়ে দড়িটা কামড়ে ধরে আছে এই টিম।

‘টেস্ট’ ক্রিকেটের নাম ‘টেস্ট’, তার একটা কারণ আছে। ভিতরের মানুষটার অন্তর্লীন চরিত্রের দৃঢ়তা, শ্রমের ইচ্ছা, নিষ্ঠা, মনোসংযোগ, অকম্পিত সাহস ও অনন্ত ধৈর্যের যে পরীক্ষা আমাদের জীবন নিয়ত নিয়ে চলে, সেই একই পরীক্ষা নেয় এই ফরম্যাটটি, মাঠের মধ্যে, পাঁচদিনে। পরীক্ষা, তাই টেস্ট!

এই টেস্ট ম্যাচ হারুক বা জিতুক – অন্তত সেই পরীক্ষার জায়গাটুকুতে ভারতীয় ক্রিকেটাররা সসম্মানে উত্তীর্ণ। লেটার মার্কস পাবেন কিনা, সেটা আজ সকালের দু-ঘন্টা বলবে।

একদিকে বিরাট – যাঁকে, সত্যি বলতে কি, তাঁর দীর্ঘ ব্যাডপ্যাচেও কোনো সময় ‘আউট অফ সর্টস’ বলে মনে হয়নি। আউট হয়েছেন, রান পাননি – কিন্তু কখনো মনে হয়নি, ব্যাটে-বলে হচ্ছে না, কূল পাচ্ছেন না। এবারেও মনে হচ্ছে না সেরকম। স্বচ্ছন্দ লাগছে।

আজ প্রথম সেশনে যদি এক ঘন্টা কেটে যায়, ব্যাটে-বলে হয়, সিঙ্গলস আটকে না যায়, ধীরে-ধীরে হাঁটাচলায় সেই দর্পও ফিরে আসবে, চোখে সেই বিপক্ষের গা জ্বালিয়ে দেওয়া ঔদ্ধত্য। কোহলি-বিরোধী ট্রোল বাহিনীও হয়তো মনে মনে চাইছে, তেমনটাই হোক।

অন্যদিকে আজিঙ্কা রাহানে – যাঁর ব্যাটার হিসেবে বিবর্তনের লেখচিত্র নিয়ে উপন্যাস লিখলে লোকে ‘গাঁজাখুরি গল্প’ বলবে। আইপিএলের ওপেনার, টেস্টে বিরাট কোহলির প্রতিস্পর্ধী, টেস্টে পঞ্চাশ গড়ের ব্যাটার এবং দলের সহ-অধিনায়ক; সেখান থেকে অফ-ফর্মে গড় নেমে যাওয়া চল্লিশের গোড়ার দিকে, তারপর আবার আধুনিক টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের স্মরণীয়তম সিরিজে দলকে সেঞ্চুরি করে এবং ক্যাপ্টেন্সি করে জেতানোর পর দীর্ঘ অফ ফর্মের জেরে বাদ যাওয়া।

অবশেষে নতুন আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে মিডল-অর্ডারে প্রত্যাবর্তন, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ব্যাটিং করে, দলে ফেরত এসেই বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের প্রথম ইনিংসে স্বপ্নের খেলা – এ চিত্রনাট্য অঞ্জন চৌধুরীও কল্পনা করতে পারতেন না।

আর এঁদের উল্টোদিকে তর্কযোগ্যভাবে ম্যাকগ্রা-ব্রেট লি-গিলেস্পির পরে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ক্লান্তিহীন, নিষ্ঠুরতম পেস অ্যাটাক।

কামিন্স আর গ্রিন গুডলেংথ থেকে আঙুলে, কনুইতে, চোয়ালে বল ওঠাবেন বিশ্রিভাবে। বোল্যান্ডের বল স্টাম্প লাইনের আশেপাশে রক্তের গন্ধ খুঁজে ছুঁকছুঁক করে বেড়াবে। স্টার্ক, এলোমেলো লাইন লেংথে দিশাহীন ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই হঠাৎ মৃত্যুবাণ ছুঁড়ে বসবেন। আর তিনি? নাথান লিঁও?

জাদেজা ছাড়া কারো ক্ষেত্রে রাফ-স্পট কাজে লাগাতে পারবেন না ঠিকই; কিন্তু কমলা জ্যাকেট পরে বাইরে বসে থাকা সহব্যবসায়ীর মতোই লিয়ঁ কি আর শুধুই রাফে ফেলে টার্ন করিয়ে উইকেট পান? ফ্লাইট, ডিপ, ল্যুপ, বাউন্স, পেসের বৈচিত্র্য – অজস্র, অজস্র কারিকুরি তাঁর তূণীরে; তিনিও কি ছেড়ে দেবেন সহজেই? পঞ্চমদিনের উইকেটে কঠিনতম পরীক্ষা নেবেন না?

৩৬ বছর ধরে খেলাটিকে ভালোবেসে যাওয়ার পরে আজ এটুকু বুঝি যে আমি এই খেলার খুব খুব কম বুঝি। শুধু দু-চোখ ভরে দেখতেই ভালবাসি, শিখতেই ভালবাসি। আজও বসব – শিখতে, আনন্দিত হতে, ক্ষুব্ধ হতে, উদ্বিগ্ন হতে, বিষণ্ণ হতে, উল্লসিত হতে!

এর আগে টেস্ট ক্রিকেটের দেড়শো বছরের ইতিহাসে চতুর্থ ইনিংসে কেউ এত রান তাড়া করে জেতেনি। কিন্তু ওই যে, ক্রিজে থাকা এক উদ্ধত, দুর্বিনীত যুবক বিজ্ঞাপনের ছদ্মবেশে বলে যাচ্ছেন – ‘আমার অতীত আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সংজ্ঞায়িত করবে না! আমার খাতা আজ থেকেই শুরু!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...